প্রত্নকাল থেকেই মানুষ ছিল সৌন্দর্যপিপাসু। সুন্দরের পূজারী মানুষ সেই প্রমাণ দিয়ে এসেছে নানা সময় নানাভাবে, কখনো শরীরে উল্কি এঁকে, কখনো গুহার দেয়ালে নানা রকম ছবি এঁকে, কখনো ব্যবহার্য আসবাব বা দ্রব্যে নকশা এঁকে। সুন্দরের প্রতি মানুষের এই ভালোবাসার কারণেই সে হয়ে উঠেছে শিল্পী এবং তার কারুকাজ মণ্ডিত আসবাবপত্র হয়ে উঠেছে শিল্পকর্ম। এসব শিল্পকর্মগুলো কারুশিল্প নামে পরিচিত। সামাজিক ও পারিবারিক জীবনযাপনে ব্যবহৃত বহু বস্তু সামগ্রী রয়েছে যেমন-দা,কুড়াল,লাঙ্গল,মাটির হাঁড়িপাতিল, নানরকম বাদ্য যন্ত্র—ইত্যাদি কারুশিল্প আবার মাটির পুতুল, কাঠের পুতুল, হাতি, ঘোড়া, মানুষ কিংবা অন্যান্য পুতুল বা আসবাবের প্রতিকৃতি লোক শিল্পের নিদর্শন। এসব কারুশিল্প বা লোক শিল্পের জন্য শিল্পীরা নান রকম উপকরণ ব্যবহার করেন ফলে কারুশিল্পের মধ্যেও তখন শ্রেণী তৈরি হয়ে যায় যেমন কাঠখোদাই শিল্প হলো—দারুশিল্প, মাটির তৈরি শিল্প মৃৎশিল্প্ এভাবে ধাতু শিল্প,হাতির দাঁতের শিল্প ইত্যাদি।
দারুশিল্পে পালকি: ভারত উপমহাদেশে খ্রিস্ট পূর্ব ৩০০০ অব্দ থেকে কাঠ শিল্পের প্রমাণ মেলে। ইতিহাস থেকে জানা যায়—মৌর্যযুগে কাঠ খোদাই শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। প্রাচীন শাস্ত্র ও পুরাণেও কাঠের আসবাব ও অন্যান্য দ্রব্য সম্পর্কে উল্লেখ আছে। যা থেকে দারুশিল্পের প্রাচীনত্ব সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়া যায়। ফলে এ অঞ্চলে দারুশিল্প ভিত্তিক একটি শিল্পী সমাজ গড়ে উঠেছিল সঙ্গত কারণেই। বাংলার দারুশিল্পীদের খোদাই কাজের অসাধারণ দক্ষতা ও নৈপুণ্যের নিদর্শন আমরা পাই পাল ও সেন আমলের নানা শিল্পকর্মে। এসব শিল্পকর্মের মধ্যে আছে—ঘরের আসবাব পত্র দরজার পাল্লা, বেড়া, চেয়ার, টেবিল, খাট বা পালঙ্ক, সিংহাসন দেবমূর্তি, মন্দিরের প্যানেল, নৌকা, পালকি ইত্যাদি। সেন আমলে হাতির দাঁতের বহদণ্ড যুক্ত পালকির কথা জানতে পারা যায় ইদিলপুর লিপিতে।
পাল ও সেন আমলের পরবর্তী সময় পালকির গঠনে ও তার কারুকাজে নানারকম পরিবর্তন আমরা লক্ষ করি। বাংলার শিল্পকর্মে তখন ব্রিটিশ ও সেইসঙ্গে অন্যান্য বহিরাগত জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব শৈলীর সমন্বয় ঘটাতে শুরু করেছে। বিশেষ করে কাঠের আসবাব ও দেয়ালচিত্রে এর ব্যাপক প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। দেবমন্দিরের স্থাপত্যে, নকশায় কাঠের রথ, নানা রকম মূর্তির সঙ্গে মন্দিরের দরজা ঘরের দরজা, পালকি, পালঙ্ক ইত্যাদি কারুকাজ মণ্ডিত কাঠের আসবাব তৈরি হতে থাকে। নানা রকম আকার ও আকৃতির কারুকাজ মণ্ডিত পালকির তখন ব্যাপক চাহিদা, এছাড়া কাঠের প্লেট বা দেয়ালে গ্রামীণ দৃশ্যের সঙ্গে পালকির দৃশ্যও ঠাঁই পেতে শুরু করে। জাদুঘরে সংরক্ষিত পালকিটির দেয়ালেও খোদিত আছে বেহারার কাধে পালকির দৃশ্য।
বর্তমানে পালকির চল নেই কিন্তু দারুশিল্পীরা গ্রাম বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী বাহন টিকে শোপিস হিসেবে উপস্থাপন করতে ভুল করছেন না। লোক শিল্প হিসেবে কাঠের তৈরি পালকির শোপিস এখন বিক্রি হয় বৈশাখী মেলায়, শিয়ালদহের কুটবাড়ির সামনের দোকানগুলোতে। কাঠে খোদাই করা পালকি ও পালকি বাহকের দৃশ্য এখনও ব্যাপক জনপিয়। বিখ্যাত শিল্পীদের আঁকা চিত্র কর্ম কাঠে খোদাই করে বিক্র করা হচ্ছে। এরমধ্যে আছে গরুর গাড়ি, ঠেলা গাড়ি ইত্যাদি সেই সঙ্গে বিক্রি হচ্ছে কাঠে খোদাই পালকিও।
মৃৎশিল্পে পালকি
