মানুষ ও আদিমতার ভাষা ছিল সুর ও ছন্দ। অর্থাৎ সাহিত্যের প্রাচীনযাত্রা কাব্যময় ভাষার মধ্য দিয়ে। তাই কবি ও কবিতা এত সংবেদনশীল। কবিরাই কেবল উন্মোচন করেন আপন আত্মাকে, ইন্দ্রিয়ের অতীন্দ্রিয় সত্তাকে। ফলে কবিতায় জীবনের চেয়ে শিল্প বড় হয়ে ওঠে।
কবিতা কেমন অথবা কবিই বা কে? এই প্রশ্ন বর্তমান সময়ের কবিদের উদ্দেশে বলাই যায়। কেননা বর্তমানকালে আমরা যে ব্যাপক কবিতার বাজারে হাবুডুবু খাচ্ছি, কখনো কখনো বিস্মিত হচ্ছি, পুলকিত হচ্ছি প্রভৃতির পেছনে এক চোরাস্রোত কাজ করে চলেছে। যা পাঠকের বোধগম্য নয়। ব্যাপারটা এমন যে, আপনি বাজার থেকে হরেক রকম আমের জুস কিনে খাচ্ছেন, সারাবছর ধরেই খাচ্ছেন; অথচ আপনার মনে-মস্তিষ্কে মৌসুমি আমের গলে পড়া রসের হাতচাটা স্মৃতি সদা জাগ্রত। বর্তমান সময়ের কবিদের রচনার নৈপুণ্যের বলে পাঠক একরকম পরিণত হয়ে গেছে পাস্তুরিকৃত জুস গ্রহীতার মতোই। অর্থাৎ আমরা পাস্তুরিকৃত কবিতা খাচ্ছি, আর কবি এখানে জাদুকরের ভূমিকায় অবতীর্ণ। কবিদের হাতে দীর্ঘদিনের অর্জিত কৌশলের বলে কবিতার জন্ম হচ্ছে ঠিকই কিন্তু পাঠক সেই মৌসুমি আমের বাস্তবের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যে বঞ্চিত করার অধিকার কারও নেই। কারণ সময় প্রত্যেকের জন্যই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
এ দিকটি বর্তমান প্রজন্মের কবিদের মাঝে ব্যাপকহারে লক্ষ করা যায়। তারা রীতিমত পড়েন কম লেখেন বেশি এবং প্রতিদিনই কবিতার জন্ম দিয়ে থাকেন। আর যেহেতু প্রতিদিনের চর্চা মানুষকে পারদর্শী করে তোলে, তাই অসাধারণ নৈপুন্যের বলে অনেক কবি খ্যাতির শীর্ষে উঠে যান খুব সহজেই। সুতরাং পাঠকরা সাবধান! কবিতা খ্যাতি লাভের কোনো বিষয় নয়।
এই সাবধানতার বাণী মাথায় রেখে কবিতা পাঠের ক্ষেত্রে কবি নির্বাচনও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
কবিতাকে সামাজিক আলাপ থেকে ইন্দ্রিয় পর্যায়ে উন্নিত করার প্রয়াস লক্ষ করা যায় এ সময়ের কবিদের মাঝে। কবি শিমুল মাহমুদ (জ.১৯৬৭) বরাবরই নিজেকে আড়ালে রাখতে পছন্দ করেন, মিডিয়াবাজির প্রতিযোগিতায় নিজের নাম লেখানোর প্রয়োজন কখনোই মনে করেননি। সচেতনভাবেই এই দিকটি এড়িয়ে গেছেন। বরং নিজেকে খুব বেশি সংযুক্ত করেছেন নির্মিত কবিতার বিশাল জগতের সঙ্গে।
কবিতা একেবারেই স্বগতোক্তির প্রকাশ। কেননা কবিতা দিয়ে সমাজ বদলানোর আশা করা নিছক বোকামি ছাড়া কিছু নয়। আবার কবিকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানববন্ধন করতে হবে, ব্যাপারটা এমনও নয়। কবি ও কবিতা শিল্পের সহোদর। আর শিল্পকে আমারা রাস্তায় প্রত্যাশা করতে পারি না। প্রত্যাশা থাকতে পারে কেবল ব্যক্তি হিসেবে একজন লেখকের উপস্থিতি। অথচ আজকাল কবি ও কবিতাকে আমরা জোর করে রাস্তায় নামিয়েছি।
