অষ্টম পর্বের পর:
স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার কথা বলছিলাম—তখন ষষ্ঠ কি সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। নতুন পৃথিবী, নতুন চোখ। নতুন উপলব্ধি, নতুন বোধ। কিন্তু চারপাশের সব কেমন যেন নোংরা-বাজে-বিচ্ছিরি। যে গলিটা দিয়ে স্কুলে যাই, তারই দুই পাশে সারি-সারি বাড়ি। লম্বা সর্পিল গলি। আর তাই গলির আশেপাশে যে ছেলেগুলো ঘুরে বেড়ায়, তাদেরও আমার তেমনি নোংরা মনে হয়। সে গলি পার হয়ে মেইন রোডে উঠেই লোক চলাচলের সন্ধান পাওয়া যায়। আমার লালমাইয়ে ফেলে আসা পায়ের কাছের সেই অবারিত সবুজ আর দিগন্ত বিস্তৃত পায়ে হেঁটে স্কুলে যাওয়ার পথ থেকে এ যে অনেক দূর, আর কত যে সংকীর্ণ, তা কী করে বোঝাই! যেন এক দমবন্ধ দীর্ঘ পথ। শেষই হয় না। সেদিন ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল। আমার ঠিক মনে পড়ছে এখন—আমি বোধ করি বৃষ্টি দেখেই একটা রিকশা নিয়েছিলাম। বাড়ি থেকে স্কুল বেশ দূর।
ছুটি হয়েছে বিকেল চারটেয়। রিকশায় ওঠার পর বৃষ্টি বাড়তে-বাড়তে মুষলধারে। ছোট্ট মানুষ আমি। এক হাতে স্কুলের ব্যাগ, এক হাতে রিকশার পর্দা। কোনটা ধরতে কোনটা ছাড়ি—এই অবস্থা। এছাড়া লালমাইয়ের কোলের কাছে যখন স্কুলে যেতাম, সে কলোনিতে হঠাৎ দূরাগত কেউ রিকশা নিয়ে না ঢুকলে স্কুলে যাওয়ার পথে কোনোদিনই রিকশা পাওয়াই যেত না। আমরা বৃষ্টিতে রঙ-বেরঙের ছাতা নিয়ে চলতে অভ্যস্ত। সেদিন মুষলধারে বৃষ্টিতে আকাশ অন্ধকার। দিনের শেষটা মনে হচ্ছে যেন প্রায় রাত হয়ে এসেছে। সত্যি-সত্যি একটু ভয়-ভয় করছে অজানা কারণেই। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই বোধ করি সন্ধ্যা হয়! প্রায় বাসার কাছে পৌঁছে গেছি। তখন দেখি হঠাৎই নিঝুম এই গলিটাতে চারপাশের বাড়িগুলোর সব জানালা বন্ধ। অথচ অন্য দিনগুলোয় এসব জানালা খোলাই থাকে। ভেতরে লোকজনের শব্দ পাওয়া যায়। আজ পুরো গলিটা ভীষণ নিস্তব্ধ। বৃষ্টির এমন দারুণ শব্দ। আমি একমনে ভাবছিলাম—এমন বৃষ্টির দিনে পাহাড়ের গা বেয়ে জলের ধারা কেমন করে এসে গড়িয়ে পড়তো আমার পায়ের কাছে। আমি জল ঠেলে-ঠেলে ঘাসে পা ডুবিয়ে-ডুবিয়ে ছলছল শব্দ তুলে-তুলে স্কুলে যেতাম আর বাড়ি ফিরতাম। জলের সঙ্গে প্রগাঢ় এই বাঁধন আমার চিরকালের। এমনই ঝুম বৃষ্টিতে আমি পুকুরে জলের তলায় টুপ করে ডুব দিয়ে কান পেতে থাকতাম—জলের ওপরে বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ কেমন লাগে, তা শোনার জন্য। বৃষ্টি শুরু হয়েছে দেখলেই কলোনির ছেলেমেয়েরা পুকুরে ছুটতাম।