প্রাচীনকাল থেকে সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত শুধু স্থাপত্য নির্মাণ ও অলঙ্করণের জন্যই নয় মাটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে নানারকম তৈজসপত্র তৈরিতেও নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রী যেমন—হাঁড়িপাতিল বাসনপত্র, কলসি, দেব-দেবীর মূর্তি ইত্যাদি তৈরি হতো মাটি দিয়ে। এছাড়া নানারকম খেলনা, হাতি ঘোড়া, পুতুল ইত্যাদি যাবতীয় লোকজ শিল্পের নিদর্শন তৈরি হয় মাটি দিয়েই। মাটির তৈরি এই সব দ্রব্যসামগ্রী নির্দিষ্ট তাপে পুড়িয়ে তৈরি হয় টেকসই সব শিল্পকর্ম।
প্রায় সকল সভ্যতার নিদর্শন হিসেবে পোড়ামাটির শিল্পকর্মের নমুনা পাওয়া যায়। ভারত উপমহাদেশে পোড়ামাটির শিল্পকর্মের বহু নিদর্শন রয়েছে। প্রাচীন ভারতে মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা সভ্যতায় পোড়ামাটির ব্যবহার দেখা যায়। চন্দ্রকেতুগড়, মহাস্থানগড়, উয়ারী বটেশ্বরে মৃৎপাত্র ও পোড়ামাটির ফলকের দেখা মেলে। খ্রিস্টপূর্বে দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে খ্রিস্টীয় ৫ম-৬ষ্ঠ শতাব্দীতেও পোড়ামাটির অস্তিত্বের সন্ধান মেলে। বাংলাদেশে বিদ্যমান পুরাকীর্তির মধ্যে কুমিল্লার ময়নামতি, জয়পুর হাটের পাহাড়পুর, বৌদ্ধবিহারগুলো পোড়ামাটি শিল্পের নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে। এসব বিহারের মূল মন্দিরের প্রদক্ষিণ পথের পাশে বড় বড় পোড়ামাটির ফলকে চিত্রিত হয়েছে সেই সময়ের মানুষ ও তাদের সমাজ জীবন।
এরপর মধ্যযুগ ও মধ্যযুগের শেষ পর্বে বিভিন্ন জাতি ও ধর্ম বিশ্বাসের সমন্নয় এক মিশ্র শিল্প চর্চা শুরু হয়।ফলে মৃৎশিল্পে শৈল্পিক অভিব্যক্তি ও অলঙ্করণে পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। দেশীয় রীতির পাশাপাশি নকশা জালিকাজ ও জ্যামিতিক নকশা সেখানে ঠাঁই পেতে শুরু করে। ঘর বা মন্দিরের দেয়াল গুলিতেও স্থান পায় শোভাবর্ধক প্যানেল, ফ্রেমে বাঁধানো লতা পাতা, জলের নকশা, দেব-দেবীর মূর্তি, শিব-কালী, লক্ষ্মী ও বিষ্ণুর মূর্তি—ইত্যাদি। এছাড়া স্থাপত্য নকশায় যেখানে বর্ণনামূলক বিষয়বস্তু ও দৃশ্যাবলি স্থান পেত সেখানে একটি সীমানির্ধারণী রেখার ওপর জোর দেওয়া হতো। পৌরাণিক কাহিনি এবং ইহজাগতিক দৃশ্যের মধ্যে সীমানা চিহ্নিত করা ছিল। মন্দিরের ওপরের দিকটার বেশির ভাগ স্থান বরাদ্দ ছিল দেব-দেবী এং পৌরাণিক কাহিনির দৃশ্য চিত্রায়িত করার জন্য আর একেবারে নিচে স্থান পেত পার্থিব জগতের নানা বিষয়। সেখানে সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের জীবনযাত্রা, তাদের জীবিকা নির্বাহের ধরন ও কার্যপ্রণালী চিত্রিত হতো। শিশুর জন্ম নেওয়া, নারীদের গৃহস্থালী কাজের দৃশ্য যেমন মাছ কাটা, কাপড় ধোয়া, ধান ভানা, রান্না করা, গোসল, চুল আচড়ানোর দৃশ্য, ছাড়াও নারী পুরুষের বিভিন্ন পেশায় কর্মরত হওয়ার দৃশ্য যেমন-চরকায় সুতা কাটা, করাত দিয়ে কাঠ কাটা, কামারে হাতুড়ি দিয়ে লোহা পিটানো, দুধ বাজারে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যও রয়েছে। হাতির পিঠে ভ্রমণরত নারীর দৃশ্যও ঠাঁই পেয়েছে সেইসব ফলকে। পাশাপাশি কান্তজির মন্দির গাত্রে পোড়া মাটির ফলকে উৎকীর্ণ এই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে চার বেহারা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে একটি পালকি।পালকির আরোহী হেলান দেওয়া নরম বালিশে। একপায়ের ওপর আর এক পা তুলে আয়েশি ভঙ্গিতে সে হুকা টানছে বা পাইপ টানছে।
কান্তজির মন্দির গাত্রে অন্য আর একটি ফলকে গরুর গাড়ির দৃশ্যটি দেখলে আপত দৃষ্টিতে মনে হবে যে গরু দিয়েই একটি পালকি টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মূলত মানুষবাহী পালকিটিই তো ধাপে ধাপে উঠে এসেছে কখনো হাতির পিঠে কখনো ঘোড়া এবং গরুর চাকায়। বর্তমানের রিশকাটিও তো সেই সিডান চেয়ার।
