প্রথম পর্ব:
খুব ছোটবেলায় পুকুরের বাঁধানো উঁচু পাড় থেকে ঝাঁপ দিত ভাইজান, সেখান থেকেই আমিও ঝাঁপ দিতাম। ভাইজানের হাতের ওপর ছোট্ট শরীরটা ছেড়ে দিয়ে প্রথম সাঁতার শেখা। তারপর কত যে এপার-ওপার করেছি সারাটা পুকুর, সারাটা ছোটবেলা। তখন কোনোদিন মনে হয়নি একজন নারীর কথা। লালমাইয়ের কোলে বড় হয়েছি, ঘুম ভেঙেই ছুটে আসতাম বারান্দায়। সামনে তাকালেই যতদূর চোখ যেত, সবুজ ধান ক্ষেত। লম্বা ঠোঁট ধানক্ষেতে ডুবিয়ে মাছ শিকার করছে সাদা বক, কখনো উড়ে যাচ্ছে দুই-একটি। তার ওপারে লালমাইয়ের চূড়ায় ছোট্ট টিলা দূর থেকে ঝাপসা দেখা যায়। ওই টিলার ওপর ছোট্ট একটা ঘর। একজন মানুষ মনে হয় ওখানে বাস করে। একা, নিভৃতে। ঝাড়মোছ করে প্রতিটি সকাল আর সন্ধ্যা। ওপারে গভীর অরণ্যগ্রাম। গ্রামের সরল মানুষগুলো এপারে আসে। বাড়িতে বাড়িতে কাজ করে। যারা সচ্ছল।নিজের জমিতে আম-জাম-কাঁঠাল বরই গাছ করে। তার ফল নিয়ে আসে ধানীজমির খেতের আল বেয়ে কলোনীতে বিক্রী করতে। যারা সমর্থ। গরু পালে। সদ্য দোয়ানো গরুর দুধ নিয়ে আসে। বিক্রি করে কলোনির এ মাথা থেকে ও মাথা ঘুরে ঘুরে। কখনো আমি ওদের সঙ্গে চলে যাই জমির আল ধরে সেই দূর-দূর গ্রামে। ওই গ্রামেরই কোনো এক কিশোরী বা কিশোর আমার সঙ্গে একই স্কুলে পড়েও কিন্তু। আমি তখন নারী নই, মানুষ কিংবা কিশোর, নাকি কিশোরী! চলছি পথ অফুরন্ত আর অজানার। কোথায় যাচ্ছি আসলে? ক্রমাগত ধাবিত হচ্ছি কি একজন মানুষ থেকে একজন কিশোরী, কিশোরী থেকে যুবতী এবং একজন নারীর দিকে? না কি একজন মানুষ ধাবিত হচ্ছি মানুষ থেকে আরও বেশি মানুষ হওয়ার প্রত্যয়ে। না কি এগুচ্ছি একজন মানুষ বিভাজিত হয়ে আরও মানুষ তৈরির প্রটোকলের দিকে!
তিনতলার বেলকোনি থেকে গাছতলায় উঁকি দিয়ে শরৎ ভোরে যদি কোনোদিন দেখি শূন্য পথ, একটিও ফুল পড়ে নেই পথে আর, সব কুড়িয়ে নিয়ে গেছে অন্যে সেদিন শূন্য মন্দির, পূজোর ফুলমালা নেই-যাইনি দেবতার সামনে। সারাদিন ছোট্ট মানুষটার মনে পরম দুঃখ একা একা বাজে। স্কুল বড় প্রিয়-এখন বিভাজিত ‘আমি’রও খুব প্রিয় স্কুল। বলছি আমার কন্যা রাজেশ্বরীর কথা। তখন যদি কোনোদিন আকাশ মেঘলা, বৃষ্টির ভাব-এক ছুটে বেরিয়ে গেছি, কখন মা বারণ করে বসেন স্কুলে যেতে। আমি কিন্তু আমার কন্যাকে জল কিংবা ঝড়ে, স্কুলে যেতে বারণ করি না। বরং স্কুল ফেরার পথে যদি বৃষ্টি আসে রিকশার হুড ফেলে দেই, ভিজে ভিজে ভালোবাসি মেঘ আর জলকে দু’জনে একসঙ্গে। তখন রাজেশ্বরীর মনে সে কি আনন্দ! হাসি-রহস্য আর প্রশ্নের ভিড়ে হারাই আমি।
মা বৃষ্টি কোথা থেকে আসে?
