১০ম পর্বের পর:
সেদিন আর তেমন কিছুই হয়নি। বেশ কিছু সময় ওখানে বাকবিতণ্ডা চলে।কিছুক্ষণ পর আপাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে চলে যায় ছেলেগুলো—যেমন এসেছিল, তেমন গতিতেই। ভেতরের ঘটনা ব্যাপক। সে ব্যাখ্যায় গেলে আমার এই লেখার গতি-প্রকৃতি বদলে চলে যেতে পারে। কিন্তু এটুকু বলতে দ্বিধা নেই আজ এত বছরপর। ‘পারস্যুয়েশন অব হ্যাপিনেস’ বলতে যে একটা কথা আছে, তা আসলে নারীর জন্য নয়। মানুষের জন্য। কিন্তু যে সমাজে কোনো মানুষ নেই? যে সমাজে কেবল আছে পুরুষ? যে সমাজে কেবল আছে নারী? সেখানে? সেখানে কী হবে? সেখানে নারী হবে লাঞ্ছিত। যখনই সে নিজের ভালোলাগা-মন্দলাগা কিংবা পছন্দ-অপছন্দ মুখে উচ্চারণ করবে, তখনই সে হবে নিন্দিত। যখন সে তার ভালোলাগার পথে হাঁটতে শুরু করবে ভালো না লাগার পথ পরিহার করবে, তখন সে হবে ধিকৃত। আমি নিজেই সে জীবন পথের মাঝখানে দুটো বিষয় দেখেছি। নিজেরই পথ চলার পাশে-পাশে। দীর্ঘকাল আমি এই বিষয়গুলো যে এতটা গভীর আর ব্যাপকভাবে অনুধাবন করেছি, সেটা নিজেই জানতাম না। কবে কোন কালে কিভাবে চারপাশের বিষয়গুলো আমার অবোধ মনে কী গভীর রেখায় পথ কেটেছে তা আজ লিখতে বসে বুঝতে পারি।
বাবা সরকারি চাকুরে ছিলেন। যখন থেকে বুঝতে শিখেছি, তখন থেকেই দেখে আসছি ছয় ভাইবোনের সংসারে সকালের নাস্তা বানাতে বসেছেন মা আর বাবা। রুটি বানানো চলছে। হয়তো রুটি বেলে দিচ্ছেন মা, সঙ্গে বাবা রুটি শেকে দিচ্ছেন। খুব জ্বর এলে কখনো বাবাকে দেখেছি মাঝদুপুরে বাড়ি ফিরেই আমার কপালে হাত দিয়ে বলছেন ‘কেমন আছ গো মা?’ তারপর পরই বড় বালতি ভরে এক বালতি পানি এনে মাথার নিচে রাবার ক্লথ পেতে কি যে যতনে ঢেলেছেন মাথায় পানি। আমি তখন মা’র অনুপুস্থিতি মিস করতাম। বাবার যত্নটুকু তখন গ্রাহ্যই হতো না। সেটা বুঝি আজ, বড় হয়ে, জীবনের এত পথ পাড়ি দিয়ে তবে। সঙ্গে এ-ও বুঝি ছয় ভাইবোনের সংসারে মা ছিলেন দারুণ ব্যস্ত। তার সময় কোথায় জ্বরে পড়ে থাকা মেয়ের মাথায় পানি ঢালার। জ্বরে আক্রান্ত মেয়ের পথ্য তৈরি করতেই তো সময় শেষ। সঙ্গে আরও আছে স্বামী আর বাকি পাঁচ সন্তানের খাবার তৈরি দেখভাল আরও কত কি? আজ নারী লিখতে গিয়ে হঠাৎ কেন এত নিজের পরিবার আর বাবার প্রসঙ্গ আনছি। সত্যি। নিজেই অবাক হচ্ছি আর ভাবছি এই প্রসঙ্গ কি আনা দরকার এখানে! বাবা মারা গেছেন আজ ৪১দিন। মনটা আজও খুব ব্যথাতুর। তবু এই নারীজীবনে মানুষ হয়ে ওঠার পেছনে বাবার অবদান প্রচুর। এই বিভাজিত সমাজে এই দারিদ্র্যে, এই দ্বিধায়, এই প্রতিকূল পরিবেশে আমি আমার বাবার মতো মানুষ পেয়েছিলাম দারুণ ভাগ্যে। চারভাই আর দুই বোনের সংসারে বাবা কোনোদিনই ভাবেননি মেয়ের বয়স কবে ১৫ থেকে ২০ হয়েছে, কবে হয়েছে ২০ থেকে ২৫। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স পাস করার পর আর পড়তে চাইনি। বাবা এক কথায় বলে দিলেন ‘পড়া শেষ করো। মনে করো না মেয়ে হয়েছ বলে যেখানে খুশি, সেখানে পড়ালেখা ছেড়ে দেবে। আর আমি সেটা মেনে নেব। নিজেকে মানুষ ভাবতে শেখো।’ সেই থেকে আমি নতুন করে নিজেকে মানুষ ভাবতে শিখেছি। আর নিজেকে মানুষ ভাবতে ভাবতে, সত্যি বলছি, নারী জীবন থেকে অনেকবার ছিটকে পড়েছি দূরে, বহু দূরে। মারাত্মক শিকার হয়েছি এই ক্রোধান্ধ সমাজের। নিষ্পেষিত হয়েছি একইসঙ্গে একই সময়ে নারী আর পুরুষের লালিত চিরকালীন বোধের যাঁতাকলে। হয়েছি অপমানিত ঘরে সংসারে-বাইরে। শিকার হয়েছি পুরুষের বিলাসের কিংবা ঘরেরই মাঝে পুরুষের জিঘাংসার। আর প্রতি পদে তার উত্তর দিতে-দিতে নিজের ভেতর মনুষত্ব ধারণ করতে-করতে ভেতরের মানুষটা এসে উপনীত হয়েছি নিদারুণ একাকিত্বে। এখানে কেউ নেই। ভাইয়ের জিঘাংসা নিদারুণ এখানে! বোনের ক্রোধ সীমাহীন। স্বামী ন্যায় বিচারক নন। শাশুড়ি পাশবিক। প্রেমিক এখান দারুণ বিলাসী, বড়ই স্বেচ্ছাচারী! শুধু কেবল সত্যি এক- নিজেকে মানুষ পরিচয়ে প্রতিষ্ঠা করার মূল্য দিতে হবে এক এক করে গুনে-গুনে জনে-জনে!
চলবে…