মৎশিল্পে পালকির ব্যাবহার এখনো বিলুপ্ত নয়। বিভিন্ন মেলায় এবং শিল্পকর্ম বিক্রির বড় বড় দোকান গুলোতে এমন কি ফুটপাথে, ফুলের টব বিক্রির দোকানেও পোড়া মাটির ফলকে খোদিত পালকি ও পালকিবাহকের শোপিস কিনতে পাওয়া যায়। এগুলো পাল বা কুমোররাই তৈরি করেন।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের মৃৎশিল্প ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক দেবাশীষ পালের পালকিবিষয়ক একটি শিল্পকর্ম কোরিয়ার শিউল আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে স্থান পায়। শিল্পকর্মটি সিরামিক ভাস্কর্য হিসেবে সেখানকার প্রদর্শনীতে ঠাঁই পায়।শিল্পী এখানে বহদণ্ড ছাড়া পালকি ব্যাবহার করেছেন। পালকির মধ্যে দুটি লম্বাটে আকৃতির নারী পুরুষের মাথা এবং দুই পাশে আলাদাভাবে স্থাপন করা হয়েছে দুটো করে মোট চারটি মাথা। এই চার বেহারার মুখের অভিব্যক্তিতে ক্লান্তি, চোখে ঔজ্জ্বল্য নেই। শিল্পী এখানে সামাজতন্ত্রের আধিপত্য ও বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপট গ্রামীণ ঐতিহ্যের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন।
হাতির দাতের শিল্পকর্মে পালকি
প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন শিল্প মাধ্যমের হাতির দাঁতের বিশেষ স্থান দখল করে আছে। হরপ্পা সভ্যতার সময় থেকেই হাতির দাঁতের শিল্পকর্মের নানা রকম নমুনার সন্ধান পাওয়া গেছে।
আফগানিস্তানের কুসান রাজাদের রাজধানী বেগ্রামে প্রচুর হাতির দাঁতের শিল্প নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। এছাড়া পাণ্ডু রাজার ঢিবি, চন্দ্রকেতুগড় ও মঙ্গলকোটে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলেও হাতির দাঁতের নিদর্শন পাওয়া গেছে।
আমরা প্রচীন সাহিত্যে হাতির দাঁতের শিল্পকলার উল্লেখ দেখতে পাই। রামায়ণে হাতির দাঁতের শিল্পীসংঘের উল্লেখ আছে। শালবন নাগ জাতকেও হাতির দাঁতের শিল্পসামগ্রী ব্যাবসার উল্লেখ আছে। সেখানে লোভী ব্যাবসায়ীর হাতিরূপ বোধিসত্ত্বের দাঁত সংগ্রহের ঘটনার উল্লেখ প্রমাণ করে যে হাতির দাঁতের ব্যবসা সেইসময় কত জমজমাট ছিল।
এছাড়া মধ্যযুগের ময়মনসিংহ গীতিকায় হাতির দাঁতের পাটির উল্লেখ আছে রূপবতী পালায়। বাংলাদেশের সিলেটের ‘ভাটেরা তাম্রশাসন ও বল্লালসেনের ইদিলপুর তাম্রশাসনে’ হাতির দাঁতের শিল্পকর্ম সংক্রান্ত তথ্যের প্রমাণ রয়েছে। কেশব সেনের ইদিলপুর লিপিতে হাতির দাঁতের বহদ- যুক্ত পালকির উল্লেখ আছে।৪ আঠারো উনিশ শতকের বিভিন্ন লেখায় রাজা ও জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকা-চট্টগ্রাম, সিলেট, রংপুর, কুড়িগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চলে হাতির দাঁতের শিল্প চর্চার প্রমাণ পাওয়া যায়।
হাতির দাঁতের শিল্পকর্মের মধ্যে রয়েছে গহনা, চিরুনিসহ হাতির দাঁতের কারুকর্মময় সোফা, চেয়ার পাদানি, শিতল পাটি, নানরকম সৌখিন ও নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রী ইত্যাদি। এ সব নিদর্শন দেখতে পাওয়া যাবে বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরে। হাতির দাঁতের শিল্পকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পালকির।
নিদর্শনটি ঢাকার বলধা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। উনিশ শতকের এই শিল্পকর্মটির পুরোটাই হাতির দাঁতের তৈরি চার পাশ রেলিংকরা একটি আয়তাকার প্লাটফর্মের মধ্যে চার বেহারার কাঁধে পালকি। পালকির ভেতর মুখোমুখি বসে আছেন বিষ্ণু আর গদা হাতে প্রিয়া। চার বেহারার হাতেই বল্লম বা বর্শা। পালকির দুই দরজার পাল্লায় অঙ্কিত হয়েছে দেবতার চিত্র, যাদের একজনের পিঠে পাখা। পালকির কার্নিশগুলো অলঙ্কৃত হয়েছে লতানো উদ্ভিদে।দেয়াল চিত্রে শোভাপাচ্ছে দেব-দেবীর ছবি। এমনকি বাইরের ছাদে পদ্ম পাতার ওপর বসে থাকা শিবের দুই পাশ দিয়ে দুটি হাতির শুঁড় তাঁর মাথার উপর ওঠানো।পালকির বহদণ্ডের সম্মুখ ভাগ তামার পাতে মোড়ানো। শিল্পকর্মটি যে প্লাটফর্মে স্থাপিত হয়েছে, সেখানে চারকোণে চারটি ও মাঝখানে আটটি—মোট বারোটি পতাকা রয়েছে। হাতির দাঁতের এই শিল্পকর্মটি কেবল তৎকালীন শিল্পচর্চার গভীরতা ও বিস্তৃতির প্রমাণই বহন করে না, এটি গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবেও পালকির অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেয়।