কবিতার বিচরণ হলো নীরবে-নিভৃতে, কবি থেকে কবিতার, কবিতা থেকে পাঠকে, তারপর বিশাল জগতের দ্বার উন্মোচনের পালা। কবিতা হলো আত্মার সঙ্গে আত্মার খেলা। আর এই আত্মার ক্রমবিকশিত প্রকাশ পেয়েছে শিমুল মাহমুদের ‘কাব্যকথা কাকবিদ্যা’(২০১৬) কাব্যগ্রন্থের প্রারম্ভে কবির কাব্যভাবনায়, যার কিছু চুম্বক অংশ তুলে ধরে কবিবোধের কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব:
১. কবিতা বোধের পখা দিয়ে ছুঁয়ে দেওয়ার বিষয়;
২. কবিতা মানুষের সবচেয়ে মানবিক অংশটুকুতে টোকা দেয়, বোধ ও অর্থের প্রণোদনায়।
৩. […] দৈনন্দিন বস্তুজগৎ আশ্রিত ঘটনাবলীর চিত্রায়ন ও জীবন-জগতের মর্মার্থের প্রতিভাস হয়ে উঠতে পারে কবিতা।
৪. আমি কবিতায় প্রাত্যহিক নন্দনপ্রিয়তাকে খুব সচেতনভাবেই প্রত্যাখ্যান করতে ইচ্ছুক।
৫. যদি ধর্মপুস্তক প্রশান্তি প্রদায়ক যথেষ্ট ভাষা-অভিধা হতো তা হলে সভ্যতায় শিল্প-সাহিত্য চর্চার কোনো প্রয়োজন হতো না।
৬. […]জীবজগতে শুধু মানবকুলই যৌনতার সঙ্গে প্রেমকে সংযুক্ত করার ক্ষমতা সংরক্ষণ করে; […] এই প্রেম ও যৌনতার নামই কবিতা;
এই শেষোক্ত উক্তিটির মধ্য দিয়েই এ কাব্যগ্রন্থের দ্বার উন্মোচন করা যায়। প্রেম ও যৌনতা বিশেষ ব্যঞ্জনায় উঠে এসেছে এ কাব্যগ্রন্থে। আপাত অর্থে কবিতা পড়ে মনে হতে পারে ছাড়া ছাড়া কথার পরম্পরা সাজিয়েছেন কবি তাঁর কবিতায়। মনে হতে পারে শব্দের পর শব্দ, বাক্যের পর বাক্যের কোনো যোগসাজস নেই। অথচ গভীর মনোনিবেশেই কেবল ধরা যায় কবিতার আন্তঃসম্পর্ক। তাই কেবল প্রেম ও যৌনতার কচকচানিতে এসে থেমে থাকেনি কবিতার মর্মার্থ। ক্ষুদ্রাকৃতির এই কবিতাগুলো পরিণতি লাভ করেছে একটি বাক্যে, আবার কখনো কখনো একটি শব্দে। কবিতার প্রত্যেকটি নামের মধ্য দিয়ে কবিতার ভেতরে ডুব দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন কবি। গ্রন্থের প্রথম কবিতাই মানবজীবনের ‘চিরায়ত’বাস্তবতাকে উপস্থাপন করেছে। প্রেম ও দেহ একে অন্যের পরিপূরক, একটি ছাড়া অন্যটির কোনো মানে নেই। দেহ যতক্ষণ, ততক্ষণই প্রেমের স্থায়িত্ব। অবশ্য এর বাইরে যে প্রেমকে মানুষ কল্পনা করে সে প্রেম স্বর্গীয় প্রেম, যা মানবের সাধ্যাতীত। এই স্বর্গীয় অনুভূতিই মানুষকে প্রেমবোধে জাগিয়ে তোলে এবং শেষাবধি দেহের কাছাকাছি এনে ছেড়ে দেয়। আর আমরা প্রেমের চূড়ান্ত তাৎপর্যে বোধ উন্মোচন করি, পূণ্যবাণ হয়ে উঠি:
