[তপন বাগচী—একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক। তিনি ১৯৬৮ সালের জন্ম ২৩ অক্টোবর মাদারীপুরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা তুষ্টচরণ বাগচী; মা জ্যোতির্ময়ী বাগচী। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় এমএ ও পিএইচডি করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কবিতাগ্রন্থ: শ্মশানেই শুনি শঙ্খধ্বনি, কেতকীর প্রতি পক্ষপাত, অন্তহীন ক্ষতের গভীরে, সকল নদীর নাম গঙ্গা ছিল। প্রবন্ধগ্রন্থ: সাহিত্যের এদিক-সেদিক, সাহিত্যের কাছে-দূরে, চলচ্চিত্রের গানে ডক্টর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, লোকসংস্কৃতির কতিপয় পাঠ, বাংলাদেশের যাত্রাগান : জনমাধ্যম ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত, মুক্তিযুদ্ধে গোপালগঞ্জ, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ : চন্দ্রাহত অভিমান, নির্বাচন সাংবাদিকতা, নজরুলের কবিতায় শব্দালঙ্কার, তৃণমূল সাংবাদিকতার উন্মেষ ও বিকাশ। পুরস্কার ও স্বীকৃতি: সাংস্কৃতিক খবর পদক (কলকাতা, ২০১৩), মাইকেল মধুসূদন পদক (২০১২), লিটল ম্যাগাজিন মঞ্চ সংবর্ধনা (নদীয়া ২০১০), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সাহিত্য পুরস্কার (২০০৯), কবি বাবু ফরিদী সাহিত্য পুরস্কার (২০০৯), মাদারীপুর সুহৃদ পর্ষদ সম্মাননা (২০০৯), ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদ সম্মাননা (২০০৯), মহাদিগন্ত সাহিত্য পুরস্কার (কলকাতা ২০০৮), এম নূরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০০৮), জেমকন সাহিত্য পুরস্কার (২০০৮), অমলেন্দু বিশ্বাস স্মৃতি পদক (২০০৮), জসীমউদ্দীন গবেষণা পুরস্কার (১৯৯৬), মুনীর চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯১)।
দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করার পর বর্তমানে বাংলা একাডেমির গবেষণা সংকলন ও ফোকলোর বিভাগের উপপরিচালক। সম্প্রতি সাহিত্য, রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম, দর্শন প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর মুখোমুখি হয়েছেন তরুণ কথাসাহিত্যিক হামিম কামাল]
হামিম কামাল: হিটলারকে কিভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল?
তপন বাগচী: যুদ্ধবাজ হিটলার আসলে মানুষের ভালো চেয়েছিল। ভালো চেয়েই এই যুদ্ধটা করেছে। সে ভেবেছিল একটা পরিবর্তন চাইলে এ রকম সংঘাতের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। হিটলারের পুরো কাহিনিটা আমার মনে নেই। কারণ তখন আমি হিটলার সম্পর্কে অতটা জানতাম না। আমি জানতাম মাইকেল সম্পর্কে, তার জীবনী পড়েছিলাম। আমি লেনিন সম্পর্কে জানতাম, ‘ছোটদের লেনিন’ পড়েছিলাম। যে কারণে আমি ওগুলোকে ওদের বোধের সঙ্গে মেলাতে চেষ্টা করেছি। মাইকেলের যাত্রাপালায় অনেক কঠিন, সংস্কৃত তৎসম শব্দও ছিল। কিন্তু মানুষ ওসব গ্রহণ করেছে। বক্তব্য যদি তার প্রাণের কাছাকাছি হয়, বার্তা যদি তার প্রাণের কাছাকাছি হয়, মানুষ কিন্তু গ্রহণ করে।