চিত্রকলায় পালকি: চিত্রকলা শিল্পের প্রাচীন নিদর্শন আদিম মানুষের গুহচিত্র। বাংলা অঞ্চলে গুহাচিত্রের নিদর্শন সঙ্গত কারণেই কম। তবে মেদিনীপুর জেলার ঝাড় গ্রামে লালজল নামক স্থানে প্রস্তর যুগের মানুষের একটি গুহানিবাস আবিষ্কৃত হয়েছে, যেখানে নরকঙ্কাল,আদিম মানুষের ব্যবহৃত পাথরের হাতিয়ার ও গুহাচিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। পৃথিবীর অন্যান্য গুহা চিত্রের মতো এই গুহাচিত্রে পশুর ছবিই অঙ্কিত হয়েছে। (চিত্রকলা: ফয়েজুল আজিম পৃ:৪৬৯)
প্রস্তর যুগের পর তাম্র যুগে মৃৎপাত্রে নান রকম চিত্র অঙ্কিত হয়েচিল। এসব মৃৎপাত্রে চিত্রিত হতো পশু পাখির মুখ, নানা বৈশিষ্ট্যের সরল ও বক্ররেখা, ত্রিভূজ, জাল নকশা। খ্রিস্টপূর্ব ২৬০০-১৭০০ এর দিকে হরপ্পা সভ্যতায় মৃৎপাত্রের অলঙ্করণ ছিল বিষয় বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ ও সুবিন্যস্ত।
পাল আমলে (৭৫০-১১৬২ খ্রি.) তালপাতার পুঁথিতে অঙ্কিত হয়েছিল বৌদ্ধ ধর্মীয় চিত্র। এগুলো পালচিত্র বা পূর্ব ভারতীয় শিল্পরীতি নামে পরিচিত। পালচিত্র কলায় অবক্ষয় শুরু হয় সেনআমলে এবং তেরো চৌদ্দ শতকে মুসলমান শাসনামলের প্রাক্কালে এসব শিল্পকলা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে পড়ে (প্রাগুক্ত পৃ: ৪৭৩)। কেননামুসলমান সুলতানরা দরবারি চিত্রকলার ক্ষেত্রে পারস্যের চিত্রশৈলীকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। এসব ছবিতে স্থান পেত গাছপালা, জীবজন্তু ও মানুষের প্রতিকৃতি। এরপর মুঘল চিত্রকলার আত্মপ্রকাশ ঘটে পারস্য শিল্পকলার উত্তরসূরি হিসেবেই। এসব চিত্রপলায় নবাবের শিকার দৃশ্য,নিসর্গ, রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা এবং গ্রামবাংলার জীবনধারার রূপায়ন লক্ষ করা যায়। এসব চিত্রকর্মের কিছু কিছু দুর্লভ নিদর্শন পাওয়া গেলেও বাঙালির নিজস্ব ঐতিহ্য সেখানে একেবারেই বিরল।
চিত্রকলায় বাংলা ও বাঙালির আসল পরিচয়টি মূর্ত হয় আরও অনেক পরে এসে। জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, আনোয়ারুল হক, শফিউদ্দিন, এস.এম সুলতান, নিতুন কুণ্ডু প্রমুখ শিল্পীর হাত ধরে। এই সব শিল্পীর আঁকা চিত্রকর্মে গ্রামবাংলার মানুষ, মানুষের জীবনযাপনের দৈনন্দিন দৃশ্য ফুটে উঠেছে। এসব দৃশ্যের মধ্যে ধান কাটার দৃশ্য, মাছ ধরার দৃশ্য, কৃষক ও ফসলের মাঠ, গরুর গাড়ি, ঠেলা গাড়ির দৃশ্য, স্তন্যপানরত শিশুর দৃশ্য, ধান মাড়াই দৃশ্য উল্লেখযোগ্য।
১৯৭০ সালে জলরংয়ে আঁকা জয়নুল আবেদিনের নবান্ন নামের চিত্রকর্মটিতে গ্রাম বাংলার চিরায়ত দৃশ্যটি লক্ষ করার মতো। একেবারে খেটেখাওয়া কৃষকের জীবনযাপন প্রণালী চিত্রিত হয়েছে এখানে। কৃষকের ধান কাটা ও মাড়াই,কৃষাণীর ধান ভানা নবান্নের এক উৎসব মুখর চিত্র। এরসঙ্গে গায়ের বধূর বাপের বাড়ি যাওয়া বা নাইওর যাওয়ার চিত্রটিও ফুটে উঠেছে। এখানে পালকটি লোকশিল্পের আদর্শ নিদর্শন হিসেবেই উপস্থাপিত হয়েছে।
ঢাকার জাতীয় যাদুঘরের ৩৩ নং গ্যালারিতে ঊনিশ শতকের প্রথম দিকে অঙ্কিত একটি ছবি সতেরোটি খণ্ডে সাজানো হয়েছে। জলরং করা এই চিত্রকর্মটিকে ঢাকার ঈদ ও মহররমের মিছিল নামে সনাক্ত করা হয়েছে। চিত্রকর্মে পালকির উপস্থাপনটি জাঁকজমক পূর্ণ। এর বহদণ্ডের সম্মুখভাগ হাতির মুখাকৃতির। চার বেহারার পালকিতে আরোহী হুকা টানছেন আরাম করে, বেহারাদের সঙ্গে হুকা হাতে হেঁটে যাচ্ছেন আরোহীর সেবাদাস। হাতি ও হাতির পিঠে আরোহীর সংখ্যাও অনেক বিভিন্ন স্তরে মানুষের ঢল দেখে মনে হবে যেন রাজা বাদশার প্রমোদ ভ্রমণ দৃশ্য।