তোমাকে ছুঁয়ে দিয়ে বুঝলাম, প্রেমময় আমি, পূণ্যের যথার্থ মানব।
আবারও এসো; মনে পড়ছে অনেক কথা; গাছের আঁচলে বসে আছে নামহীন
পাখি।
(চিরায়ত)
এই নামহীন পাখি ও মনে পড়া অনেক কথার মধ্য দিয়ে কবি পাঠকের সামনে যে দৃশ্যকল্প উপস্থাপন করেছেন, সেখানে কবির বুক হয়ে উঠেছে অনিবার্য নদী, নদীতে প্রেমিকার স্তন ও স্তন গলে সুধারূপ শিশির ঝরে কবির বুককে অস্থির করে তুলেছে। আর এই অস্থিরতা সামাজিক আলাপে খুব সহজেই ফেলে দেয় নাস্তিকতার কাতারে। তাতে অবশ্য কবির কিছু যায় আসে না, তার আগেই কবি তাঁর বোধি-সত্তায় হয়ে উঠেছেন ‘পূণ্যের যথার্থ মানব।’ আর চিরায়ত প্রেম ও যৌনতা কবির মধ্য দিয়ে বের হয়ে এসেছে চিরায়ত দৃশ্যকল্প হয়ে। এবং শেষ পর্যন্ত এই সব দৃশ্যকল্পের মধ্য দিয়ে কবি ভোগপূর্ণ মৃত্যুকে স্বীকার করেছেন:
চিরায়ত এইসব ছবি; আমিও মরে যাবো একদিন, কোনো এক চিরায়ত
নাস্তিকের মতো।
(চিরায়ত)
প্রকৃত প্রস্তাবে কোনো ব্যক্তিই আর আস্তিক নয়, আস্তিকতার মাঝে পুষে রাখে চিরায়ত জৈব বিষ। অর্থাৎ আমরা প্রত্যেকেই ক্ষমতালোভী, সে ক্ষমতা প্রেম ও যৌনতার ক্ষমতা। অথচ আমরা এক একজন ঈশ্বরের বরপুত্র সেজে থাকতে পছন্দ করি। অথবা দেখাতে চাই আমাদের বোধ ও সৌন্দর্যের ভালো মানসিতাকে। শালবন, নদী, চাঁদের আলোর নিচে আমরা এক একজন যার যার দেহ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছি; আর দেহ এক একটি অগ্নিপিণ্ড, সৌন্দর্য পোড়ানোর কারখানা। আমরা কবির আঙুলের ডগায় আমাদের বোধকে গলিয়ে দিয়ে মেনে নিতে বাধ্য হই এমন সহজ সত্যকে। যেভাবে কবি প্রকাশ করেছেন, সহজ ‘আয়ুচিহ্ন’ ও তার উন্মোচিত উৎসের আভাস:
পথে নেমে বুঝে গেছি
শালবন নদী আর চাঁদের আলোর নিচে
মাংসাশী প্রাণির মতো আমিও ক্ষমতালোভী।ক্ষুধা পেলে নেমে যাও দেহের গভীরে
খুঁজে আনো জাদুর তাবিজ
তাবিজের ভেতর লুকিয়ে রেখেছি আমি, আমার আয়ু।
(আয়ুচিহ্ন)
প্রকৃত প্রস্তাবে কবি আর এখানে কবিসত্তায় আবদ্ধ থাকেননি, ব্যক্তিসত্তায় উত্তীর্ণ হয়েছেন, যে ব্যক্তিসত্তা হতে পারে আপনার অথবা আমার এবং আমরা শেষাবধি ক্ষমতালোভী। আমরাই ক্ষুধা পেলে নেমে যাই দেহের গভীরে জাদুর তাবিজের সন্ধানে। আর তাবিজের ভেতর গুপ্ত রয়েছে আমাদের আয়ু। ক্ষুধা, দেহ, তাবিজ ও আয়ু বিশেষ শব্দগুলি আমাদের চিরায়ত জৈবিক তাড়নার কথা বলে, যেখানে জন্ম ও যৌনতা পাশাপাশি শুয়ে আছে মাতৃজঠরে, কবিতার মতো, আর মাতৃজঠর সৃজনশীলতার উৎস। তাই বহুমুখী উপস্থাপন কৌশলে মাতৃজঠর উঠে এসেছে কবির চেতনায়:
১.
অনন্ত অনন্ত আছি; উৎসমুখ, জননীর জরায়ু-আশ্রয়। [ভার্চুয়াল]
২.