আমার তখন মনে হয়েছে যে, প্রকরণ একটা ব্যাপার। ওই লেনিনের জীবন যদি আমি প্রবন্ধের মতো বা একটা বক্তৃতার মতো করে তাদের শোনাতাম, ওরা কিন্তু শুনতো না। কাহিনির মধ্য দিয়ে যখন এসেছে তখন তারা লেনিন জেনেছে, মধুসূদন জেনেছে। তখন আমার মনে হয়েছে একই বক্তব্য শ্রোতা বা দর্শকভেদে আলাদা প্রকরণ দাবি করে। একটা বক্তব্য নিয়ে যখন আমি ছড়া লিখি, তাৎক্ষণিক এটা উত্তেজনা, একটা আবেগ তৈরি করতে পারি। কিন্তু একটি কবিতা যখন লিখি, তখন আর তাৎক্ষণিক উত্তেজনা নয়। এটা দীর্ঘদিন ধরে মানুষের ভেতরে থেকে ধীরে ধীরে কাজ করবে, তার মানবিক বোধকে শানিত করবে। কিন্তু ছড়ার জন্য আমাকে ওই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না। আবার একটি গান যখন আমি লিখব, তখন মনে করব যে, এই বাণী লিখলাম, এই যে শব্দবন্ধ তৈরি করলাম এবং এর জন্যে সুরের আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে যাচ্ছি, কেউ সুর দিলেই এটা পূর্ণতা পাবে। আমার যখন মনে হলো, এটা গানেও আসবে না। একটা কাহিনির মধ্য দিয়ে আজ রাতেই ওদের আমার বোঝাতে হবে, তখন আমি নাটক লিখতে যাব। লক্ষ্যস্থল কিন্তু মানুষ, সাধারণ মানুষ। যে মানুষ সত্যিকার অর্থেই বোদ্ধা, তার কাছে তো আমাকে যেতে হবে না। আমার যেতে হবে সাধারণ মানুষের কাছে। সবসময় আমি সাহিত্য বলতে যা কিছু করেছি, সাধারণ মানুষের জন্য করেছি। একাডেমিকভাবে কে শিক্ষিত আর কে অশিক্ষিত তা বিচার্য নয়। আমার কাছে যার দেশের জন্যে, মাটির জন্যে, মায়ের জন্যে, ভাষার-সংস্কৃতির জন্য টান আছে, সেই শিক্ষিত মানুষ। এবং তাদের কথা ভেবেই সাহিত্য রচনার কথা চিন্তা করেছি। শিল্পের জন্য শিল্প—এই তত্ত্বের বাইরে আরেক তত্ত্ব যে আছে, জীবনের জন্য শিল্প, আমি ওটাকেই বেছে নিয়েছি। জীবনের জন্য শিল্প।
হামিম কামাল: ঠিক এ প্রশ্নেই আমি আসছিলাম—আর্ট ফর আর্টস সেইক অর ফর পাবলিক বেটারমেন্ট—কোনটা আপনি গ্রহণ করতে চাইছেন? না উভয়ই? না কি আপনি সচেতনভাবেই পাবলিক বেটারমেন্টের বিষয়টাকেই বেছে নিয়েছেন? মানুষের জন্য শিল্প।
তপন বাগচী: মানুষের জন্য মানে, জীবনের জন্য শিল্প। মানুষ ওই জীবনের মধ্যে পড়ে যায়।
হামিম কামাল: তাহলে একটুখানি বদলে গেল। মানে শিল্পের জন্যও শিল্প নয়, মানুষের জন্যেও শিল্প নয়। বরং দেখা যাচ্ছে আপনি একটা উপলব্ধিকেই বরং বেছে নিয়েছেন। জীবনের জন্য শিল্প।
তপন বাগচী: তবে এ জীবন চলমান জীবন, স্থবির জীবন কিন্তু নয়। এই জীবনের মধ্যে প্রাণী ও প্রকৃতিও রয়েছে।