কে বৃষ্টি পাঠায়?
কেমন করে বৃষ্টি এখানে এসে পড়ে?
বৃষ্টির সময় আকাশের দিকে তাকালে কোথা থেকে বৃষ্টি আসছে, দেখা যায় না কেন?
আর ভাবি, আমি যে ছোটবেলায় এত ভিজেছি জলে, এত যে কেটেছি সাঁতার জলের ওপরে, জল পড়ার শব্দে কান মুখর করে। কখনো তো এত্ত প্রশ্ন আসেনি আমার মনে। আমার কন্যা এতসব জানতে চায়, এত কৌতূহল আর জিজ্ঞাসা আমাকে ভীত করে তোলে। ভাবি যদি একদিন আমাকে প্রশ্ন করে বসে:
মা, আমি কি শুধুই নারী? আমি কি মানুষ নই?
কেন মানুষ নই?
বৃষ্টিভেজা দিনের আবেশটাই ছিল অন্যরকম। স্কুলের মাঠে পানি জমতো, স্যার ক্লাসে আসতে দেরি হলেই আমি ঝুপ করে বারান্দা পেরিয়েই নেমে পড়তাম জলভরা মাঠে। আবার বাড়ি ফেরার পথে বাসার সামনে বিশাল মাঠের ঘাসে উঠে আসতো পুকুর উপচানো জল, তাতে ছোট ছোট মাছ, অঞ্জলি ভরে তুলতাম আমার মতো শিশু মাছ। আবার ছেড়ে দিতাম। দুপুরের অবকাশ মানেই ভাইজানের সঙ্গে সারাটা পুকুর এপার-ওপার করা। ভাইজান দুর্দান্ত সুইমার। জলে নেমেছে তো চ্যাম্পিয়ন। তার স্বপ্নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমি শিখি ডাইভ, শিখি ব্যাক স্ট্রোক, শিখি বাটার ফ্লাই আরও আরও যা-যা সব। ঝুম বৃষ্টিতেও ছাড়াছাড়ি নেই। ঘড়িতে সময় ধরে ভাইজান বসে থাকে বাঁধানো পুকুর ঘাটে। আমি ন্যূনতম সময়ে পার হই পুকুর। তার পরের বার আরও কম সমযে। তারপর আরও আরও কম সময়ে। তখন মানুষ ছিলাম। আবার কোনো কোনো দিন জলের অতলে ডুব দিয়ে জলের গান রিমঝিম ঘনঘন রে…শুনি। আজও কানে বেজে চলে যার সুর। আজও লালমাইয়ের ঘন লজ্জাবতীর পাতা দূরে সন্ধ্যার মিষ্টি লাল আকাশ ছবি আঁকে। বেড়ে উঠেছি প্রকৃতির নিবিড় আর দারুণ আদুরে কোলে। ঘরে বাবা ভাই মা কারও কাছেই বুঝতে পারিনি কোনোদিনও আমি নারী না কি পুরুষ, দারুণ মানুষ জন্ম আর বেড়ে ওঠা জীবনের প্রদোষে। তখন পেয়ারা বনে গভীর অন্ধকার ঘনাতো আলসে বিকেলেই, বরই পাড়তে যেতাম গাছে কুটো দিয়ে, গাছের তলে কুড়ানো জাম, কাঁচা আম পেড়ে খাওয়া আর কাঁঠালের মুচি লবনমরিচে, স্কুলে যাওয়ার পথে আব্বার অফিসের গাছ থেকে ফুল চুরি করে রেখে যাওয়া ঘাসের বিছানায়-ফেরার পথে নেব বলে, এই ছিল ছোট বেলা।
