এমনি করে প্রতি রাতে মরে যায় আমার অসংখ্য সৃষ্টির ভ্রূণ; কিছু কিছু শিশু কবিতাও। পার হয়ে যায় কত শত আমার বন্ধ্যা সময়। মনের মতো কর্মহীন গতিহীন স্থির চোখে দেখা যায় না, এমনকি যে সবচেয়ে কাছে থাকে—বুকের পাঁজরে ঘুমায় জন্মাবধি, সেও দেখে না সব। অথচ গতিশীল জীবন চলছে ঠিক। পদার্থ বিজ্ঞানের ভাষায় বস্তুর সরণ মানেই গতি। সারাদিন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দৌড়ালেও যদি চুল পরিমাণ জায়গা অতিক্রান্ত না হয়, তবে তা সরণ নয় (যেমন আমরা ট্রেডমিলে দৌড়াই) সে অর্থে প্রতিদিন চলছে সরণ। গতিশীল জীবন। দারুণ তোড়ে চলছে সংসারধর্ম স্ত্রীধর্ম মাতৃধর্ম পালন। মাতৃত্বের অবাধ অগাধ সীমানাহীন দায়িত্নে কোনো খাদ নেই। চলছে প্রগতির চাকা। হাত চলছে, পা চলছে। সূর্য উঠছে, সূর্য ডুবছে প্রতিদিন। অথচ আমি স্থির গতিহীন, একা। নিঃশব্দ দিন আমার, নিস্তব্ধ রাত। কেউ জানে না। কেউ না!
ছোটবেলায় কখনো শুনিনি ‘বাইরে বের হয়ো না খোলা চুলে’ কিংবা ‘মাছের মুড়ো বা মুরগীর রানটা দাও ভাইয়ের পাতে অথবা শুনিনি মায়ের কাছে কোনোদিন ‘পিরিওড হলে খেতে হয় না মাছ দুধ ডিম কিংবা মাংস’। এমনি এক স্বাধীন আর বুদ্ধিমতি মানুষের সঙ্গে বড় হয়েছি। তখন জীবনটা ছিল গতিশীল। একজন মানুষ আমাকে সবসময় দেখিয়েছেন খোলা আকাশ, বিস্তৃত সবুজ ঘাসের মাঠ, কুড়িয়ে নিয়েছেন আমার পায়ে চলার পথের যত কাঁটা জন্মাবধি। পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে গেছেন তিনি কেবল। আর আমি চেষ্টায় অবিরত কত কম সময়ে পার হব পুরোটা পুকুর। অথচ আজ মনে হয় আমি সরাতে পারিনি আমার জীবনের, পথের অকৃতজ্ঞ ধুলিকণাটিকেও। মা আমাকে বলতেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাও। বিশ্ববিদ্যালয়—সে এক বিশাল উদার প্রশস্ত বিদ্যা অর্জনের পথ। আর মনে রাখবে একটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক প্রায় সমান বিশাল। তাঁদের শ্রদ্ধা করতে শিখবে। যিনি ‘ক’ অক্ষর শিখিয়েছেন, তাঁর নামও মনে রাখবে শ্রদ্ধার সঙ্গে।
আমি স্বপ্ন দেখলাম আমার মায়ের চোখে। তখন কৈশোর পেরিয়েছি কেবল। এলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভর্তি হলাম বাংলা বিভাগে। আর এটাচমেন্ট পেলাম বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলে। ভাইবাবোর্ডে আমার জন্য বরাদ্দ হলো রোকেয়া হল। তখন বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলে সাধারণত মেয়েরা এটাচমেন্ট নিতে চাইত না। কলাভবন থেকে একটু দূরে আজিমপুর ঘেঁষে তখন এই ছাত্রী হলটাকে একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো মনে হতো। যেন এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশ নয়। কলাভবন একেবারে লাগোয়া যেমন রোকেয়া এবং শাসুন্নাহার হলের মতো নয়। আর টিএসসি থেকে তো আরও দূরে। সাহস করে সৈয়দ আকরাম স্যারের মুখের ওপর বলে বসলাম, ‘স্যার আমাকে সম্ভব হলে মৈত্রী হল দিন।’ তখন মূল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে দূরে বলে ছাত্রীরা মৈত্রী হলের বিষয়ে দারুণ অনুৎসাহী। কিন্তু নতুন আর পরিপাটি পরিচ্ছন্ন বলে রোকেয়ার চেয়ে আমার বেশি ভালো লাগলো তুলনামূলক নতুন এই হলটিকে। স্যার ভীষণ খুশি হয়ে সঙ্গে-সঙ্গে এপ্রুভ করলেন। সেই আমার সাহসের সঙ্গে পথচলা শুরু। আর মনে মনে ভাবলাম সত্যিই তো মা যে বলেছিলেন ‘উদার’-‘প্রশস্ত’, তাই তো সব এখানে! এখানে তো আমার শুরুই হলো ভীষণ একটা উদার আমন্ত্রণ আর গ্রহণের মধ্য দিয়ে। আর সৈয়দ আকরাম স্যার হয়ে রইলেন আমার কাছে প্রশস্ত পথের একটা জ্বলজ্যান্ত সিম্বল। তখনো জানতাম না যে, তিনি বাংলা বিভাগের শিক্ষক। সেটা ১৯৯৩ সাল। কিন্তু একটি বিশেষ ঘটনা বা একজন মানুষের বিশেষ কারণে দেওয়া কোনো স্বীকৃতি বা অনুমোদন কখনো সর্বজনীন হতে পারে না। তাই নতুন অভিজ্ঞতা আর নিজেকে মানুষ নয় নারী হিসেবে একেবারে সিলমোহর দেওয়া এক নির্মোহ বিদ্যার্জনের উঠোনে শুরু হলো