স্টেজে ভাইয়ের দুর্দান্ত আবৃত্তি শুনে-শুনে পত্রিকার পাতায় তার নাম দেখে-দেখে ভাবতে থাকি ঠিক তারই মতো হব। বড় হয়ে মনে-মনে তাই ঠিক করে ফেলি। তিনি লিখতেন স্পোর্টস বিষয়ে। খেলার প্রতিই তার দারুণ ঝোঁক ছোটবেলাতেই। লিখতেন তখনকার সব পত্রিকায়। ক্রীড়াজগত ছিল তার প্রিয় বিষয়। আর তার লেখা কবিতার খাতাটাও আমি চুপি-চুপি পড়তাম। বাসায় মা ইত্তেফাকের পাশাপাশি প্রায় সব ম্যাগাজিন রাখতেন। বেগম, কিশোর বাংলা, বিচিত্রা, সচিত্র বাংলাদেশ, চিত্রালী, পূর্বাণী সব। আমি একটু বড় হতেই এগুলো পড়তে থাকি। আর পেপারঅলার পেপার ছুড়ে মারার কৌশল দেখেও মুগ্ধ হই। বিশাল সেই কালোনিতে একজনই পেপারঅলা সাইকেলে চড়ে চড়ে পেপার দিতো। তিনতলা বিল্ডিং। দুই ইউনিট। মাঝখানে বিশাল সিঁড়ি। ব্রিটিশ আমলের সরকারি বাসায় আমাদের বাস। তিনতলায়। বিল্ডিংটার নিচে এসে সাইকেলটা থামাতো পেপারঅলা। ছোট একটা ফিতে দিয়ে গুটিয়ে বাঁধা পেপারটা ছুড়ে মারতো দোতলা তিনতলায়। আর কি অদ্ভুত! একবারও তার টার্গেট মিস হতো না। একবারেই চলে আসতো ওপরে আর পড়ে থাকতো বারান্দায়।
আমাদের চার ভাইবোনের মধ্যে তখন কাড়াকাড়ি পড়ে যেত পেপার নিয়ে। কিন্তু বুক শেলফে রাখা সব বই পড়া নিষেধ আমার তখন। লেইজার টাইমের পর যখন বাবা অফিসে, বড় ভাইয়েরা আর আপা স্কুলে। মা তখন ঘুমাতেন। আর আমি চুপি চুপি উঠে গিয়ে লুকিয়ে বই খুঁজে বের করতাম। ওই বুক শেলফের পাশেই ফ্লোরে একটা কোণায় বসে পড়তাম। লুকিয়ে বই পড়তাম। মা হঠাৎ উঠে এদিকে এলেও যেন আমাকে দেখতে দেখতে বইটা অন্তত লুকিয়ে ফেলতে পারি। ওই চিপায় বসেই প্রথম পড়ি দীপু নাম্বার টু। কিশোর বাংলায়। ওখানে বসেই চুপি চুপি পড়ি কপোট্রনিক সুখ-দুঃখ। চুপি চুপি পড়ে ফেলি শরতের দেবদাস। দেবদাস পড়তে পড়তে পার্বতীর জন্য খুব কাঁদতাম। খুব কাঁদতাম শেষে দেবদাসের জন্যও। বুকের ভেতর কেমন মোচড়াতো আমার। বইটা শেষ করার পর কতদিন আমার একদম ভালো লাগতো না কিছুই। কেন এমন হয়, কেনই বা এমন হবে? এই ভাবতে ভাবতে লালমাইয়ের চূড়ায় সূর্য ডুবতো প্রতি সন্ধ্যায়। আকাশের লাল কত সুন্দর হতে পারে, তা আমি দেখেছি সেই পাহাড়ের কোলেই। আবিরের রং কতটা ঘন, কতটা বুকের কাছে বাস করে, তার ধ্যান আমার সেই ছোটবেলাতে বন পাহাড়ের বুকের কাছে থেকেই।