মা বলতেন পড়তে বসো। আমি পড়তে বসতাম। মা বলতেন, নিজের পায়ে দাঁড়াতে, চেষ্টা করো। আমি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতাম। মা কেন এমন করে বলতেন বুঝতে পারিনি তখন, কিন্তু বরাবর চেষ্টা ছিল একটাই নিজের পায়ে দাঁড়াতে বলেছেন মা, আমার তাই করতে হবে। তখন ভাবতাম পড়ালেখা খুব মনোযোগ দিয়ে করলে আর ভালো রেজাল্ট করলেই বুঝি নিজের পায়ে দাঁড়ানো যায়। বুঝতাম না মা কেনই বা একথা বলেন আর সত্যি সত্যি জীবনে নিজের পায়ে দাঁড়ানো মানেটাই বা কী? একজন নিজের পায়ে দাঁড়ানো নারীর ছবি আঁকতে চেষ্টা করতাম মনে মনে। নাহ্ আমার চারপাশে একটাও নিজের পায়ে দাঁড়ানো নারী দেখতে পেতাম না। চোখে ভেসে উঠতো দূর বিদেশিনী মাদাম তেরেসার ছবি। তখন মনে হতো নিজের ইচ্ছেমতো কিছু করতে পারাই বুঝি নিজের পায়ে দাঁড়ানো। মাদার তেরেসার ছবি দেখতাম–সংবাদপত্রের পাতায়, নিউজে। দেখতাম দূর-দুরান্তে অসহায় বিপন্ন মানুষের সেবায় ছুটে বেড়াচ্ছেন তিনি নিজের মতো করে। আমার চোখে দেখা একজন সফল মানুষ (নারী) যিনি অসংখ্য মানুষকে দিয়ে গেছেন জীবনের দাম, গতি, ভালোবাসা আর নিজের নারীসত্তাকে সারাটা জীবন গতিশীল করে গেছেন মানুষ রূপে।
‘গতি’-আজ জীবনের এই সময়টায় এই শব্দটা আমাকে বড় বেশি ইমোশনাল করে তোলে। গতি বলতে আমি বুঝি কত কম সময়ে পুরোটা পুকুর এপার ওপার করা যায়। আমার গভীরে আজও তাই। কিন্তু এই রাষ্ট্রে এই পোড়খাওয়া ঘুনে ধরা সমাজে, এই সংসারে একজন নারী গতিশীল হয়ে ওঠাটা কি একা তারই ওপর নির্ভর করে? ‘গতিশীল’ শব্দের অর্থই বা কী? আমি দিনরাত ভাবি-একজন নারী ছুটছে সকাল থেকে সন্ধ্যা, কাজ করছে, হয়তো অফিসে, ঘরে। সারাদিন ছুটছে, ছুটছে। হয়তো জীবিকার তাগিদে কিংবা অস্তিত্বের সংকটে। হয়তো মনের আনন্দে কিংবা বাধ্য হয়ে। তাতেই কি নারী গতিশীল হয়ে উঠলো? আর এতসব কিছুর ভেতরে তার যে একলা, একটি নরম কোমল মানুষ মন-হয়তো সে নিজেই তার খবর নিতে ভুলে যায় গতিশীল জীবনের চাপে আর ব্যস্ততায়। আমার আজ ব্যস্ততা বেড়েছে, সময়ের বড় অভাব সারাদিনে, উদয়াস্ত পরিশ্রমে ক্লান্ত দেহে, অবশ মনে মধ্যরাতে আমার নিজেকে মনে হয় বড় গতিহীন, স্তব্ধ। কেন এমন হয়, কেন এমন হবে? হয় এই জন্য যে, মধ্যরাতে হঠাৎ আমার মাথায় একটা কবিতার পঙ্ক্তি এলো, আমি একছুটে গিয়ে বসতে পারি না লেখার খাতায়, পেছনে হাজারো প্রশ্ন ‘এত রাতে কি দরকার!’ আমি কী করে বোঝাব এখনই জন্ম হলো যে ভ্রূনটার তাকে সময়মতো অক্সিজেন দিতে না পারলে সে মরে যাবে। আবার অনেক সময় নিজেরই এত অবহেলা-মনে হয় এই এখন যদি লিখতে বসি, সারাটা রাত পার হয়ে যাবে। ভোরে মেয়েকে নিয়ে স্কুলে যাওয়া, অফিস শেষে টিউশনি, শরীরে কুলোবে কি? বস্তুত শরীর তো এক অদ্ভুত গাড়ি। তাকেও ফুয়েল নিতে হয়। রাতের ঘুমের ফুয়েল না হলে গাড়ি দিনের বেলা চলবে কেন?
চলবে…