আর একটি দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে চার বেহারার আচ্ছাদন বিহিন পালকিতে বসা আরোহী। পালকির সঙ্গে আরোহীর মাথায় ছাতা ধরে হাঁটছেন একজন। এই চিত্র কর্মে আরও অনেক টুকরো দৃশ্য রয়েছে। এই পর্বে আর একটি চিত্র কর্মে দেখা যাচ্ছে, দুটো খোলা পালকি বয়ে নিয়ে যাচ্ছে বেহারারা। পালকি দুটোতে কোনো আরোহী নেই।
মানুষ বেঁচে থাকে তার কর্মের মধ্যে,বংশ পরিচয়ে নয়। এই বার্তাটিই সব মানুষের কাছে পৌছে দিতে মানুষকে মানুষ বলে সম্মান করতে ঈশ্বর যুগে যুগে অবতার পাঠান এমন নয়—এসএম সুলতানের মতো শিল্পীরও জন্ম দেন একটি অবহেলিত পশ্চাৎপদ বেহারা সম্প্রদায়ের আইকন হিসেবে।এসএম সুলতানের দাদা কুরবান আলী ছিলেন বেহারা সম্পদায়ের মানুষ। এ প্রসঙ্গে সুভাষ বিশ্বাসের অগ্রন্থিত পাণ্ডুলিপি ‘এসএম সুলতানের শিল্পসাধনা ও জীবন দর্শন’-এর প্রথম অধ্যায় ‘সীমানা পেরুনো লালমিয়া’তে জানান—‘অত্র এলাকার হামিদ আলী, ইউসুফ গাজি, সরো দাই, গাফ্ফার মোল্লা এবং ফজলে করিম মোল্লার সঙ্গে কথা বলে সুলতান সাহেব বা লালমিয়ার বংশ পরিচয় সম্পর্কে জানতে পারি। তারা জানান, অত্র এলাকার বেহারাগন জমিদারদের পৃষ্ঠ পোষকতায় জমিজমা সংক্রান্ত বিষয় দলাদলি মারামারি করত। অন্যদলকে তারা ধাওয়া করে নিয়ে মারত। এই ধাওয়া করা থেকে মেছের আলীর বংশধরদের ধাউড়িয়া বলা হতো। ধাউড়িয়া মূলত কোনো উপাধি নয়। সুলতান সাহেবের দাদা কুরবান আলী এই ধাউড়িয়াদের একজন। সুলতান সাহেবের বাবা মেছের আলীর বয়স যখন চার-পাঁচ বছর, তখন তাঁর দাদা কুরবান আলী মারা যান। তখন মেছের আলীর মা জীবন জীবিকার তাগিদে নড়াইলের ভাওয়াখালী গ্রামে স্বগোত্রীয় বেহারাদের কাছে চলে আসেন। তাদের কাছে জায়গা না পেয়ে মাছিমদিয়া গ্রামে চলে আসেন।’
লেখক অন্যত্র জানান—‘মেছের আলী গোত্র পরিচয়ে বেহারা সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন। তাই সমাজের লোকে তাদের নীচু বংশীয় মনে করতেন। যে কারণে স্থানীয় লোকের সঙ্গে তাদের খুব বেশি চলাচল ছিল না। গ্রামের সাধারণ ছেলে মেয়েরা মেছের আলীর ছেলে মেয়েদের অবজ্ঞার চোখে দেখত। মাছিমদিয়া গ্রামের মুজিবর রহমান,বর্তমান বাড়ি কুড়িগ্রামে। তিনি বলেন,মেছের আলী বেহারা সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন তাদের পূর্ব পুরুষেরা পালকিতে লোক বহন করত। এই মেছের আলীরই সন্তান-পঞ্চাশের দশকের প্রতিভাবান শিল্পী এসএম সুলতানের নাম উচ্চারিত হয়—শিল্পচার্য জয়নুল আবেদিন ও কামরুল হাসানের সঙ্গেই।’
গ্রামবাংলার সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের জীবন আর গ্রামই এই শিল্পীর চিত্রকর্মের প্রধান বিষয়বস্তু। আবার অস্বাভাবিক পেশীবহুল শ্রমজীবী মানুষের বৈশিষ্ট্য নিয়ে এসএমসুলতান অন্যদের থেকে আলাদা। প্রকৃতির চেয়ে মানুষ জীবন্ত ও শক্তিশালী হয়ে প্রকাশিত হয়েছে-এসএম সুলতানের শিল্পকর্মে। ধান কাটা, ধান মাড়াই, চরদখল, মাছকাটা, ধানভানা ইত্যাদি নানারকম গ্রামীণ দৃশ্যের আবেগময় বহিঃপ্রকাশ এসএমসুলতানের চিত্রকর্ম।এ রকম একটি চিত্র কর্মে ‘পালকিতে বর-বধূ’ জলরংয়ে আঁকা এই দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে—শক্ত সমর্থ চার বেহারার কাঁধে পালকিতে যাচ্ছে বর ও বধূ। গায়ের এবড়ো খেবড়ো পথ। পথে দাঁড়িয়ে আছে দুই জন নারী। একজনের কোলে শীর্ণদেহ শিশু। বেহারাদের সঙ্গে ছুটছে একটি কুকুর। গাঁয়ের এই নিখুঁত চিত্র আঁকায় এসএম সুলতানের জুড়ি মেলা ভার।