হামিম কামাল: বেশ তো, এটা একটা দীর্ঘ পথহাঁটা। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে এখানে টিকে থাকাটা একটা অবিরত তপস্যার ব্যাপার। তো এ তপস্যায় কী কী বিরোধের মুখে আপনাকে পড়তে হয়েছে? কী কী আক্রমণের মুখে আপনাকে পড়তে হয়েছে? কারণ, মানুষকে অনেক সময় বোঝানো কঠিন যে, আপনি তাদের দিতে চাইছেন।
তপন বাগচী: এখানে অনেক মজার বিষয়ও চলে আসে, একটু পেছন থেকে শুরু করতে হয়। পড়ালেখার দিক থেকে, আমাদের স্কুলে, আমাদের থানায় অর্থাৎ সেন্টারে আমি ফার্স্টবয় ছিলাম। কলেজেও ফল ছিল বেশ ভালো। আমাদের পর্যায়ের অনেকে চিকিৎসক-প্রকৌশলী এসব হওয়ার চিন্তা ভাবনা করেছে। আমার এসব হওয়া হয়ে ওঠেনি এবং আমার এ জন্য কোনো আক্ষেপও নেই। আমার যখন দেশের বাইরে স্কলারশিপ হয়েছে এগ্রিকালচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য, তখন আমার এলাকার একজন কৃষক নেতা এসে বললেন, দেখো, অমুকের ছেলেটি কোথাও ভর্তির সুযোগ পায়নি, খুব গরিব, তিনি কৃষক রাজনীতি করেন, দেশের জন্য কাজ করেন, এদিকে ছেলেকে পড়ানোর মতো টাকাও তার নেই। তুমি না গেলে ওকে পাঠানো যায়। আমি তখন ওই শিক্ষাবৃত্তি ত্যাগ করি। ঠিক আছে, বাইরে আমি যাব না তাহলে, বরং সে যাক। আমি চিন্তা করেছি, না, আমি এখানেই থাকি।
একটা স্বপ্ন ছিল, এ দেশটা একদিন এমন থাকবে না। যারা এমএ পাস করে বড় চাকরি করে, তাদের অংশ আর কত ভাগ। সরকারি চাকরিজীবী ধরি দুই লাখ, তিন লাখ। এর বাইরের মানুষই কিন্তু বেশি এবং তারাও তো সম্মানের সঙ্গেই বেঁচে আছে। এসব ভেবে ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর ভালো চাকরির চিন্তা করে আমি আর দৌড়াইনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স হয়ে যাওয়ার পর খুলনা বিআইটি এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েও আমি আর যাইনি। রাজশাহী আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও চান্স হয়েছিল। ভেবেছি ঢাকাতেই থাকব। টিউশনিটা চালিয়ে যাব, আবার সাহিত্যটা করা যাবে। ছোটবেলা থেকে লক্ষ করেছি আমাদের সবকিছুই ঢাকাকেন্দ্রিক। বলব না রাজধানীকেন্দ্রিক, বরং বলব ঢাকাকেন্দ্রিক। সাহিত্য, অবকাঠামো, রাজনীতি সব এই একটা শহরকে ঘিরেই। পৃথিবীর অন্য কোথাও এমন নয়, সবখানেই বিকল্প শহর আছে। কোনোটি শিল্পের জন্য, কোনোটি শিক্ষার জন্য, কোনোটি রাজনীতির জন্য।
