শিউলি ফুল ও সন্ধ্যা
শিউলি ফুলের রঙ সাদা। যেসব ফুল পতঙ্গপরাগী, তারা সাদা রঙের হয়, তীব্র গন্ধযুক্ত হয় আর তারা রাতের বেলা ফোটে। শিউলি ভোরের ফুল। সেদিক থেকে শিউলি ফুলের সঙ্গে সন্ধ্যার সম্পর্ক রয়েছে। তবে তা অনেক দূর দিয়ে। কারণ উদ্ভিদ বিজ্ঞানের এই গল্প সাধারণের চোখে ধরা পড়ে না। সাধারণভাবে, সাদা চোখে, আমাদের কাছে শিউলি ভোরের ফুল। সারারাত ফুটে ফুটে— সকালে ঝড়ে পড়ে। আর অদ্ভুত মাদকতায় ভরিয়ে দেয় পৌষের সকাল। অন্ধকারে, পৌষের আমেজ মাখা রাতে শিউলি গাছের দিকে চোখ পড়লে, থোকা থোকা সাদা শিউলিমালায় গাঁথা গাছকে বড় রহস্যময় মনে হয়। যদিও সেই রূপের সঙ্গে আমাদের অধিকাংশেরই পরিচয় হয় না। আমাদের পরিচয় ঘটে তখন, যখন শীত আসি-আসি করছে, গুটি-গুটি করে এগিয়ে আনছে তার শীতলতা, ঠিক সেই সময়ে শিউলির সাজিয়ে তোলা ফুলের ডালা। তার সুবাসে মাতিয়ে তোলা ভোরের বাতাস। সাদা শিউলি তার সিঁদুর রাঙা বোঁটায় রাঙিয়ে তোলে সকালের আলো। কি অদ্ভুতভাবে সারাউঠোনে ছড়িয়ে থাকে, ভোরের শিশিরে মাখামাখি শিউলি। তার রূপ—শুধুই দেখার, উপভোগের, তা বর্ণনার নয়।
শিউলি ফুলের সঙ্গে পরিচয় আমার শৈশবে। পাশের বাড়িতে ছিল একটি শিউলি গাছ। তার এবড়োখেবড়ো গা। এখানে-ওখানে টিউমারের মতো উঁচু হয়ে থাকা শরীর। সারাগায়ে দিনমান নানা রকম পোকার সারি। শুয়োপোকার ঘোরাঘুরি আর তাদের লোভে পাখিদের ভীড়। শিউলি গাছের সঙ্গে তাই শুয়োপোকা, টুনটুনি আর দোয়েলের সঙ্গেও পরিচয় হয়। শুয়োপোকাসহ অন্যান্য পোকার লোভে এই দুটি পাখিই শিউলি গাছের কাছাকাছি থাকতো। আর টুনটুনি তো শিউলির ডালে ঘর বাঁধতো। সংসার সাজাতো নিজের ছানাপোনাদের নিয়ে। প্রথম পরিচয়ের শিউলি গাছটি ছিল সন্ধ্যাদের বাড়িতে। সেইসূত্রে গোধূলি লগ্নের পরের সময়টার সঙ্গেও আমার প্রথম পরিচয়। সন্ধ্যা, আমার বন্ধু। সে সূত্রে বন্ধু শব্দের সঙ্গেও প্রথম পরিচয়। তখন আমি স্কুলে যাই কি যাই না। আজ আর মনে করতে পারছি না। তবে আমার খেলার সঙ্গী ছিল সন্ধ্যা। ওর হাতের নখ ছিল অনেক বড় বড়। প্রায় প্রতিদিনই, খেলার সময় ঝগড়া-মারামারি হতো। কারণ বাড়ি ফেরার পর, আমার সারামুখে, গায়ে ওর নখের আঁচড়ের দাগ থাকতো। সেই সন্ধ্যাদের বাড়িতেই ছিল শিউলি ফুলের গাছ। তার ঝকঝকে সবুজ পাতা। ফুলের সাদা পাপড়ি, সিদুর রঙের বোঁটা—এক অদ্ভুত মাদকতায় আমরা ছেলেবেলা ভরিয়ে তুলেছিল। সারারাত শিউলি গাছ আমাদের জন্য তার শরীর থেকে ঝরিয়ে রাখতো শিউলি। সকালে ঘুম ভাঙার পর আমরা কুড়িয়ে এনে সাজিয়ে রাখতাম টেবিলে। মালা গাঁথতাম। সেই মালা দুপুরের আগেই শুকিয়ে যেতো। কিন্তু মাথার মধ্যে থেকে যেতো তার মন ভোলানো মিষ্টি গন্ধ। শুকিয়ে যাওয়া শিউলির সিঁদুর রাঙা বোঁটার রঙ থেকে আমাদের হাত রাঙিয়ে নিতাম। মনকে রাঙিয়ে নিতাম।