এভাবে দেখা যাচ্ছে যে চিত্রকলায় পালকির উপস্থিতি একেবারে বিরল নয়। তবে বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদের পেইন্টিং বিভাগের ছাত্রদের সঙ্গে কথা বললে,তারা জানায় বর্তমানে আমাদের সময়কেই প্রাধান্য দিচ্ছি। আমাদের দেখা গ্রাম, আমাদের দেখা নিসর্গের ছবিই আমরা আঁকছি। আমাদের দেখা গ্রামীণ জগতে তো পালকি নেই। তবে হ্যাঁ, টুকটাক কাজ যেমন বৈশাখকে উপস্থাপন করতে গেলে আমরা দেয়াল চিত্রে হয়তো একটা কুলা, হাতি ঘোড়া কিংবা একটা পালকি এঁকে দিলাম, ব্যাস, এটুকুই। এ প্রসঙ্গে ক্রাফট ডিপার্টমেন্টের প্রভাষক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেনের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, এখন তো অন্যরকম সময়। আমি যখন এখানেরর ছাত্র ছিলাম, অনেকটা খেয়ালের বসেই পালকি এঁকেছিলাম। হয়তো খুঁজলে সেটা পাওয়া যাবে। সেখানে কাগজে সেলাই ফোড়ের আদলে পটভূমি তৈরি করে পালকিটি এঁকেছেন তিনি। তবে একথা ঠিক যে, বর্তমান সময়ের চিত্রকর্মে পালকির উপস্থিতি একেবারেই নেই বললে চলে।
গ্রাফিক ডিজাইনে পালকি
প্রচার ও প্রকাশনার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বিষয় হলো গ্রাফিক ডিজাইন। মূলত কোনো তথ্য উপস্থাপনের জন্য দৃশ্য ভাষার ব্যবহারিক মাধ্যমই হলো গ্রাফিক ডিজাইন। এ জন্য টেলিভিশন পত্র-পত্রিকা, বই পত্রসহ যাবতীয় প্রকাশনা, বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড, ব্যানার, ফেস্টুন ইত্যাদি গ্রাফিক ডিজাইনের অধিকারভুক্ত।
‘প্রাচীনকালে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মপ্রচারকেরা নিজ ধর্মের মহিমা ও ধর্ম প্রণেতার গুণকীর্তন চিত্রিত করে সেগুলো প্রচার করতেন। পটুয়ারা চিত্রিত পট প্রদর্শন করত গান গেয়ে গেয়ে। এগুলো নকশা ও অঙ্গসজ্জার বিচারে গ্রাফিক ডিজাইন।’ (শাওন আকলা: গ্রাফিক ডিজাইন:: চারু ও কারুকলা পৃ: ১৭৫)।
তবে পাল আমলের পুঁথিচিত্রগুলো বাংলাদেশের গ্রাফিক ডিজাইনের চমৎকার নিদর্শন। এসব চিত্রের বিষয়বস্তু ছিল বৌদ্ধ ধর্ম বিষয়ক।বাংলাদেশে আধুনিক গ্রাফিক ডিজাইনের সূত্রপাত হয় কোম্পানি আমলে আঠারো শতকের শেষ দিকে ছাপাখানার বদৌলতে। সেই সময় কাঠের ব্লকে,কপার প্লেটে এবং লিথোপদ্ধতিতে গ্রাফিক ডিজাইন করা হতো। বর্তমানে বাংলাদেশে অফসেট মুদ্রণে পোস্টার ক্যালেন্ডার, বিভিন্ন ধরনের বই, কাটুন, কার্ড ছাপা হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে ১৮১৬ সালে ভারত চন্দ্রের অন্নদা মঙ্গলেই হল প্রথম সচিত্র বাংলা বই যেখানে ঠাঁই পেয়েছিল ছয়টি ছবি। (প্রাগুক্ত: পৃ: ১৮৭)। এরপর ১৮২২ সালে কলকাতা স্কুল-বুক সোসাইটি থেকে জন লনসন প্রকাশকরে প্রথম সচিত্র বাংলা মাসিক পত্রিকা পর্শ্বাবলী।এ পত্রিকায় প্রকাশিত ছবিগুলো ছিল হাতে আঁকা এবং কাঠে খোদাই করা। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বিশ শতকের প্রারম্ভে ঠাকুরমার ঝুলির মাধ্যমেই গ্রন্থচিত্রণ ও প্রচ্ছদশিল্প বাংলার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করতে সক্ষম হয়।এরপর উপেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমা রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক সমৃদ্ধ হয়েছে গ্রন্থচিত্রণ ও প্রচ্ছদশিল্প। এ প্রসঙ্গে পৃথিবীবিখ্যাত চলচ্চিত্রত্র ব্যক্তিত্ব সত্যজিৎ রায়ের নামও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ঢাকায় গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্ট প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলাদেশের প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণের ইতিহাসে সংযুক্ত হয় অবিস্মরণীয় আরও কিছু নাম। বাংলাদেশের বইয়ের প্রচ্ছদ অলঙ্করণের ক্ষেত্রে অগ্রপথিক যারা, তাদের মধ্যে কাজী আবুল কাশেম, জয়নুল আবেদিন, পটুয়া কামরুল হাসানের নাম উল্লেখযোগ্য। জয়নুল আবেদিনের করা জসিমউদ্দীনের নকশী কাঁথার মাঠ, রঙিলা নায়ের মাঝি, বেদের মেয়ে, মাটির কান্না প্রভৃতি বইয়ের প্রচ্ছদ অলঙ্করণে লক্ষ করা যায় দেশজ উপাদান ও গ্রামীণ জীবনের অনুষঙ্গ। আর এভাবেই গ্রন্থচিত্রণ ও প্রচ্ছদশিল্পকে এক অন্যন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করে তারা আজ আমাদের নমস্য হয়ে আছেন।