এমনকি আমি ভারতের কথাও যদি বলি, প্রতিটি রাজ্যে অন্তত এমন দুটি শহর আছে, একটি রাজধানী, অন্যটি সহায়ক। যেমন পশ্চিমবঙ্গে কলকাতার প্রায় সমান মাপের আরেকটি শহর হাওড়া। কিন্তু বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা হলো, সব ঢাকাকেন্দ্রিক। আমাকে ঢাকায় থাকতে হবে, এমন একটা লক্ষ আগে থেকেই ছিল। তো এই যখন অবস্থা, আমি যখন ঢাকায়, তখন স্বৈরাচার তাড়ানো একটা বড় অ্যাজেন্ডা হয়ে আবির্ভূত হলো। ’৮৩ সালে দীপালি সাহা, কাঞ্চন, মোজাম্মেলকে হত্যা করা হয়, সারাদেশ ফুঁসে ওঠে। ’৮৫ সালে আমি ঢাকায় আসি। এর আগে একবার এসেছিলাম রাজেন্দ্র কলেজের জন্য সরকারি বাস গ্রহণ করতে ছাত্রপ্রতিনিধি হিসেবে। ঢাকায় এসে আমরা এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আমি ঢাবির পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি হই। এ সাবজেক্টটা রেগুলার ক্লাস দাবি করতো, কঠিন বিষয় ছিল। আমি ক্লাস করতে পারতাম না। থাকতাম হয়তো পল্টনে, বা মধুর কেন্টিনে। তখন এমনও হয়েছে, কাল মিছিলে যেতে হবে, আজ হলের প্রত্যেকটা রুমে গণসংযোগ করতে হবে, এই করতে করতে রাতে এসে আর পড়তে পারতাম না। পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটলো।
কিন্তু একবারও মনে হয়নি, তখনো মনে হয়নি, এখনো মনে হয় না, আমি পিছিয়ে গিয়েছিলাম। বরং মনে হয়েছে, আমি তো একটা কাজ করছি এবং কোনো না কোনো দিন এর মূল্য পাব। এ সময় আমার একাডেমিক চারটা বছর খসে পড়লো। সবটুকুই যে লেখার জন্য, তা নয়। লেখক হিসেবে যে এমন কিছু হয়ে গেছি, এত বড় হয়ে গেছি যে শিক্ষাগ্রহণকে অগ্রাহ্য করেছি, তা অবশ্যই নয়। তবে ওই সময়টা আমার সাধনার জন্য গেছে। আমার সাধনার মধ্যে সাহিত্য, রাজনীতি এমনভাবে ছিল যে, আমি একাডেমিক শিক্ষার সঙ্গে ওটাকে মেলাতে পারিনি।
এটা হয়ত আমার এক ধরনের দুর্বলতা। আমাদের সঙ্গে অনেকেই পেরেছে। এসবও করেছে আবার লেখালেখিও করেছে, আমি পারিনি। ফলে চারটা বছর ড্রপ যায়। এরপর আমি আবার অন্যভাবে ফিরে আসি। সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর করি, পরে পিএইচডি করি। এখন হিসাব করে দেখি, যারা তখনো চালিয়ে গেছে, আমি তখন ছেড়ে দিলেও এখন একটা পর্যায়ে আমি আবার তাদের কাছাকাছি এসে গেছি। অতএব ওই ক্ষতিটাও আদতে কোনো ক্ষতি ছিল না বরং মধ্যখানে আমার লাভ হয়েছে। ওই চার বছর আমি মানুষের সঙ্গে মিশেছি, বন্ধুদের সঙ্গে মিশেছি, রাজনীতির সঙ্গে থেকেছি, সারাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছি। সাহিত্য রাজনীতি সংস্কৃতি বিষয়ক যত অনুষ্ঠান, বিভিন্ন কলেজের যত ছাত্র সংগঠন ওদের সঙ্গে সংশ্রব ঘটেছে। সব মিলিয়ে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা এখনো আমার কাজে আসে। ক্লাসের বাইরে আমি যে শিক্ষাটা পেয়েছি, সেটা এই বহুমুখী হতে যাওয়ায় কাজে এসেছে। আমি খ্যাতিমান হইনি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমি যা করতে চেয়েছিলাম, তাই করেছি।
