বাংলায় গদ্যচর্চার ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয়। চর্যাপদের কাল থেকে কয়েকশ বছর যে সাহিত্য চর্চা হয়েছে, তা মূলত পদ্য বা কবিতাই। এই কবিতা বা পদ্যের প্রতি মানুষের মোহ ছিল বেশি। এর অবশ্য যথার্থ কারণও ছিল। লেখার সামগ্রী ছিল না বললেই চলে। মানুষ শুনে-শুনে মনে রাখত। গুরুত্বপূর্ণ সব বয়ানই পদ্যাকারে রচিত হতো। নানারকম মন্ত্রোচ্চারণ, তা জাদুটোনার হোক বা ধর্মেরই হোক, কিংবা হোক ঝাড়ফুঁক জাতীয় কিছু। এমনকি অন্যান্য চিকিৎসা-সংক্রান্ত— সবই সৃষ্টি হতো পদ্যে। ছন্দ, অন্তঃমিল ও অনুপ্রাসের দোলায় এগুলো মানুষের মনে সহজেই গেঁথে যেত। কিন্তু এরপর যখন কাগজ সহজলভ্য হলো, ছাপানোর প্রযুক্তি চলে এলো; তখন মানুষ গদ্যের দিকেই ঝুঁকলো ক্রমান্বয়ে।
সাহিত্য রচিত হতে থাকল মানুষের কথাবার্তার অনুসারী হয়ে। যদিও পদ্য বা কবিতার প্রতি মানুষের ভালোবাসা কমল না, কিন্তু বিস্তৃত ও অকৃত্রিমভাবে প্রকাশ করা যায় বলে মানুষ গদ্যকে প্রাধান্য দিতে থাকল। বাংলাদেশে গদ্যচর্চার বিভিন্ন দিক আলোচনা করার আগে খোলাসা করে নেওয়া প্রয়োজন—গদ্য হিসেবে কোন প্রকরণগুলো বিবেচনা করা হবে বা আলোচনা করা যাবে কোন-কোন আঙ্গিকের রচনাকে।
গল্প-উপন্যাসও গদ্যের শরীর নিয়ে সৃষ্টি। কিন্তু এগুলোর ক্ষেত্র ও আবেদন এবং মুক্তগদ্য ও প্রবন্ধের আবেদন আলাদা। একত্রে ওসব কিছুকেই গদ্যসাহিত্য বা কথাসাহিত্য বললে অন্যায্য কিছু হয় না। কিন্তু প্রবন্ধ বা মুক্তগদ্য যে কাজ করে, গল্প বা উপন্যাস তা করে না। যে-কোনো গল্প বা উপন্যাসকে ব্যবচ্ছেদ করে বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ লেখা যায়। কিন্তু গল্প বা উপন্যাস কখনোই অনুরূপ দায়িত্ব পালন করে না। গল্প-উপন্যাস সাধারণত কাহিনিকে প্রাধান্য দেয়। তবে কোনো লেখক ইচ্ছা করলে প্রবন্ধের মতো করে না হলেও উপন্যাসের আদল ঠিক রেখেও প্রবন্ধের কোনো বিষয় তুলে ধরতে পারেন উপন্যাসে কথকের বয়ানে কিংবা পাত্রপাত্রীর মুখ দিয়ে। অর্থাৎ প্রাবন্ধিক যে কথাগুলো লিখবেন, একজন ঔপন্যাসিক চাইলে এর সব কিছুই উপন্যাসের মাধ্যমে পাঠককে জানান দিতে পারেন। কাজেই গদ্যচর্চার ইতিবৃত্ত নিয়ে আলোচনার সময় সব কিছুর প্রতিই মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। তবে মূল বা চুম্বক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে প্রবন্ধকেই।
দুই. গদ্যচর্চার ক্ষেত্রে বিষয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র— সাধারণত সাহিত্য অনেক কিছুই তার অন্তর্ভুক্ত হিসেবে গ্রহণ করে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, জীবনের অভিজ্ঞতা, ধর্মচর্চা, দর্শন, নারীবাদ, প্রেম, যুদ্ধ—এমন অনেক কিছুই অনায়াসে জায়গা পেতে পারে উপন্যাস, গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধে। প্রবন্ধ ও মুক্তগদ্যও সব কিছুকেই অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষপাতী। উল্লিখিত বিষয়গুলো ছাড়াও নির্দিষ্ট গ্রন্থ, উপন্যাস, গল্প ও কবিতার মূল্যায়নধর্মী মুক্তগদ্য লেখা চলে। বিষয়বস্তু যাই হোক না কেন, রচনার মান বা উৎকর্ষ-ই আসল। এক্ষেত্রে আলাদা করে দেখতে হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যসূচিমুখী কাজ এবং মৌলিক সাহিত্য অভিমুখী রচনাগুলো। যখন দর্শনশাস্ত্র নিয়ে গদ্য লেখা হবে পরীক্ষার খাতা ভরাট করার উদ্দেশ্যে, তখন তার আঙ্গিক ও চরিত্র অবশ্যই মৌলিক সাহিত্য তৈরির উদ্দেশ্যে রচিত দর্শনবিষয়ক প্রবন্ধ থেকে আলাদা হবে।