মাতামহীর চুলের সুতোয় ফুটে আছে সময়।
আকাশে উড়তে দেখেছিলে শস্যশরীর; পাউরুটির টুকরো। [দুধবোন]
৩.
মাতৃদুগ্ধে জিভ রেখে বুঝে গেছি রমণীবিদ্যা; জন্মকিতাব।
[…]
মাতাকেই প্রেমিকা বলে জানি, মাতা মেহের-উন-নিসা। [জন্মকিতাব]
৪.
উপবাস ভেঙে জেগে উঠেছে শরীর
জন্মের প্রস্তুতি নিয়ে ফিরেছি আবার [জরায়ু]
৫.
মাতামহীর বুকের বলিরেখা ফুটে আছে শীতের শরীরে
বুদ্ধের সরলতা ঠোঁটে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে ধ্যানরমগ্ন শীত। [শীতঋতু]
গ্রন্থের নাম ‘কাব্যকথা কাকবিদ্যা’ বিশেষ তাৎপর্য নিয়ে উঠে এসেছে আমাদের সামনে। ‘কাক’ এখানে কামের প্রতীক। বিশেষ প্রতীকায়িত উৎসাহ স্বরূপ কবি গ্রন্থেও শুরুতেই উত্তর জনপদের লোকশ্লোকের কয়েকটি চরণকে আশ্রয় করেছেন:
পুব থেইক্যে এলো কাগা
বইসলো পশ্চিম ডালে গে
আবেলাতে ডাইকলো কাগা
কী আছে কপালে গে
উখুসুখু মাটি ফাটে খেতে নাহিক ধান
নদীমে নাহিক পানি কুথায় করবি চান…
উল্লিখিত পঙ্ক্তিগুলোতে কাক অশুভ সংকেত স্বরূপ উঠে এসেছে। পাশাপাশি এ অঞ্চলের মানুষের জীবন বাস্তবতাকে প্রতীক তাৎপর্যে উপস্থাপন করেছে। কাক অশুভ প্রতীকের পাশাপাশি এ অঞ্চলের মানুষের কাছে কামেরও প্রতীক, প্রেম ও যৌনতার প্রতীক। আর এই দিকটিই কবি আশ্রয় করেছেন তাঁর কবিতায় এবং চিরায়ত জীবনের সাথে মিশিয়ে অঙ্কন করেছেন ‘কামকণ্ঠ’, ‘কাকছবি’, ‘কালোপাখি’, ‘কাকদুপুর’, ‘কামনখ’, ‘কাকসন্ধ্যা’, ‘কাকশৈশব’, ‘কাকসংবাদ’। এসব নাম-কবিতায় মূলত প্রেম দিয়েছে যৌনতাকে প্রাণ; আর যৌনতা যুগিয়েছে রহস্যাবৃত কাছিমের খোলসের মতো সাহস। খোলস বাহ্যিক বর্ম, ভেতরে নরম হৃদয় ও বাসনা। কবির সে বাসনার ভাষা চুম্বন।
১.
জল-কাছিমের ঠোঁটের নিচে ফুটে উঠেছে চুম্বনচিহ্ন।
কাছিমের খোলসের মতো এগিয়ে যাচ্ছি আমি, তোমার দিকে। [মাঘসন্ধ্যা]
২.