আমি চেয়েছিলাম, আমার মনের কথা আর দশ জনের মনের কথা হয়ে উঠুক। আবার দশজনের মনের কথাকে আমার মনের কথা মনে করে লিখতে চেয়েছি। আমি অনেকটাই পেরেছি বা আরও পারব। আমার সংগ্রাম বলতে, সবচেয়ে বড় সংগ্রামটা ওই একাডেমির সঙ্গেই হয়েছিল। আমার পরিবার আমার ওপর অসন্তুষ্ট হয়েছে, আমাকে ভুল বুঝেছে, আত্মীয়, বন্ধুরা ভুল বুঝেছে, যা আবার একটা পর্যায়ে এসে কেটেও গেছে। আমার বাবা একদিন প্রশ্ন করলেন যে, আমি ’৬৮ সালে বিকম পাস করেছি, আর তুই কিনা এই আমলে এমএ পাস করতে পারবি না বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে? তখন আমি বাবাকে বলেছিলাম, ‘বাবা, তোমার ছেলে নেশা তো করে না। তোমার ছেলে তো অস্ত্রবাজি করে না, মেয়ে নিয়ে ফূর্তি কওে বেড়ায় না। তোমার ছেলে বই পড়ে, মানুষের জন্যে কাজ করে। কষ্ট পেয়ো না। একদিন ঘুরে দাঁড়াব।’ বাবা দেখে গেছেন যে তার ছেলে নষ্ট হয়ে যায়নি।
হামিম কামাল: তাহলে দেখা যায়, আপনার এগোনোর পথে রাজনীতি একটা স্পিড ব্রেকারের মতো ছিল।
তপন বাগচী: স্পিডব্রেকার বটে। তবে মাঝে মাঝে স্পিডব্রেকারের একটা সুবিধা এই যে, এটা সাবধান করে, পরে আবার গতি বাড়ানো যায়।
হামিম কামাল: শিল্পীর ভেতর ঈশ্বর টের পান?
তপন বাগচী: শক্তির সম্পর্ক আছে। যদি ঐশ্বরিক বলি, তো এতই ভাববাদী জায়গায় চলে যায় যে, ওটা আবার মানতে পারি না। আমি মনে করি শিল্পে একটা প্রাকৃতিক শক্তি কাজ করে। এটাকে কেউ ঐশ্বরিক বলবে, কেউ প্রাকৃতিক বলবে। একেবারে বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে—ওই প্রাকৃতিক শক্তির কথাই বলব। ভেতর-বাহির উভয় দিক থেকেই এ শক্তি কাজ করে। আর এই শিল্পসৃষ্টির ব্যাপার যতখানি প্রতিভার, এরও বেশি সাধনার। জন্মের সময় সবাই একই অবস্থায় জন্মে। পরে কেউ জঙ্গি হয়ে ওঠে, কেউ নেতা। ঐশ্বরিক শক্তির কথা এলে বলতে হয়, তা তো সবার ভেতরই ছিল। যদি সাধনা না থাকে, যদি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে সে না আসে, পরিবেশ, প্রতিবেশ যদি সে অনুকূলে না পায়, তাহলে ঐশ্বরিকতা থেকেও বা কী লাভ? শিল্পীর ভেতর ঐশ্বরিকতাকে ছাপিয়ে যা প্রধান, তা অধ্যবসায়, সাধনা, অনুশীলন।
হামিম কামাল: মানুষ তো বলা যায় শক্তির একটা ক্যাপসুল নিয়ে আসে। দেখা যাচ্ছে যে ক্যাপসুলটা ফেটে একটা কিছু বিকশিত হচ্ছে। আপনি বললেন, কেউ নেতা হওয়ার দিকে যাচ্ছে, কেউ জঙ্গিবাদের দিকে, কেউ মৌলবাদের দিকে যাচ্ছে, কেউ হচ্ছে উদারপন্থী, এই যে হয়ে ওঠা, এর সঙ্গে বিকাশ জড়িত আর বিকাশ হওয়ার সঙ্গে জড়িত পুষ্টি নেওয়ার বিষয়টা। কে আসলে কোন জায়গা থেকে, হতে পারে তত্ত্ব থেকে, পুষ্টি নিচ্ছে, নেওয়ার এক পর্যায়েই হয়ত তার ভেতর কোনো একটা মতবাদ বিকশিত হয়ে উঠলো। এখন আমরা ইতিবাচক বিকাশ হিসেবে যদি মনুষ্যত্ববোধ হয়, তো এই বোধের পুষ্টি নেওয়ার জায়গাটা কী, আপনার মতে। এখানে সংস্কৃতি, দেশের মাটি, নিজ ভূখণ্ডে ভূমিকা কেমন?