আজ ঠিক এমনই বৃষ্টির দিনে খুব মন ভার। ঠিক এমনি সময়—বাড়ি পৌঁছুতে আর কয়েক মিনিট হয়তো বাকি। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ একজন রিকশার পেছনের খোলা অংশটার ভেতর দিয়ে আমাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো। এখনো স্পষ্ট মনে আছে—রোমশ হাতের ছায়াটি। আমি কিছু না বুঝেই ওই হাতে একটা খামচি বসিয়ে দিয়ে ‘মা’ বলে একটা চিৎকার দিলাম। সঙ্গে-সঙ্গে হাতটি আমাকে ছেড়ে দিয়ে হারিয়ে গেল। চারপাশের দেয়ালে আমার চিৎকার প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসতে লাগলো আবার আমারই কানে। কেউ শুনলো না। রিকশাঅলা পেছনে একবার তাকিয়েই দৌড় দিলো। আমি তখন আরও ভীত হয়ে চিৎকার করতে লাগলাম—‘প্লিজ আপনি যাবেন না, প্লিজ আপনি যাবেন না।’ কে শোনে কার কথা! রিকশাঅলা দৌড়ে চলে যেতে-যেতে বললো—‘আপা, আপনে বসেন। ওই কুত্তার বাচ্চারে আমি ধইরা আনতাছি এহনি।’ আমি দুরুদুরু বুকে বসে আছি। ঝুম বৃষ্টি। আকাশ অন্ধকার। মনে ভয়। এখন রিকশাঅলাও নেই। যদি আবার কেউ আসে! আমি রিকশা থেকে নেমে দৌড় দেব কি না, ভাবছি। আর যখন ভেবেইছি দৌড়াব, তার কিছু্ক্ষণ বাদেই রিকশাঅলা ফিরে এলো—‘নাহ। পাইলাম না। এত্ত তাড়াতাড়ি কই গেল! এই গলি পার হইতে হইলেও তো তার ছায়া দেখতে পাইতাম। বুঝা গেল না রে আফা। আর রিকশার পিছনে ওই হালা উইঠ্ঠা পড়ছিল কুনসম,একটুও তো টের পাইলাম না!’ তখন আমারও মনে হলো, সত্যিই তো। আমি তো হাতটা আমাকে ছাড়ানোর সঙ্গে-সঙ্গেই পেছনে তাকিয়েছিলাম। আমিও তো কোনো ছায়া পর্যন্ত দেখিনি!
আজও সেটা আমার কাছে এক বিস্ময় হয়ে আছে। আমি কোনোমতে বাড়ি পৌঁছেই কাঁদতে কাঁদতে মায়ের বুকে আছড়ে পড়লাম। কাঁদতে-কাঁদতেই সব কাহিনি বলতে লাগলাম। মা আমাকে গভীরভাবে বুকে ধরে রাখলেন কিছুক্ষণ, যতক্ষণ আমার ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কান্না না থামে। তারপর খুব ঠাণ্ডা ধীর স্বরে বললেন, স্কুল ড্রেস পাল্টে খেতে এসো। যেন কিছুই হয়নি। আর সত্যি সেদিন কিছুই হয়নি—মায়ের ভাবটিই যেন আমার নতুন—মাত্র বিকশিত হতে শুরু করা নারী শরীরে কিংবা নারী মনে এতটুকু কালো ছায়া ফেলেনি। আমার অতটুকু মনে কোনো ট্রমাও তৈরি হয়নি। আজ বুঝতে পারি।
মধ্যরাত। ঘুমাতে যাব। সেদিন মা আমাকে বুকের খুব কাছে ধরে রাখলেন। আর প্রথমবারের মতো জানালেন যে, আমি একজন মানুষ। একইসঙ্গে একজন নারীও। জানালেন, এই নারী জীবনের পথে-পথে কত-কত কাঁটা না চাইতেই এসে বিঁধে যাবে গায়ে। কিভাবে পার হতে হবে এই নারী জীবন? আজ যা হয়েছে, তার চেয়ে ভয়ঙ্কর আর কী কী হতে পারে, তার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে! কিন্তু সাহসের সঙ্গে কী করে পার হতে হবে এই পথ? আমি প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করলাম—মানবজীবনে আমারই শরীর একইসঙ্গে আমার শত্রু ও সম্পদ। তাকে রক্ষা করে চলতে হবে, একইসঙ্গে সার্থক করে তুলতে হবে মানবজীবন। এসব ভাবতে ভাবতে আর মানসিক প্রস্তুতি নিতে নিতে শুরু হলো আরেক নতুন পথচলা।
চলবে…
নারী: পর্ব-৮॥ শাপলা সপর্যিতা
নারী: পর্ব-৭ ॥ শাপলা সপর্যিতা
নারী: পর্ব-৬ ॥ শাপলা সপর্যিতা
নারী: পর্ব-৫॥ শাপলা সপর্যিতা
নারী: পর্ব-৪॥ শাপলা সপর্যিতা
নারী: পর্ব-৩॥ শাপলা সপর্যিতা
নারী: পর্ব-২॥ শাপলা সপর্যিতা
নারী: পর্ব-১ ॥ শাপলা সপর্যিতা