বইয়ে পালকি
একটি বইয়ের প্রচ্ছদ হলো এমন একটি দৃশ্যভাষা, যার মাধ্যমে সম্পূর্ণ বইটির বক্তব্য প্রকাশ পায়। মামুন কায়সার সৌন্দর্যমণ্ডিত বিশেষ ধরনের মোড়ককেই বলেছেন প্রচ্ছদ। অর্থাৎ ‘সৃষ্টিধর্মী যেকোনো রচনার মুড বা মৌলিক চিন্তা অথবা উপলব্ধিকে আবলম্বন করে মলাটে রূপ দেওয়াই হলো প্রচ্ছদের কাজ।’ (বাংলা বইয়ের প্রচ্ছদ: মামুন কায়সার পৃ:১)।
প্রচ্ছদে বইয়ের বক্তব্যই মূর্ত হয়ে ওঠে। ফলে শিল্পীকে রচনার বক্তব্য অনুধাবন করার ক্ষেত্রে সচেষ্ট ও সতর্ক থাকতে হয়। এক্ষেত্রে প্রচ্ছদ দুই প্রকার। পাঠকভিত্তিক ও বিষয়বিত্তিক। পাঠকভিত্তিক যেমন-ছোটদের বই, বড়দের বই। আর বিষয়ভিত্তিক যেমন কবিতা, গল্প, ছড়া, উপন্যাস-জীবনী, নাটক, ইতিহাস, সায়েন্স ফিকশান, সমালোচনা, গষেণা, সংকলন, লোকজ গল্প, ধমীয় রচনা ইত্যাদি। এসব বিষয়ের ভেতরের ভাবগত অনুষঙ্গও রয়েছে, যা প্রচ্ছদশিল্পীকে উপলব্ধি করে বুঝে নিতে হয়।
পালকি লোকজ একটি উপকরণ। গ্রামীণ বাংলার ঐতিহ্য। বাংলা বইয়ের অন্যান্য অনুষঙ্গের সঙ্গে পালকির উপস্থিতিও লক্ষ করার মতো। পঞ্চাশের দশকে মানিক বন্দোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র তিনরঙা প্রচ্ছদের দৃশ্যচিত্র প্রায় সকল সাহিত্যানুরাগী পাঠকের মনকে নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছিল। সবুজাভ ধূসর ইটরং লাল ও কালোর তিন রঙা প্রচ্ছদটি আঁকেন বিশিষ্ট শিল্পী ইমদাদ হোসেন। প্রচ্ছদের নিচে একটি লৌকিক বা লোকজ নকশার প্যানেলে গ্রাম্য নারী,পালকি কাঁধে বেহারা, একপাশে হাতি অন্য পাশে ঘোড়ার ওপরে ও নিচে দুটো করে পাতার নমুনা চিত্র অঙ্কিত হয়েছে।
উপন্যাসটিতে মানিক বন্দোপাধ্যায় একটি নারীর মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। গ্রামীণ নারী পালকি ও পালকি বাহকের উপস্থিতি এই প্রচ্ছদটিকে তাই বিশেষ ব্যঞ্জনা দান করেছে। বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট গবেষক আশরাক সিদ্দিকীর গবেষণাগ্রন্থ—‘লোকসাহিত্যে’র প্রচ্ছদ এঁকেছেন প্রচ্ছদশিল্পী মোহাম্মদ ইদরিস। চার রঙের এই প্রচ্ছদের ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে মনে হবে যেন একটি নকশী কাঁথার পটভূমি। কাঁথা স্টিচের আদলে সেখানে চিত্রিত হয়েছে লতা-পাতা ফুল। প্রচ্ছদটিকে তিনটি অংশে ভাগ করে নেওয়া হয়েছে। ওপরের অংশে চিত্রিত হয়েছে দুই বেহারার কাঁধে পালকির দৃশ্য। নিচে হাতির পিঠে মানুষ এবং মাঝ খানে বই ও লেখকের নাম। বইয়ের নামটিও করা হয়েছে সেলাই ফোঁড়ের আদলে। মোহাম্মদ হানিফ পাঠানের ‘উত্তর বঙ্গের মেয়েলীগীত’ বইয়ের এরকমই একটি ফর্ম ব্যাবহার করেছেন তিনি। প্রচ্ছদটিকে ৫টি ভাগে বিভক্ত করে তিনি এক ভাগে কলসি,পালকি এবং চিরুনী বা কাঁকই আঁকেন। বিষয় তিনটি গ্রামীণ নারীর ব্যাবহার্য উপকরণ।
বিয়ের কার্ডে পালকি
একটি বিয়ের কার্ড বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে দেখা যায় বধূবেশী কনেকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে দুইজন বেহারা। আর গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে টাঙ্গানো ব্যানারে পালকির দৃশ্য একেবারেই বিরল নয় এ যুগেও। বিচিত্র রঙে তুলির আঁচড়ে কখনো শোলাশিল্পের মাধ্যমে চিত্রিত করা হয় বিয়ের মণ্ডপ।