প্রতি সন্ধ্যায় আমি যখন দীঘল ঘাসের মাঠে খেলা শেষ করে এসে দাঁড়াই ঝুল বারান্দায়, তখন বাদুর পাখা মেলে উড়ে যায়। সেই ঘন পেয়ারা বাগান থেকে যখন ফিরবে বাদুর, তখন তার দারুণ মরণফাঁদ আমারই সামনে ঝুলছে। তবু ভোরবেলা ওই বারান্দায় দাঁড়াতেই দেখতাম ইলেকট্রিসিটির তারে ঝুলানো বাদুরের মৃতদেহ। মন কেমন করে উঠতো আমার। বাদুরের চোখে তখনো মনে হতো জীবন ভাসছে। মরেনি যেন। আমারই দিকে চেয়ে আছে ডানা মেলে দিয়ে ইলেকট্রিসিটির তারে। প্রিয় বাদুরের মৃতদেহ আজও চোখে ভাসে। বুকের ভেতর জমাট বাঁধে দারুণ যাতনা এখনো। মধ্যরাতে ঝরে পড়া সাদা শিউলীর সৌন্দর্য নিয়ে যেদিন সাজেনি আমার সকাল, সেদিন একটু দেরি হয়েছে ঘুম তেকে উঠতে। নিচে উঁকি দিয়ে দেখি শূন্য পড়ে আছে পথ। কেউ আগেই নিয়ে গেছে সব ফুল কুড়িয়ে। সেদিনও আমার বেদনাক্লিষ্ট সময় কাটতো। কিন্তু তখন বুঝিনি এমন করে আজ জেঁকে বসবে সেই প্রকৃতি আমার চির জীবনের প্রবাহে। লিখতে চেষ্টা করতাম তখন থেকেই। ভাইজানের স্পোর্টসের ওপর লেখাগুলো তখন পত্রিকার পাতায় খুব ছাপা হতো। আর ভাইজান তার পড়ার টেবিলের কাচের নিচে সেগুলোর কাটিং সাজিয়ে রাখতেন।
আমি ভাইজানের পড়ার টেবিলটায় বসেই সেগুলো দেখতাম আর ভাবতাম একদিন আমিও ঠিক এমন লিখব। ছাপা হবে পত্রিকার পাতায়। এমন করেই কালেকশনে রাখব সব। কিন্তু কী লিখব? কিভাবে লিখব? বুঝতে পারতাম না কিছুই। ভাইজান বলতেন ছড়া লেখো। আমি ছাপিয়ে দেব। আমি ছড়ার ছ’ও লিখতে পারতাম না। আমার বুকের ভেতর একটা চাপা বেদনা কেমন যেন তাড়িয়ে বেড়াতো। মনে হতো ওই বেদনা বুঝিবা গল্পেই লেখা সম্ভব। অন্য কোথাও নয়। কিন্তু কী সেই বেদনা? কচি সবুজ ধান ক্ষেতের মাঝখানে বসে থাকা বক যখন মাঝ ধরতো ঠোঁটে, তখন মাছটা বাঁচার জন্য ছটফট করতো। আমি তাকিয়ে থাকতাম ওই মাছটার দিকে। খুব কষ্ট হতো তখন আমার। বড় হয়ে যখন পড়েছি জীবনানন্দের ‘আট বছর আগে একদিন’ কবিতায়: ‘গলিত স্থবির ব্যাং আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে/ আরেকটি প্রভাতের ইশারায়- অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে’তখন আমার সেই সবুজ ধানক্ষেতের সকাল-সন্ধ্যা ফিরে এসেছে চিরায়ত বেদনা নিয়ে। সন্ধ্যায় মাঠের খেলা শেষে ঘরে ফিরেই দাঁড়িয়ে পড়তাম ঝুল বারান্দায়। পেছনে রক্তলাল পূরবী আসমান। তারই সামনে অটল পাহাড়। তারও সামনে ইলেকট্রিসিটির তারে অসংখ্য ফিঙে বসেছে। নিচে ঘন বন থেকে উঠে আসছে ছোট ছোট পোকা। উড়ে উড়ে গিয়ে ঠোঁটে করে নিয়ে আবার এসে বসছে তারে ফিঙেগুলো। এ ছিল প্রতি সন্ধ্যায় তাকিয়ে থাকার প্রিয় বিষয় আমার। তেমনি এক সন্ধ্যায় কে যেন এলো। ঘরে কড়া নাড়ে। দরজা খুলে দেই আমরাই। বাড়ির ছোট দু’তিনজন।
মিমি এসেছে? প্রশ্ন শুনে অবাক হয়ে তাকাই।
কে মিমি?