শেষাবধি, চুম্বনই হতেপারে যোগাযোগের যথার্থ ভাষা। [যোগাযোগ]
বহুবাঞ্ছিতা প্রণয়িনী বিবসনা পাকা ডালিম। আর এ প্রণয়িনীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ক্ষুধার অন্ন, তৃষ্ণার জল, যৌন কামনার তৃপ্তি। যেন বা নারীর সৌন্দর্য জরায়ু উল্টানো কলস; সে সৌন্দর্য ক্ষিধে পেলে কাঁদে; ঋতুস্রাব কান্নার জল। যে জলে কবির ইন্দ্রিয়ে আগুন ধরে, কবিকে করে তুলে সমাজ বিচ্ছিন্ন। অথচ বিপরীতে কবির আছে একবুক প্রেম, নির্জলা প্রেম। ফলে কবি পেয়ে যায় বিষাদের পথে হাঁটার সাহস, চোখের কাঁচে ঠোঁট রাখার ক্ষমতা। যে নারী চুম্বনযোগ্য তার চোখ অশ্রুতে মলিন, মলিনতা কাচশুভ্রজল, যে জলে খুব সহজেই কবি গলিয়ে দিয়েছেন ঠোঁট।
চোখ থেকে গড়িয়ে নামছে কাচশুভ্রজল।
কাচের স্পর্শে কেটে যাচ্ছে ঠোঁট।
কত সহজে তোমার চোখের পাতায় রেখেছি চুম্বন
বিষাদের পথ ধরে পৌঁছে যাচ্ছি পূর্ণতার দিকে।
বিষাদ অর্থ, বেহেশতের বিরামহীন বিশ্রাম।
(পূর্ণতার দিকে)
তবে দিনান্তে কবিতার মতোই নিঃসঙ্গ কবি। কবিতার গভীরে সমুদ্রমন্থন করে যে কাব্যসুধা আহরণ করা যায়, তা তৃষ্ণা মেটায় না বরং তৃষ্ণাকে বাড়িয়ে দেয়; স্বর্গীয় অনুভূতির কাছাকাছি নিয়ে যায়। পাঠান্তেই পাঠকমনে কাব্যতৃষ্ণার রস উন্মোচিত হয়।
শিমুল মাহমুদের এ পর্যন্ত মোট ১১টি কাব্যগ্রন্থের প্রতিটিই পৃথক পৃথক ভাব-মাধুর্য নিয়ে প্রস্ফুটিত। শিমুল মাহমুদের কবিতার কৃৎকৌশল কোনো কষ্টকল্পিত আরোপিত ভাষান্তর থেকে উঠে আসেনি বরং তা কবির শ্বাসপ্রশ্বাসের মতোই বুকের গভীর থেকে উঠে আসা এক জাদুশক্তির প্রকাশ। ফলে পাঠকেরা অবচেতনে সেই জাদুমোহে সম্মোহিত হন। কবির স্বীকারোক্তি ‘প্রকৃত প্রস্তাবে সীমাবদ্ধ ভাষাশব্দের ব্যবহারকে অস্বীকার করে অজস্র অব্যবহৃত শব্দের সম্ভাবনাকে জাগিয়ে দিতে গিয়ে যে নবতর উপমার জন্ম হয়, তার মধ্য দিয়ে আমার ভাষাপ্রকাশ আমাকে আর সবার থেকে পৃথক করে ফেলে; আর আমি এহেন পৃথকীকরণের সীমানায় হয়ে উঠি কবিমানব;’ ফলে খুব সহজেই কবিমানবের বুকের সাথে মিলিত হয় নক্ষত্রের শরীর। উপমার ফিউশন থেকেসৃজিত হয় গহীন রহস্য এবং যা শেষাবধি স্পষ্ট করে চূড়ান্ত অর্থে কবি এক নিঃসঙ্গ মানব। প্রকৃত প্রস্তাবে এই নিঃসঙ্গতা শিমুল মাহমুদকে চিহ্নিত করে পৃথক ভাষাশিল্পীতে; যার কোনো পূর্বপুরুষ নেই অথবা থাকা সম্ভব নয় কোনো উত্তরপুরুষ। এক্ষেত্রে শিমুল মাহমুদ একক ও নির্দিষ্ট। কেননা কবির আঙুল গলে যে রক্তরঙের নিঃসরণ, তাতে আঁকা হয়ে যায় নিঃস্ব বিকেলের গল্প। মোমের আগুনে আঙুল গলে চুঁইয়ে পড়া রক্তে আঁকা হয়ে যায় নিঃস্ব বিকেল।
নক্ষত্রের বুকের সাথে বুক ছুঁইয়ে শুয়ে আছি আমি।
হাতের আঙুল গলে চুইয়ে নামছে রঙ।
হয়তো পালক-রহস্য আঁকবে ভেবে
এঁকেছিলে নিঃস্ব বিকেল।
(অনুভব)