শুধু ব্যানার নয় পালকির ওপর উপস্থাপন লক্ষ করা যায় ক্যালেন্ডারেও। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিখ্যাত সব শিল্পীর শিল্পকর্ম দিয়ে বিটিসি নানা রকম ক্যালেন্ডর তৈরি হয়। বিখ্যাত শিল্পীর র্শিপকর্ম ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিসর্গের আকর্ষণীয় আলোকচিত্র ও তৈরি করে সেসব ক্ষেত্রেও পালকির উপস্থিতি লক্ষ করার মতো। পালকির উজ্জ্বল উপস্থিতি দেখা যায় বিয়ের নিমন্ত্রণ কার্ডে।
শোলাশিল্পে পালকি
বাংলাদেশের জলাভূমিতে শোলা চাষ হয় জ্বালানি হিসেবে। শোলার তেমন কোনো বাজার মূল্যও নেই, অথচ সেই শোলার তৈরি দৃষ্টিনন্দন শিল্পকর্ম প্রশংসা কুড়িয়েছে দেশে-বিদেশে। শোলা শিল্পের উদ্ভব এবং বিকাশ সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। শোলাশিল্পী গোপীনাথ চক্রবর্তীর তৈরি শিল্পকর্মের মধ্যে আছে পালকি। ছোট আকারের পালকির ডাফ বা বহদণ্ডটির সম্মুখ ভাগ হাতির মুখাকৃতির। পালকির ছাদ ইষৎ ঢালু। ছাদের ধার বা কার্নিশে তিনি ফুল ও পাতা দিয়ে সাজিয়েছেন: পাল্কীর বহির্দেয়াল ও দরজায়ও একইভাবে ফুল ও পাতার নকশা। সবটাই শোলা দিয়ে। বহদণ্ড পাল্কীরসঙ্গে এঁটে দেবার যে রশি তাও শোলার।
মার্বেল পাথরে পালকির শোপিচ
আজিজ সুপার মার্কেটে ‘মর্মর’ নামের দোকানটির মালিক ফারুক এইচ. খান। স্রেফ শোপিসের দোকান। নানারকম শোপিস আছে সেখানে।যেমন শহীদ মিনার, অপরাজেয় বাংলা, গরুর গাড়ি, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি প্রভৃতিরসঙ্গে রয়েছে পালকিও। মার্বেল পাথরের ভাস্কর্য বিষয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক নাছিমা হক মিতুর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘মার্বেল পাথরের ভাস্কর্য’ সাধারণত খোদাই করে করা হয়। তবে শোপিস করার জন্য ডাস্ট ব্যবহার করা হয়।শোপিস আলাদাভাবেই শিল্প। তবে কপি হয় বারবার,ছাঁচে ফেলে করা হয় বলে তা সত্যিকারের শিল্পকর্ম বলে স্বীকৃত হয় না। তিনি জানান, ভাস্কর্য তৈরির ইতিহাসে অন্তত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মার্বেল পাথরের কোনো পালকি বা টাইলস বা মার্বেল ফলকের কোনো দৃশ্যে পালকি বা বেহারার দৃশ্য খোদাই হয়েছে বলে মনে পড়ে না। সেই হিসেবে মার্বেল ডাস্টে তৈরি পালকির শোপিসই মার্বেল পাথরের একমাত্র উদাহরণ।
চলচ্চিত্র শিল্পে পালকি
আলোছায়ার গতিময় চিত্রই হচ্ছে চলচ্চিত্র। চলমান অবস্থায় বস্তুকে প্রত্যক্ষ করার আকাঙ্ক্ষা, বস্তুর গতিকে পুনরুৎপাদন করার ইচ্ছা থেকে চলচ্চিত্রের আবির্ভাব।
১৮৯৫ সালে ২৮ ডিসেম্বর লুৎমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয়ের মাধ্যমে প্রথম চলচ্চিত্র আবির্ভাবের মধ্যদিয়ে নিজের অজান্তেই চলচ্চিত্র বাস্তব ঘটনা নির্ভর একটি শিক্ষা ও বিনোদন মাধ্যম হয়ে গেল।এই বাস্তবতার কারণে চলচ্চিত্রে পালকির উপস্থিতি বিরল নয়। সত্যজিৎ রায়ের ‘গুপিগাইন রাখাবাইন’ ছবিতে খোলা পালকি বা ডুলি বা ডোল এর উপস্থিতি রয়েছে। বাস্তবতার জন্যই। টিপু সুলতান সিরিজে টিপু সুলতান শহিদ হওয়ার পর তার পরিবার পরিজন প্রাসাদ ত্যাগ করে পালকিতে চড়ে। এইরকম প্রয়োজনের দৃশ্যে পালকি এসেছে নানা সময় নানা ভাবে। কখনো বাঙালি মেয়ের বিয়ের দৃশ্যে কখনো সামন্ততান্ত্রিক বুর্জোয়া মনোভাবের উগ্রতা প্রকাশের জন্যে কিন্তু সেই উপস্থাপন কাহিনীর প্রয়োজনে, চরিত্রের প্রয়োজনে। সেই প্রয়োজন মেটানোর উপকরণটি একটি চরিত্র হয়ে ধরা দিল পরিচালক কামার জায়েদির ‘পালকি’ নামক রোমান্টিক চলচ্চিত্রে। সেই সময়ের দাপুটে অভিনেতা দম্পতি মোহম্মদ আলী জেযা এবং নাদিম এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন, একটি ত্রিভুজ প্রেমের গল্পকে এগিয়ে নিয়ে যায় পালকি। ব্যাকগ্রাউন্ডে সানাইয়ের সুরে পালকির উপস্থাপন প্রমাণ করে চরিত্র চিত্রণের ক্ষেত্রে এখানে মোহম্মদ আলী, জেবা কিংবা নাদিমের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। বাংলাদেশেও ‘পালকি’ নামে একটি চলচ্চিত্র রয়েছে।