লেখালেখি বনাম সম্পর্কচর্চা
‘সাহিত্য শিশুর হাতের খেলনা নয়, গুরুর হাতের বেতও নয়’-প্রমথ চৌধুরীর কথাটা আজকাল মগজের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু যতই ঘুরপাক খাক, একটা ব্যাপার নিশ্চিত বলা যায়, বর্তমানে সাহিত্য মনে হয় শিশুর হাতের খেলনা আর গুরুর হাতের বেতেই রুপান্তরিত হয়ে গেছে। খেলনার মতোই সবাই ইচ্ছেমতো খেলছে। গুরুর বেত হাতে নিয়ে অযোগ্যরাও শাসন করছে। আর এই শাসনের মাপকাঠি এসেছে এক ধরনের সম্পর্কচর্চার মধ্য দিয়ে। সম্পর্ক ভালো তো আদর করো, সম্পর্ক খারাপ তো শাসন করো। মানে যাচ্ছেতাই ছাপিয়ে নাও। বগলদাবা করে সাহিত্যাঙ্গন দাপিয়ে বেড়াও। দেখবে তোমার প্রশংসায় অহেতুক পঞ্চমুখ তোমার স্বাবক মহাত্মাগণ।
সাহিত্যচর্চায় সম্পর্ক অবশ্যই দরকারি। তবে সে সম্পর্কটা হওয়া চাই সাহিত্যের সঙ্গে। সুসাহিত্যের সঙ্গে। সুসম্পাদকের সঙ্গে। সুসম্পাদক আর সুসাহিত্যিকের সঙ্গে সম্পর্কটা সবচেয়ে বেশি জরুরি। অথচ সম্পর্কটা গিলে খাচ্ছে ’জঘন্য সম্পাদক’ শ্রেণির সম্পর্কচর্চাকারী সার্থান্বেষীরা।
সাহিত্যের শিল্পগুণ আদৌ রক্ষিত হয়েছে কি হয়নি, এ নিয়ে সাহিত্য সম্পাদকের মাথাব্যথা আছে কি নেই; এ নিয়েও ভাবার সময় এসেছে। দৈনিকের সাহিত্যপাতার দিকে চোখ বোলালে অখাদ্য-কুখাদ্যও হজম করতে হয়। তবে কিছু পাতা অবশ্যই ব্যতিক্রম। সবচেয়ে বেশি বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে ছোটকাগজগুলো। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার মুক্তআঙিনা খ্যাত এ মাধ্যমটিও সম্পর্কের নিরিখে চলছে। এ কারণে দিনদিন তার সাহিত্যমূল্য হারাচ্ছে। এছাড়া পাক্ষিক, মাসিক, ষাণ্মাসিক বা বার্ষিকীতেও কু-সম্পর্কের ছড়াছড়ি।
অন্যদিকে প্রযুক্তির কল্যাণে অবাধ সম্পর্ক বিরাজ করছে অনলাইন ম্যাগাজিনগুলোতেও। কমখরচে প্রচারযোগ্য একটি ওয়েবজিন রাতারাতি সাহিত্যসভায় ব্যাপক হইচই তুলে দিতে পারে। ভুল বানান, ভুল বাক্যগঠন আর প্রলাপসর্বস্ব সবকিছুই আজ প্রকাশযোগ্য হয়ে উঠছে ওয়েবজিনের কল্যাণে। সম্পাদনা সম্পর্কে যার ন্যূনতম জ্ঞান বা ধারণা নেই- তিনিও সেজে বসে আছেন সম্পাদক! পাশাপাশি ইন্টারনেটের সুবাদে অনলাইন নিউজপোর্টালগুলোও গা ভাসানোর মতো দায়সারা গোছের সাহিত্য বিভাগ চালু রেখেছে- কেবল রাখতে হয় বলে। হাতেগোনা দুই একজনকে বাদ দিলে সেখানেও কোনো যোগ্য সাহিত্য সম্পাদক নেই। দশজনের হাত ধরেই উঠে যাচ্ছে গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ এমনকি আত্মপ্রচারসর্বস্ব কথামালাও।
অনলাইন পত্রিকাগুলো এই একটি বিভাগের জন্য নির্ধারিত অর্থ ব্যয় করতে নারাজ বলে এর-ওর আত্মীয়, বান্ধবী, প্রেমিকা, প্রেমিক বা লতায়-লতায় পেচানো আত্মীয়ের লেখাও হরহামেশাই প্রকাশিত হচ্ছে। অথবা ঠিক যাকে বয়োজ্যেষ্ঠ বা তরুণ সম্ভাবনাময়ী হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়- তিনি কাজের কাজ কিছুই না পারলেও স্বজনপ্রীতির বেলায় বিন্দুমাত্র দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিতে নারাজ। মূল কথা হচ্ছে- সাহিত্য যদি উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির মতো হয়ে উঠেছে। তবে একসময় এমন সম্পত্তি নিয়ে উত্তরাধিকারদের মধ্যেও হাঙ্গামার ব্যাপক আশঙ্কা রয়েছে। তখন দেখা যাবে মূল সম্পত্তিই হাতছাড়া হওয়ার উপক্রম হচ্ছে!
সেই ’শিশুর হাতের খেলনার মতো’ যে হাতে পাচ্ছে, সে-ই খেলছে। খেলার নিয়ম না জেনেও খেলছে। ফলে সে খেলনাও বেশিদিন খেলার মতো অবস্থা হারিয়ে ফেলে। যে কারণে মৌলিক ধারার লেখক-কবিরা এ ধরনের সাহিত্যপাতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হন। কখনো কখনো শোনা যায়, শিশুর খেলনাটা অনেক সময় বিশেষ খেলনায় রূপান্তরিত হয়ে যায়। যেমন- সাহিত্য সম্পাদকদের সঙ্গে সুন্দরী, আমলা, ব্যবসায়ীদের সখ্য গড়ে ওঠা কিংবা বিদেশ থেকে প্রবাসী লেখকদের গিফট পাঠানো প্রভৃতি নানাবিধ কলাকৌশল জড়িয়ে পড়ে। সুন্দরীর ফেসবুক স্ট্যাটাসে হাজারখানেক লাইক আর শ’খানেক মন্তব্য দেখে তাকেও লেখক বানাতে মরিয়া হয়ে ওঠেন কোনো কোনো ওয়েবম্যাগের সম্পাদক নিজেও।
আদতে এ ধরনের অপকৌশল কতদিন টিকবে, তা কিন্তু বলার অপেক্ষা রাখে না। রোজই তো এত-এত কবিতা (!) প্রকাশিত হচ্ছে- কই মানুষের মুখে একটা কবিতার একটা লাইনও তো শুনতে পাচ্ছি না। এখনো ঠোঁটে ঠোঁটে লেগে আছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, জসীমউদ্দীন, সৈয়দ হক, রফিক আজাদ কিংবা হেলাল হাফিজ। লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রে লেখকের ব্যক্তিগত পরিচয় কিংবা লেখকে-সম্পাদকে সম্পর্ক স্থাপন নয়, মান বিচার করা উচিত আগে।
সম্পর্কের দাবি নিয়ে খুব বেশি কিছু লেখা যায় না। বেশিদিন টিকে থাকা যায় না। মূলধারায় আসতে হয়- মৌলিক কিছু লিখতে হয়। না হলে এই সম্পর্কচর্চা যেমনি সাহিত্যের ক্ষতি করে, তেমনি সাহিত্যিকও নামিয়ে নর্দমায়। তবে সময়ের ব্যাপার মাত্র; দু’দিন আগে আর দু’দিন পরে!
চলবে…