তৃতীয় পর্বের পর:
হ্যালো ফ্রেন্ডস, আপনারা ভালো করেই বুঝতে পারছেন, আপনাদের এভাবে হাত-চোখ বেঁধে রাখার বিষয়টা কষ্ট দেওয়ারই একটি অংশ। যদিও আপনি মানে আপনারা সমাজের তথাকথিত সম্মানী মানুষ। বিশেষ করে মি. প্রফেসরতো…যাই হোক, আমাদের কাছে অবশ্য সে সবের দাম নেই। কারণ রাষ্ট্রদ্রোহিতা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।
নারী কণ্ঠস্বরটা সখেদে প্রশ্ন করে-কেনে এই শাস্তি? আমাদের অপরাধ কী? ওর কথা শুনে বুট জুতা ঠকঠক আওয়াজটা হেসে উঠলো। আমি কণ্ঠস্বরটার অবস্থান বোঝার চেষ্টা করলাম। ঘরে যেন একটা তামাকের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে।
তামাকের গন্ধে নাক কুঁচকানোর কিছু নেই মি. প্রফেসর। আমরা জানি আপনি নিজেও ধূমপান করেন। যদিও আপনাকে এই মুহূর্তে আমি কোনো সিগারেট অফার করতে পারছি না। একটু আগেই ওই মেয়েটিকে আপনি বলছিলেন, পানি খাবেন। হ্যাঁ, আমি পানি খেতে চাই। আর এনাফ ইজ এনাফ। আমার হাত ও চোখ খুলে দেওয়া হোক।
চোখ বাঁধা থাকায় আপনার অবশ্য দেখার কথা নয়। আপনার সামনেই একটা টেবিলে কাঁচের জগে ঠাণ্ডা পানি রাখা আছে। জগের ভেতর ফেলা হয়েছে খণ্ড-খণ্ড বরফ কুচি। আর সেজন্যই হয়তো জগের গায়ে ফোটা ফোটা জলীয় বাষ্প জমেছে। প্রচণ্ড তৃষ্ণায় এমন এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি সবারই কাম্য, তাই না মিস, সরি মিসেস…।
আমি কোনো উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলাম না। মুখের ভেতর সত্যিই জিহ্বাটা খটখটে শুকনো হয়ে আছে। বুটজুতোর কণ্ঠস্বরটা আবার বলে চলে- আমরা জানি আপনারা দু’জন অত্যন্ত তৃষ্ণার্ত। বিশেষ করে এই অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটি। কিন্তু কী আর করা, শাস্তিতো কখনো আরামের হয় না। তবে হ্যাঁ, সামনে পানযোগ্য জল রেখে তা গ্রহণ করতে না পারাটা সত্যি দুঃখজনক। আমি শরীরটাকে নাড়ানোর চেষ্টা করি। আমার হাত আর চোখ খুলে দেওয়া হোক। তারপর আমি তোমাদের সঙ্গে কথা বলব।
দুঃখিত প্রফেসর,সেটা সম্ভব নয়। ক্যাফেতে যখন আপনি আপনার বন্ধুর সঙ্গে গণতন্ত্র নিয়ে আলাপ করছিলেন, তখনো সুর্যের আলো অবশিষ্ট ছিল। আর এই মিসেস, ঘরের সামনে লনে বসে পেটের সন্তানকে নিয়ে যে রোদ পোহাচ্ছিলেন, দুটোই ছিল আপনাদের দেখা শেষ সুর্যের আলো। মানে? তোমরা কি আমাদের মেরে ফেলতে চাও!