শিমুল মাহমুদের কাব্যের মধ্যে একটি বিশেষ যোগসূত্র ও প্রবণতা লক্ষ করা যায়, তা হলো তার স্বতন্ত্র শব্দসৃজনকৌশল। এখানেই কবি আর সবার থেকে আলাদা। আর এই স্বাতন্ত্র্যের মূলে রয়েছে তাঁর অর্জিত অভিজ্ঞতা এবং বিশাল কবিতার জগৎ ও বোধ-বিশ্লেষণের ক্ষমতা। যেমন আমরা আলোচিত কাব্যগ্রন্থের নামের ভাব ও তাৎপর্যের সঙ্গে মিল রেখে কাক, কাম, চন্দ্রকার স্তন, আপেল, ডালিম, মাতৃজঠর, শস্য, পাতাল, ঘুম, ঘাম, চুম্বন, লাটিম, মার্বেল, সাপ প্রভৃতি শব্দের সাক্ষাৎ পেয়ে যাই। যে বিশেষ শব্দগুলো মিলনের কথা বলে এবং আমাদের জানিয়ে দেয় মিলনের মহার্ঘ্যতা বিষয়ে এক অলৌকিক সুসমাচারের কথা। কবির ভাষায়:
মিলে যাওয়াই চূড়ান্ত সত্য। এই কথা সত্য জেনে জড়িয়ে ধরেছি চাঁদ।
লজ্জা থেকে জেগে ওঠা লাজুক পরী! চন্দ্রমায়া।দুপুরের গায়ে হেলান দিয়ে দেখছিলাম তোমাকে
হাতের তালুতে রেখেছো, ঘুরতে থাকা জাদুর লাটিম।
(জাদুর লাটিম)
এই মিলনের অবিসম্ভাবী পরিণাম হলো বিচ্ছেদ, যা কবির মনে গভীর শূন্যতা বোধের সৃষ্টি করে। আর এই শূন্যতা বোধের কারণে কবিতায় লক্ষ করা যায় কবির ইন্দ্রিয়গভীর উপস্থাপন। যা আদিম আবেগ ও বাস্তবতাকে প্রকাশ করে শিল্পের ভাষায়। দুঃখ ও বাস্তবতার কথা ইতঃপূর্বে বহু কবিই বলে গেছেন এবং বলছেন। কিন্তু দুঃখ ও বাস্তবঘনিষ্ঠ উপস্থাপন এবং প্রেম ও যৌনতার মিশ্রণ কেবল কবি শিমুল মাহমুদেই সম্ভব হয়ে উঠেছে পুরোপুরি পৃথক মাত্রায় ও অনুভবে।
পাকা শস্যের শরীরে লুকিয়ে আছে দুঃখ
হাটে হাটে বিক্রি হচ্ছে শস্য
লুকিয়ে থাকা দুঃখ ওভাবেই থেকে যায়।দুঃখকে আড়ালে রেখে ডাকছে রাতপাখি
তোমার বুকজুড়ে, সুগন্ধি তাবিজের সুবাস।
(তাবিজ)
প্রকৃত প্রস্তাবে প্রতিটি চমৎকার মানুষের ভেতরে বাস করে জৈবিক ও জান্তবক্ষুধা। এই জান্তব ক্ষুধার কাছে প্রেম, বাজার ও মুদ্রা কোনটি মুখ্য? শেষাবধি যৌনতায় যদি প্রেম না থাকে তবে তার পরিণতি কী? এই প্রশ্নের যথার্থ উপস্থাপন লক্ষ করা যায় তাঁর কবিতায়। ভুল পাত্রে মূল আকাঙ্ক্ষার খোঁজ কোনো সার্থকতা বয়ে আনে না। সুন্দরের বাস্তব উপস্থাপনের ভেতরই লুকিয়ে থাকে সুন্দরের সারার্থ। যদিও এই সারার্থ অপেক্ষা অধিক সত্যপ্রেম নয় বরং মূল্যবান মুদ্রাই অধিক যৌক্তিক। আর যৌনতা? এ কথা অপ্রিয় হলেও সত্য, সমাজ-বাস্তবতার নিরিখে মুদ্রার আরও এক শৈল্পিক প্রকাশ যৌনতা, যার সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে ইচ্ছুক প্রেম ও কাম।
১.
নীলকণ্ঠী পাখিদের পাড়ায় বেহুলা নামের একজন সুন্দরী বেশ্যা থাকে।
প্রকৃত পরিচয় বুঝতে চেয়ে বহুরাত কাটিয়েছি তার সাথে, তার ডালিমগৃহে।
বেহুলার চোখে দেখিনি কোনদিন কোন সামাজিক বেদনা। অযথা খুঁজেছি
তার দেহের ভেতর লুকিয়ে থাকা জীবনবাবুর ধূসর কবিতা।
শেষদিনের কথা বলছি, সেইদিন কোজাগরি রাত, লক্ষ্মীচাঁদের মোহ;
সেইরাতে বেহুলা বহুজনের একজন ভেবে আমাকেও ঠেলে দিয়ে
হারিকেনের খসখসে আলোয় গুনে নিয়েছিল ধূসর কাগজের অসভ্য মুদ্রা।
(বেহুলা)
২.