তপন বাগচী: আমি এর আগে আরও এক প্রশ্নের উত্তরে বলে গেছি, সেই শিক্ষিত যে দেশকে ভালোবাসে, মাকে ভালোবাসে। ছোটবেলায় যদি পরিবার জীবন যাপনের শুরু থেকেই ভালোবাসার এই শিক্ষাটা পায়, পরিপার্শ্বকে, প্রকৃতিকে ভালোবাসতে শেখে, প্রকৃতির বিভিন্ন রূপকে ভালোবাসতে শেখায়, দেশকে ভালোবাসতে শেখায়- এসব কিন্তু সংস্কৃতিরই অঙ্গ। দেশপ্রেম এখ ধরনের দেশাচার, লোকাচারের অঙ্গ। আর দেশকে ভালোবাসলে আমার দেশের গানকে ভালোবাসব, আর গান তো সংস্কৃতিই। সব মিলিয়ে যদি মাটি, দেশ, ভাষা, মা, মানুষ এদের ছোটবেলা থেকে যদি ভালোবাসতে শিখি, বুঝতে শিখি যে, আমি এদের অংশ, এদের সবাইকে নিয়েই আমি, এই বোধ যদি আসে, তাহলে অপসংস্কৃতির দিকে বা সংস্কৃতির বাইরের কোনও রূপের দিকে তার যাওয়ার কথা নয়।
হামিম কামাল: এখানে একটা বিষয় আছে, বাঙালির দিকে যদি তাকাই, বাঙালির মধ্যে মিশ্র জাতিসত্তার অস্তিত্ব তো আপনি নিশ্চয়ই টের পান, চোখে মুখে ধরা পড়ে।
তপন বাগচী: হ্যাঁ, মিশ্র তো আছেই। দীর্ঘদিন আমাদের কারা শাসন করেছে। যারা শাসন করেছে, বলা যায় ৪৭-এর আগে আমরা তো দীর্ঘকাল পরাধীন ছিলাম। পরাধীন বলতে, অন্যের অধীন শুধু নয়, অন্য সংস্কৃতির অধীন ছিলাম, অন্য ভাষাভাষীর অধীন, অন্য ভূগোলের মানুষের অধীন। তো সেই প্রভাব কিছুটা তো থাকবেই। এটা হলো রাজনৈতিক ব্যাপার। আর এমনিতেও আমাদের ইতিহাসের হাজার বছর পেছনে যাই, দেখব বাইরে থেকে লোক আসছে, সংকর বিষয়টি তৈরি হচ্ছে, বাঙালিকে তো অনেকেই সংকর জাতি বলছে। একটা পর্যায়ে এসে আমরা হয়ত একটা জাতিসত্তা অর্জন করেছি। কিন্তু এই জাতিসত্তা অর্জনের আগে থেকে আমরা কি সর্বতোভাবে মৌলিক ছিলাম? অন্য রক্ত তো আমাদের সঙ্গে মিশেছে।
হামিম কামাল: এটা আসলে অনেক্ষে ক্ষেত্রে ঠেকানো যায় না। আরও অনেক জাতির ক্ষেত্রেই হয়েছে।
তপন বাগচী: সে কারণে কিন্তু আমরা এখন দাবি করতে পারি, দীর্ঘদিনের চর্চায় বাঙালি স্বকীয়, নিজস্ব জাতিসত্তা অর্জন করেছে।