প্রশ্ন করতে করতে মা দৌড়ে আসেন।
কে মিমি?
মিমি কে?
কেউ চিনি না। অতবড় কলোনিতে কতজনকে আর চিনে রাখা যায়! বিকেলে মাঠে খেলতে নামি। যারা কাছাকাছি থাকি একসঙ্গে খেলি, তারাই শুধু একে অন্যকে চিনি। যারা দূরে থাকে, তাদের সঙ্গে কোনোদিনও দেখা হয় না। হলেও চেনাজানা হয় না খুব বেশি। মিমি নামটা মা চিনতে পারেন না। আমারও অচেনা লাগে। একজন নারী এসেছেন। মিমির খোঁজে। আপাদমস্তক বোরখায় ঢাকা পর্দানশীন এক নারী। শুধু চোখ দু’টো দেখা যায়। তিনিই প্রশ্ন করছেন। মিমির মা।
সকালে বেরিয়েছিল স্কুলে। আর ফেরেনি।
মা তাজ্জব বনে যান।
কোন ক্লাস পড়ে?
ওয়ানে।
কী কথা! কী কথা!! স্কুল ছুটি হয় সেই সকাল ১০ টায়। আর এখন বাজে সন্ধ্যে ছ’টা। এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? অত ছোট বাচ্চা একটা মেয়ে!
না না। আমি বসে থাকিনি। বিশ্বাস করুন।
মিমির মা’র কথায় কেমন যেন অপরাধীর সুর।
সারাদিন ধরেই খুঁজছি। কলোনির সবগুলো বিল্ডিং খুঁজতে খুঁজতে এত বেলা। কোথাও নেই। কারও ঘরেও নেই। কোনো খোঁজই পাচ্ছি না মেয়েটার।
দারুণ ধীর একজন নারী। ভীষণ শান্ত শব্দে এক নিঃশ্বাসে বলে যান কথাগুলো।
মিমির বাবা কোথায়?
তিনি জামাতে গেছেন।
তাকে খবর দিয়েছেন?
লোক পাঠিয়েছি। কাল ভোর নাগাদ খবর পেয়ে যাবেন।
বুঝে গেছেন এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলে সময় নষ্ট করা আর ঠিক হবে না। তিনি আর দেরি করেন না। শুধু তার যাওয়ার তড়িঘড়িতে হঠাৎ ছলকে ওঠে বুকের ভেতরের একটা চাপা শঙ্কা। আর কিছু নয়।
সেই সন্ধ্যায় আমি দৌড়ে এসে বেলকনিতে ঝুঁকে পড়ি। দেখি নিচে খুব দ্রুত গতিতে হেঁটে চলে যাচ্ছেন মিমির মা। ত্রস্ত। তার হাঁটার গতি জানিয়ে দেয় খুঁজতে থাকা সন্তানের জন্য কত শঙ্কা, কত ঝড় বয়ে যায় তার মনে। ওপরে তাকাতেই দেখি, অনেক চিল অধরা আকাশে কেমন মাতালের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে। আমার বুকের গভীরেও এক ভীষণ শূন্যতা টের পাই। সেখানে চিলগুলো আরও এক অজানা হারানোর সুর তীক্ষ্ণ ছুরির ফলার মতো গেঁথে দিয়ে ডেকে ওঠে চি…চি…চি…।
চলবে…