দুইজন যৌনকর্মী রেললাইনের ওপর কান পেতে বুঝতে চেষ্টা করছে
কখন আসবে সান্তাহারগামী ট্রেন।তলপেটে আগুনের থাবা; ঘোড়াপুরুষ হারামির বাচ্চা।
(পাঁচবিবি রেলস্টেশন)
৩.
সিনেমার পোস্টারে স্নানরত নারীর দেহের দিকে তাকিয়ে আছেন
যৌনতাবিহীন রাতজীবী যৌনকর্মী।
অথচ সামাজিকগণ
ঋতুসবুজ যৌনতাকেই সুন্দর বলে জেনেছেন এতকাল।
(যৌনকর্মী)
যৌনকর্মী অথচ ‘যৌনতাবিহীন’ শব্দব্যঞ্জনা পাঠককে হোচট খাওয়াতে বাধ্য। সিনেমার পোস্টার, স্নানরত নারীর দেহ, সামাজিকগণ ও তাদের ঋতুসবুজ যৌনতামুখর সৌন্দর্যকে মুহূর্তেই থমকে দেয় ‘রাতজীবী’ শব্দ। আর তখন কবিতা কেবল একটি বাক্যে আটকে থাকে না, বরং তা হয়ে ওঠে একটি নির্বাচিত শব্দকেন্দ্রিক মুক্ত-কবিতা। এক্ষেত্রে কবিতার প্রাত্যহিকতাকে তথা দৈনিকতানির্ভর বাংলা ভাষার প্রথাগত প্রকরণকে অস্বীকার করেছেন কবি। দৈনন্দিন ঘটে যাওয়া ঘটনার উপস্থিতি কবিতাকে ক্লিশে করে তোলে। যদিও অনিবার্য জীবন-যাপনের এই ম্লান প্রাত্যহিকতা কবিতায় প্রতিনিয়ত প্রবেশ করে; কিন্তু এই অনুপ্রবেশ অধিকাংশ কবির কবিতায় জন্ম দেয় রুগ্ণতা; যা কবিতার শৈলীকে করে তোলে হলুদ, রোগাক্রান্ত। অথচ শিমুল মাহমুদের কবিতায় এই প্রাত্যহিকতা হয়ে ওঠে কবিতাশৈলীর অনিবার্য ক্ষরণ। যেভাবে আমরা দেখে অভ্যস্থ নই, নই ক্রমপ্রসারণ বোধের নির্দিষ্ট মাত্রার বাইরে গিয়ে পাখা বিস্তার করতে, কবি ঠিক সেভাবে নয় বরং কবি পাঠকের অভ্যস্থতাকে ফাঁকি দিয়ে প্রাত্যহিকতা থেকে তুলে নিয়ে আনেন এমন এক কবিতার আবহ যা বস্তু ও শব্দের মর্মার্থকে নতুন মাত্রায় ক্রমশ মুক্ত করে তোলে।
সুতরাং আমরা পাঠকরা কবির কামবিদ্যা আক্রান্ত কাব্যমন্ত্রের ভেতর ক্রমশ অনুভব করতে থাকি মানবচেতনার মনোদৈহিক সংকট। এই সংকটের পথ ধরে কবি বিষাদ ও গ্লানীর চূড়ান্ত রূপ এঁকেছেন নিঃসঙ্গ দীর্ঘ ছাটবিহীন কেশসজ্জার অন্ধকারে, অথচ অথই-অতল।অন্তরঙ্গ দীর্ঘশ্বাসের মতো ছাটবিহীন চুল। মৃত্যু ও আয়ুর মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে কবি চেখে দেখেছেন উভয় অনুভূতির নির্যাস। যে নির্যাসের নাম বিষাদ; আর এই বিষাদ কবিকে ক্রমশ এগিয়ে নিয়েছে পূর্ণতার দিকে।
হাসপাতালের বেডশিট দুমড়ে উঠে এলে তুমি।
কী ভয়ানক নিঃসঙ্গ তোমার দীর্ঘ ছাটবিহীন চুল।
আমি পাঠ করছি বিষাদ; আয়ু ও মৃত্যুর পার্থক্যরেখা।হতে পারতো ‘বিষাদ’ একটি পাখির নাম।
(বিষাদ)
এভাবেই কবি হেঁটে গেছেন, হাঁটছেন বিষাদের পথে, পা গলিয়ে দিয়েছেন অন্ধকার জুতোর ভেতর। ‘অন্ধকার’ এখানে সময়ের প্রতীক এবং জীবনের চূড়ান্ত বাস্তবতাই হলো অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাওয়া।জীবনদর্শনের পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ করেছেন কবি চার লাইনের মাঝে, এক শব্দের মধ্য দিয়ে। মানুষ চাইলেও কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না। আর কবিদের আকাঙ্ক্ষা তো কখনোই পূর্ণ হওয়ার নয়। কারণ কবির ইন্দ্রিয় নিয়ত পরিবর্তনশীল।
১.