আসলে আপনাদের আমরা মেরে ফেলতে চাই না। জানেন তো, মেরে ফেলা কথাটার ব্যপ্তিটা খুব ক্ষুদ্র। যেমন ইচ্ছে হলো, একটা পিঁপড়েকে আঙুল দিয়ে পিষে মেরে ফেল্লাম। অথবা প্রেমে ব্যর্থতার জ্বালা ভুলতে ক্রোধে অন্ধ হয়ে কেউ আপনার কণ্ঠনালীটা ফাঁক করে দিলো। মানে, এসবে এখন আর কোনও আনন্দ বা চমক নেই। মেরে ফেল্লেইতো মরে যাবেন। আফটার অল ম্যান ইজ মরটাল। তারচেয়ে বলা ভালো, আপনাদের আমরা হত্যা করতে চাই। খুব ধীরে ধীরে, তিলে তিলে আর শৈল্পিকভাবে। অ্যাকচুয়ালি, কিলিং ইজ নাও অলসো অ্যা আর্ট। আর সেই আর্টটাই আমরা আপনাদের দেখাতে চাই।
মেয়ে কণ্ঠটির ঝাঁঝালো শব্দ শোনা যায়- আমাদের অপরাধ? ওহ, মিসেস, আপনাদের আসলে কোনোও অপরাধ নেই। যদি না সেলফ কন্সপারেসি কোনো ধরনের অপরাধের মধ্যে পড়ে। অনাগত সন্তানকে মুক্তিকামী গান শুনিয়ে আদর করাটা অপরাধ নয়। যদি না এরমধ্যেই লুকিয়ে থাকে ভবিষ্যতে আর ক’টা দিন সবুর করার রসুনবোনার ষড়যন্ত্র, হা হা। আপনার পেটের ভ্রূণটা যে সেই জিনটাই বহন করে পৃথিবীতে আসবে, সে খেয়াল আছে? ও হ্যাঁ মিস্টার প্রফেসর, দুই সপ্তাহ আগে গণতন্ত্র বিষয়ে আপনার একটা লেখা আমরা দৈনিক পত্রিকায় পড়েছি। বেশ ভারী, তথ্যবহুল আর বুদ্ধিদীপ্ত ছিল সেটি।
তাহলে কি এর জন্যই আমাকে ধরে আনা হয়েছে? তবে ওই কলামটাতে আমি যা লিখেছি, তা শতভাগ বিশ্বাস থেকেই উদ্ভূত। ইউ অল আর ব্লাডি স্টুপিড প্রোটেকটর অব দিস রাবিশ ডেমোক্রেসি। দিস সিস্টেম ইজ ফুল অব ফ্যাসিনিজম ইন আন্ডারকভার অব ডেমোক্রেসি।
আমার উত্তেজিত কণ্ঠ শুনে মেয়ে কণ্ঠটা খিলখিল করে হাসতে থাকে। ওর হাসির মধ্যে কোথায় যেন একটা তাচ্ছিল্যের তীর তাক করা ছিল। রিনরিন টংকার তুলে ওটা ঠিক এসে বিঁধলো আমার মাথায়। আমি ধমকে উঠলাম-স্টপ, স্টপ ইট। অথচ মেয়ে কণ্ঠটির হাসি চলতেই থাকে। সেইসঙ্গে ঠকঠক বুটের আওয়াজটাও যেন পায়চারি শুরু করলো সারা ঘরে। তামাকের গন্ধটাও ঢেউয়ের মতো কখনো কাছে কখনো দূরে সরতে লাগলো। মেয়ে কণ্ঠটা হাসতে হাসতেই যেন গজরাতে গজরাতে থুতু ফেলে বললো- আপনাকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে হে প্রফেসর। আমার অনাগত সন্তানকে আপনাদের মুরদের কথা শুনিয়েছি। তাতেই ও বেশ মজা পেয়েছে। মেয়েটা আবার শব্দ করে থুতু ফেলে, হিপোক্রেট। বুটের আওয়াজ আর তামাকের গন্ধটা যেন আবার এগিয়ে আসে।
দু’জনের কথা শুনছিলাম আর তাতে অনাগত শিশুটির মতো আমিও আনন্দ পেয়েছি। একদিকে তত্ত্ব আর অন্যদিকে প্রত্যক্ষ প্রস্তুতি। হা হা, কিন্তু মতপার্থক্যটা এতই গভীর যে, দেখতে হলে দূরবীন লাগাতে হয়। অবশ্য মিস্টার প্রফেসর, আপনার কথাগুলো সত্যিই দারুণ এবং বেশ প্রভাবক। শিক্ষক হিসেবে বেশ গুছিয়ে কথা বলেন আপনি। সো, লেটস টেল আস হোয়াট ইজ ইয়োর অ্যাকচুয়াল সে অ্যাবাউট ডেমোক্রেসি?
সুযোগ পেয়ে এবার আমি খানিকটা হেসে নিলাম। বুলে যাবেন না, আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক। আর আপনি আমার কাছে জানতে চাইছেন গণতন্ত্রের সংজ্ঞা! কারণ আপনার কথা অনুযায়ী আমাদের শাসনে গণতন্ত্র অনুপস্থিত। তাই আপনার মুখ থেকেই আসলে রিয়েল ডেমোক্রেসির সংজ্ঞাটা শুনতে চাইছিলাম।
সম্পূর্ণ বিনা কারণে, সামাণ্যতম ইঙ্গিত না দিয়ে আমাকে এখানে ধরে এনেছেন। হাত-পা বেঁধে ফেলে রেখে আচরণ করছেন জন্তুর মতো। পাশে একটি গর্ভবতী নারীকেও একই কায়দায় নির্যাতন করছেন। তারপরেও বলতে চান, আপনারা যে ব্যবস্থা লালন করছেন এর নাম গণতন্ত্র! হঠাৎ পেটের মধ্যে তীব্র একটা লাথি খেয়ে আমি চেয়ার নিয়ে উল্টে পড়লাম। মেয়ে কণ্ঠটির অস্ফুট চিৎকার শোনা গেলো। ততক্ষণে মেঝের সঙ্গে মাথাটা ঠুকে গেছে ভীষণভাবে। একটা অবাধ্য যন্ত্রণার ঢেউ যে গ্রাস করলো আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে।
চলবে…