হামিম কামাল: যে মুহূর্তে আমরা একটা সত্তা হয়ত ধীরে ধীরে টের পেতে শুরু করেছি, যখন একটা অংশ শিক্ষিত হতে শুরু করলো, আলোকায়নের ভেতর দিয়ে যেতে থাকল, আত্মপরিচয়ের বোধ যখন কড়া হয়ে উঠতে পারত, ঠিক এমন একটা প্রাইম টাইমে দেখা গেল যে, আমাদের ভূখণ্ডটা ভাগ হয়ে গেল। এই বাংলা ভাগ হওয়াকে আপনি কী চোখে দেখেন। আমার মত হলো, একটা দেহের খণ্ডিত অংশ কিন্তু কোনো আক্রমণ ঠেকাতে পারে না। তা অপসংস্কৃতি হোক আর যাই হোক। এটাকেই ধরি। যেহেতু প্রতিটি মানুষ বড় হতে হতে সংস্কৃতি থেকে পুষ্টি নিচ্ছে। একটা ভূখণ্ড, যেটাকে বাংলা বলা হচ্ছিল, ওই ভূখণ্ডে জন্মে একজন মানুষ পুরো বাংলার সংস্কৃতির একটা লব্ধি পেত। এখন বাংলা যখন খণ্ডিত হয়ে গেল, একটা বার, বাধা, চলে এলো, এটা পরবর্তী প্রজন্মের বড় হওয়ায় কোনো নেতিবাচক প্রভাব রেখেছে বলে আপনি মনে করেন কিনা, কোনো অস্তিত্ব সংকট তৈরি করেছে কিনা।
তপন বাগচী: সংকট আমি ঠিক বলব না। কারণ এই বিভাজনগুলো মূলত সময়ের প্রয়োজনেই এসেছিল। একটা বিষয় চিন্তা করো, একটা পরিবার যখন বড় হয়ে ওঠে, তখনকার কথা। আমার বাপ-চাচারা যেমন চার ভাই। তারা যখন বড় হলো, তারাও কিন্তু চারটা সংসার করলো। তাদের সন্তানরা, অর্থাৎ আমরা চার ভাই যখন বড় হচ্ছি, আমরাও কিন্তু ভাগ হয়ে যাচ্ছি। তাই বড় হতে হতে একসময় আর এক নৌকায় ধরে না। তখন আরেক নৌকা পার হতে হয়। এক্ষেত্রে এসব আমাদের মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। কিছুটা আবেগ তো কাজ করেই। আমি আর আমার ভাই যখন আলাদা সংসার গড়ব, ঐক্য থাকছে, আবার অনিবার্যভাবে মেনেও নিচ্ছি দুই সংসার। এটা সংকট তৈরি করে বটে, কিন্তু বৃহত্তর অর্থে যদি চিন্তা করি, তখন দেখি, আমাদের ভাষাভাষীদের যে নৈকট্য ছিল, সেটা অনেকটা আলাদা হয়েছে। এ কারণে আমাদের বেদনাটা বেশি। এদিকে ভূগোল সাক্ষ্য দেয়, একটা সময়ের বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়ন, সেটিও তো ভাঙতে হয়েছে। আবার দুই জার্মানি ভাগ হয়ে যাওয়ার পর আবার দীর্ঘদিন পরে এক হলো। বার্লিনের উদাহরণও মনে পড়ে। যে কারণে আমরা ভাগ হয়েছিলাম, এরচেয়েও অনেক তুচ্ছ কারণে বার্লিন প্রাচীর গড়ল। এরকম ভাঙাগড়াও চলে। কেউ কেউ স্বপ্ন দেখে দুই বাংলা আবার এক হবে। এমন স্বপ্ন দেখলে তো আমার আনন্দই হয়। কিন্তু যেটা মনে করি, এটিও রাজনৈতিক কারণে সম্ভব নয়। আমিও চাইব না, আমার স্বাধীন রাষ্ট্র একটা আলাদা রাজ্যের সঙ্গে মিশুক। এসবে কখনো কেউ এক হবে না। দরকারও নেই। যে অবস্থায় আমরা নিজেদের পেয়েছি, সে অবস্থাতেই গড়ে নিতে হবে।
চলবে…