জুতোর ভেতর জমাট অন্ধকার।
অন্ধকারের ভেতর গলিয়ে দিয়েছি পা।
অন্ধকার ভর্তি জুতো
কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমাকে!
(অন্ধকার ভর্তি জুতো)
২.
মানুষের দিকেই তো হাঁটছি;
স্পর্শ করেছি কামনার বীজ।
জুতো থেকে ক্ষয়ে গেছে মায়া;
জুতো ভর্তি সময়সহ হাঁটছি
যেতে পারছি না, তোমার কাছে।
(গন্তব্য)
শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয় না গন্তব্যে; গন্তব্যহীন ও নিঃসীম জার্নিই জীবন। আর গন্তব্যহীন পথে পরিচয় হয়ে যায় মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের স্তরসমূহের সঙ্গেও। মানব জীবনের চূড়ান্ত প্রকাশ প্রেম ও যৌনতার সঙ্গে। শরীরের অনিবার্য আকাঙ্ক্ষা যৌনতা; এই আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মানুষ যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে প্রেমকে। মূলত এখানেই রয়েছে সেই লুক্কায়িত রহস্য; যে রহস্যের কারণেই আমরা ক্রমশ পশুস্তর থেকে মানব স্তরের দিকে যাত্রা অব্যাহত রেখেছি। এই অব্যাহত যাত্রাপথে অর্থাৎ এই যুক্তকৃত অনিবার্য প্রেমের সঙ্গে শিমুল মাহমুদ তাঁর ‘কাব্যকথা কাকবিদ্যা’কে সংযুক্ত করেছেন। এই সংযুক্তিতে কবি নিজেই জাদুকর, জাদুশিল্পী। এক্ষেত্রে কবি পরিষ্কার জানেন, শারীরী অভিজ্ঞতার আরেক নাম যৌনতা; আর এই যৌনতা তখনই ক্রমশ হয়ে ওঠে শিল্প, হয়ে ওঠে কবিতা, যখন সেই জান্তব অভিজ্ঞতায় এসে সংযুক্ত হয় প্রেম। সুতরাং কবি ‘কাব্যকথা কাকবিদ্যা’র ভূমিকা কথনে বলতে বাধ্য হয়েছেন,‘এই প্রেম ও যৌনতার নামই কবিতা’। মানববৈশিষ্ট্যের এই চূড়ান্ত দিকটিকেই কবি তাঁর এ কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। সুতরাং তাঁর কবিতায় একদিকে যেমন পাওয়া যায় আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন; স্বপ্ন ও গতি; অন্যদিকে অনিবার্যভাবে পাওয়া যায় বিষাদ ও বিতৃষ্ণা; কামোন্মাদনা ও কামদ্রোহ। যা চূড়ান্ত অর্থে জীবনবাদী স্নায়ুনির্ভর ইন্দ্রিয়বিলাস; যে বিলাসের যাত্রা ভারতীয় দর্শনের চার্বাকদের সীমানায়। আক্ষরিক অর্থে যে সীমানা শেষাবধি মানবপ্রজাতির বেঁচে থাকার অনিবার্যতার প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে থাকে। মানবচেতনায় জীবনমুখী এই অনিবার্য ইন্দ্রিয়বিলাসের নাম ‘কাব্যকথা কাকবিদ্যা’।