ভোরের শিউলি ফুল কুড়ানো নিয়েও আমাদের ঝগড়া হতো, প্রতিযোগিতাও ছিল। কে কার আগে ঘুম থেকে উঠে সব ফুল কুড়িয়ে আনতে পারে। আশপাশের অন্যান্য বাড়ি থেকেও ছেলেমেয়েও আসতো। তাই সকালে ঘুম ভাঙানোর জন্য মাকে বলে রাখতাম। যখন ভোরের আযান হয়, মা আমাকে ডেকে দিতেন। আকাশের রঙ থেকে অন্ধকার ফিকে হয়ে যায়নি, এমন সময়েও কখনো কখনো বেরিয়ে পড়তাম। আমাদের বাড়িটা ছিল আধাপাকা। ইটের দেয়াল, আর ওপরে টিনের ছাউনি। দরজা ছিল দুই পাল্লার কাঠের। এখন যেমন প্রতি বাড়িতেই দরজায় হ্যাজবোল, ঘোরানো নব দেখা তখন এমনটা দেখিনি। হয়তো শহরে ছিল, কিন্তু আমি দেখিনি ওই সময়। আমাদের দুই পাল্লার কাঠের দরজার দুপাশে লাগানো ছিল দু’টি গোল বলের মতো কড়া। আর নিচের দিকে একটি শিকল। ভোরে যখন শিউলি কুড়াতে বেরুতাম, তখন বাইরে থেকে সেই শিকল তুলে দিয়ে যেতাম। অন্য পাশের আরেকটি ঘরের দরজা দিয়েও বাইরে বেরুনো যেত, ঘুম ভাঙলে প্রয়োজন হলে, অন্যরা সেদিক দিয়েই বেরুতো। সন্ধ্যাদের বাড়িটার পুরোই ছিল টিনের। বেড়া টিনের, ওপরের ছাউনিও টিনের। অন্যদের বাড়িতেও তাই। আমরা সবাই দরজার শিকল তুলে দিয়েই বেরুতাম।
প্রতিদিনের শিউলি ফুল কুড়ানোর মতোই, এক ভোরে— আমি বেরিয়েছি। আশপাশে কেউ নেই। সোজা দৌড়ে সন্ধ্যাদের বাড়ি। সেখানেও কেউ নেই। ওদের সারাউঠোনে ছড়িয়ে রয়েছে ভোরের শিউলি ফুলে। ধবধবে সাদা। এক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য। আমি দ্রুত ফুল কুড়াতে শুরু করি। অন্যরা আসার আগেই আমার কুড়িয়ে নিতে হবে সব ফুল। সবদিন এমন সুযোগ মেলে না। আমি যাওয়ার আগেই অন্যরা চলে আসে, তখন তুমুল প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়তে হয়। কখনো কখনো গায়ে গা লেগে যাওয়ায় মারামারিও হয়ে যায়। তাই সেদিনের সুযোগ আমি ভালোভাবেই কাজে লাগাতে থাকি। ফুল কুড়াতে কুড়াতেই একসময় আমার কেমন যেন লাগে। কেউ নেই, কেউ আসছে না। একটা অদ্ভুত নীরবতা। নীরবতার ভয়ঙ্কর রূপের সঙ্গেও সম্ভবত সেদিনই আমার প্রথম পরিচয়। কাছে পিঠে ওদের বাড়ির কুকুরটাকেও চোখে পড়ে না। দরজার দিকে তাকাই, যথারীতি শিকল তুলে দেওয়া বাইরের থেকে। তারমানে সন্ধ্যা বেরিয়ে গেছে। কিন্তু পুরো বাড়িটা জুড়েই কেমন রহস্যময়তা। আমার মন কেমন করতে থাকে। অন্যদিন কুকুরটা ঘরের দরজায় বসে থাকে। কখনো এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে চলে যায়। আজ কুকুরটাও নেই। বাড়ি জুড়েই শূন্যতা। আমার ভয় লাগে। কেন যেন অস্বস্তি লাগতে থাকে। আমি হাতের ফুলগুলো ফেলে দিয়ে দৌড়ে বাড়ি চলে আসি। বাড়িতেও কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি। কলপাড় থেকে কোনোমতে পা ধুয়ে এসে, দরজার শিকল খুলে ঢুকে পড়ি ঘরে। মায়ের পাশে গুটিশুটি মেরে আবার ঘুমিয়ে পড়ি।
সকালে যখন ঘুম ভাঙে, তখন বাইরে বেশ রোদ। উঠোন ভর্তি আলো। আমাদের বাড়িতে, বাড়ির বাইরে আশপাশের মানুষদের জটলা। বড়রা ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। নানারকম কথাবার্তা বলছে নিজেদের মধ্যে। কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে সবার কথার বিষয়ই সন্ধ্যাদের নিয়ে, তা বুঝতে পারি। কানে ঘুরেফিরে আসতে থাকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যার মা, সন্ধ্যার বাবার নামগুলো। সেইসব কথামালার ভেতর থেকে একসময় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, সন্ধ্যারা নেই। রাতের অন্ধকারে ওরা কাউকে কিছু না বলেই চলে গেছে। চলে গেছে? কোথায়? তাও একসময় জানা হয়, ইন্ডিয়া নামের একটি দেশ আছে। দেশ শব্দটার সঙ্গেও ওই আমার প্রথম পরিচয়। ওরা কাউকে কিছু না বলে, অন্ধকারে আমার কাছে অজানা এবং প্রথম শোনা সেই দেশে চলে গেছে।
চলবে…