আমার পথ চলা, তখনো তা জানতে পারিনি। সারাক্ষণ বই নিয়ে বসে থাকার মানুষ আমি নই কিন্তু টিএসসিতে আবৃত্তির গ্রুপের কর্মশালা, রিহার্সেল আর শো-এর দিন কোনোভাবেই মিস করা আমার দ্বারা তখন সম্ভব নয়। এসব করতে-করতে প্রায়ই রাত আটটা নটা বাজেই। আর যেদিন মঞ্চায়ন সেদিন তো রাত আরও বেশি। তখন একা একা পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তন থেকে রামপুরা লোকাল গার্ডিয়ানের বাড়ি যাওয়া এক ঝক্কি। তার চেয়ে হলে ফেরাই ভালো। সমস্যা দাঁড়ালো অন্য জায়গায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের হলে তখনো, গ্রীষ্মকালে সন্ধ্যা সাতটার ভেতর আর শীতকালে সন্ধ্যা ছ’টার ভেতর সব ছাত্রীকে হলে ঢুকে পড়তে হবে। তা না হলে লোকাল গার্ডিয়ানকে সঙ্গে নিয়ে আসতে হবে কিংবা সম্ভব হলে আগের দিন লোকাল গার্ডিয়ানের সই করা সম্মতিপত্র হাউজ টিউটরকে দাখিল করতে হবে। আর সন্ধ্যা ছ’টা বাজলেই ছাত্রীদের হলে ঢোকার জন্য ঘণ্টা বাজিয়ে জানান দেওয়া হয়—‘খোয়াড়ে ঢুকবার সময় হয়েছে’। ১৯৯৩ সালে দাঁড়িয়ে, আমি এবং আমার মতো আরও সবাই বাধ্য হয়ে তখন মেনে নিচ্ছি ১৯২২ সালের ‘প্রক্টোরিয়াল রুলস অ্যান্ড রেজ্যুলেশন।’ যা যুগের প্রয়োজনের সঙ্গে, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উদার বিদ্যার্জনের পথে একেবারেই বেমানান, যুক্তিহীন আর হাস্যকর একটি বিষয়। ছাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য যখন ছাত্রী হলগুলোতে ঠিক সন্ধ্যা ছ’টায় ঢুকে পড়ে বা ঢুকিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে, ঠিক তখনই যদি কোনো কারণে কোনো এক ছাত্রী দেরি করে ফেলল হলে ঢুকতে, তাকে চলে যেতে বলা হয় হাউজটিউটরের পক্ষ থেকে। কোথায় যাবে, কিভাবে যাবে বা আদৌ যেতে গিয়ে মাঝপথে ছাত্রীটি কোনো বিপদে পড়বে কি না—এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোনোই চিন্তা নেই। একদিন এক ছাত্রী কোনো এক দীর্ঘ ছুটি শেষে বাসের কোনো এক গোলোযোগে পড়ে হল গেটে আসতে প্রায় রাত বারোটা। এত রাত। হাউজটিউটররাও যার যার কোয়ার্টারে। ডাকা হলো তাদের কাউকে। প্রভোস্টকে ফোন করা হলো সিদ্ধান্তের জন্য। সিদ্ধান্ত দেওয়া হল—ছাত্রীটি তার লোকাল গার্ডিয়ানের বাড়ি ফিরে যাক। তার লোকাল গার্ডিয়ানের বাসা পলাশীতে বুয়েট টিচার্স কোয়ার্টারে। হল কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে আমরা তখন হতবাক। পৃথিবীর সব স্বাধীনতা কিংবা অধিকার কি ভোগ করার অধিকার নারীর থাকতে আছে? নারী কি মানুষ? স্বয়ং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রশস্ত মুক্তাঙ্গনও তাকে মানুষ মনে করে না।
যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একই ক্লাসের একজন ছাত্র কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ব্যবহার করার অধিকার পায় রাতে সাড়ে আটটা পর্যন্ত, তখন একজন ছাত্রী ১৯২২ সালের সূর্যাস্ত আইন মেনে নিয়ে হলে ঢুকে পড়তে বাধ্য হয় সন্ধ্যা ছ‘টা (শীতকালে) কি সাতটায় (গ্রীষ্মকালে)। প্রথাগত কারণে কিংবা সমাজের কথা চিন্তা করে অথবা পরিবর্তন ভীষণ রকম জটিল বলে এমন হতেই পারে—অনেককাল একটি আইন পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে-সঙ্গে চলবে কে? আর যুগটা, সমাজটা সমাজের চোখটা, আসলে পরিবর্তন করবে কে? আমার তো সূর্যাস্ত আইনে আক্রান্ত হওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ধারণা ছিল, পরিবর্তনটা করব আমরা, আমার শিক্ষক, যারা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষাগুরু। যাদের সমগ্র দেশ আর জাতি জাতির বিবেক আর মানুষ গড়ার কারিগর জানে। নারীর গতি বাধা পেল এইখানে এসে তার গুরুরই কাছে! ছাত্রীরা যখন আন্দোলন শুরু করল ভেঙে ফেলতে এই বৈষম্যের দেয়াল, তখনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসনই হয়ে দাঁড়ালো সবচেয়ে বড় আর মারাত্মক বাধা! এর পরের ঘটনা আরও বিস্ময়কর।
চলবে…