শ্রেণীকক্ষে শিক্ষক সাধারণত একই বিষয়ে প্রতি বছর নির্দিষ্ট শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের একই তত্ত্ব ও তথ্যের শিক্ষাদান করেন। নতুন ও মৌলিক সৃষ্টির চেয়ে বড় হয়ে ওঠে অভ্যস্ততা। শিক্ষার্থীও অনুরূপভাবে উত্তর তৈরি করে মাত্র। সে যা লেখে তা তার সহপাঠীরাও লেখে। এরমধ্যে কারো খানিকটা হয়তো ভালো হয়। এর বেশি কিছু আশা করার অবকাশ এখানে নেই। আমরা অনেক পিএইচডি ডিগ্রির থিসিস-কর্মকে বই আকারে দেখতে পাই এবং এসব উচ্চসাহিত্য মূল্যের প্রকাশনা বলেও গণ্য করি। কিন্তু এগুলোও মূলত পরীক্ষা পাসেরই অভিলাষী ক্রিয়া। রুটিনবাঁধা কিছু কাজ ও গবেষণার সঙ্গে মৌলিক সত্যকে উদ্ঘাটন প্রয়াসকে এক করে দেখা হলে তা আত্মঘাতী হতে বাধ্য। ইংরেজি সাহিত্যবিষয়ক উপযুক্ত গদ্যের অভাবে আমরা অনেক সময়ই ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপকদের ধরাবাঁধা কাজের প্রতিই মনোযোগ দিই; কিন্তু আমাদের বিবেচনা করতে হবে সামগ্রিকরূপ নিয়ে।
শেক্সপিয়ার কিংবা টিএস এলিয়ট বা র্যাঁবো বিষয়ে এক বাঙালি অধ্যাপকের লেখা আমাদের কাছে চিত্তাকর্ষক ও চমকপ্রদ বলেও মনে হতে পারে; কিন্তু তাতে কি আসলে তার মৌলিক কোনো অনুধাবন থাকে? উল্লিখিত কবিদের রচনাগুলো ও তাদের সামাজিক পরিবেশের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তাদের দেশীয়রাই ভালো জানবেন।
এভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক গদ্যগুলো আপাত চাকচিক্যময় বটে; কিন্তু কোনো নতুন বা মৌলিক সত্য আবিষ্কার করে না। যখন অনুসরণের প্রশ্নটি সামনে চলে আসে তখন আগামীর সাহিত্য রচনার পথটি যথার্থ উজ্জ্বল করার প্রয়োজনে ওইসব রচনাকে বর্জনীয় বলে মত দেওয়াও জরুরি হয়ে উঠতে পারে; কিন্তু ঢালাওভাবে সব অধ্যাপককে বাতিল করার অবকাশ নেই। অনেক অধ্যাপক রয়েছেন, যারা প্রকৃতই সাহিত্যিক এবং পাঠদানমূলক পেশাগত ক্রিয়াকে উপেক্ষা করে প্রকৃত সৃজনশীল ও মননশীল রচনায় নিয়োজিত। তারা মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহারে যত্নবান এবং অনেকেই সাহিত্যের ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন। মৌলিক ও শ্রেষ্ঠ রচনার সূত্র ধরে আমরা বিবেচনা করতে পারি বাংলা ভাষায় গদ্যরচনার সূচনাকালটি। একথা আজ বলার উপায় নেই যে, ইংরেজদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান ব্যতিরেকে আমাদের গদ্য কেমন হতে পারত। আমাদের কথাসাহিত্য চরমভাবে পাশ্চাত্যনির্ভর হয়ে যাত্রা শুরু করে। দখলদার ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতায় তাদেরই উপন্যাসের আদলে তৈরি হয়েছে বিখ্যাত বাংলা উপন্যাসগুলো।
একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও জীবনধারার হাজারো মৌলিকত্ব সত্ত্বেও আমাদের উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীর মেজাজ-মর্জি, কথাবার্তা এমনকি কাহিনি-বিন্যাস, প্রকরণ ও ঢঙ হয়ে উঠল ভিনদেশের উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীর মতো। অত্যাচারী ইংরেজ শাসকরা এ দেশের গ্রামীণ ও সাধারণ জনগোষ্ঠীর জীবনকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছিল। ফলে গদ্য সাহিত্যের অভিযাত্রায় বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ একেবারেই তৈরি হয়নি। সাহিত্য রচিত হতো প্রধানত কলকাতার বাবু সম্প্রদায়ের হাতে। তাদের মধ্যে চতুর আইনজীবী, ব্যবসায়ী, ভূস্বামী বা জমিদার এমনকি অনেক কেরানি শ্রেণীর চাকরিজীবীও ছিলেন। এসব লোক তাদের শ্রেণীচেতনা সমুন্নত রেখে এবং খানিকটা যশের অভিলাষী হয়ে সহজ পন্থায় যে-কোনোভাবে লিখতেন। এর বাইরে প্রতিবাদী চেতনায় কিছু-কিছু সাহিত্য রচিত হতো। কিন্তু ওইসব লেখা ইংরেজ সরকার প্রায়ই বাজেয়াপ্ত করত এবং লেখকদের জেল-জরিমানা দ- দিত। কাজেই গদ্য রচনার পরিবেশটি মোটেই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না—এটা সহজেই বোঝা যায়। এর বাইরে সাম্প্রদায়িক বিভেদ যথেষ্ট ছিল এবং কিছুসংখ্যক লেখকের লেখনী একমাত্র এই উদ্দেশ্যেই চালু ছিল। বাংলা কবিতা যেমন লাখো মানুষের ভালোবাসা ও অবাধ ও উদ্দেশ্যহীন নির্মলতায় সৃষ্টি হতে পেরেছে গদ্যের ক্ষেত্রে সে রকম কিছু বলা যায় না। বাংলা গদ্যকে বর্তমান অবস্থায় আসার ক্ষেত্রে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে দীর্ঘকালব্যাপী। বাংলাদেশের গদ্যচর্চা মূলত ওই সংগ্রামের অংশ এবং ফল।
তিন. বাংলাদেশে ঠিক এ সময়ে গদ্য লিখছেন এমন কয়েকশজনের নাম ও গ্রন্থ-পরিচয় লিপিবদ্ধ করা সম্ভব। প্রশ্ন হচ্ছে এই যে, এত অধিকসংখ্যক লেখক থেকে সামগ্রিক কী লাভ হচ্ছে সাহিত্যের? সমাজকে বদলে দেওয়ার মতো, শিহরিত করার মতো লেখক দুই-তিনজন থাকলেও তো অনেক কাজ হয়। সংখ্যাগত বিষয়ের চেয়ে গুণগত দিককেই তো প্রাধান্য দেওয়া উচিত। কয়েকশ লেখকের কয়েক হাজার গ্রন্থ থেক কয়টা গ্রন্থ বাছাই করা যাবে বিশ্বসাহিত্য অঙ্গনের জন্য? কিংবা এমন কয়জনকে আমরা শনাক্ত করতে পারব— যাদের লেখা আমূল পরিবর্তন আনতে সক্ষম বিশ্বের প্রচলিত চিন্তা-চেতনার? উত্তরটি না-বোধক হওয়া উচিৎ হবে না, আবার খুব বেশি আশান্বিত হওয়ার মতোও কিছু নেই আমাদের জন্য। তবু যারা স্রোতের বিরুদ্ধে শক্তভাবে দাঁড়িয়েছেন, জান-মালহানির মতো ঘটনাকেও মেনে নিয়েছেন, সে রকম প্রাতঃস্মরণীয় লেখক আমাদের রয়েছেন। ইতোপূর্বে এই আলোচনায় ব্রিটিশ শাসনামলের দুর্দশার কিঞ্চিৎ উল্লেখ করা হয়েছে। পরবর্তী কালকেও আমরা বিবেচনা না করে পারি না। ১৯৪৭ সালে ইংরেজদের কাছ থেকে এই উপমহাদেশ যখন স্বাধীন হলো এবং নতুন রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নিল এই ভূখ-টিও, তখন জাতি নতুনতর চিন্তা-চেতনার উদ্দীপনায় জাগ্রত হয়েছিল সন্দেহ নেই; কিন্তু একই সঙ্গে হিন্দু-মুসলমান কিংবা মুসলমান-শিখ দাঙ্গার ভয়ঙ্কর চিত্রও তার মনে জেগেছিল দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে নতুন আশা-আকাক্সক্ষায় সাহিত্য রচনার ঢেউ জাগল।
ভাষাব্যবহার, বাক্যবিন্যাস রীতি, উপমা প্রতীকের ব্যবহার প্রভৃতি লক্ষ্যণীয়ভাবে বদলে যেতে থাকল এ সময়ে। সাহিত্যের কেন্দ্র কলকাতা থেকে সরে এসে ঢাকাকেন্দ্রিক হলো এবং একই সঙ্গে মুসলিম ঐতিহ্য ও মিলের ব্যবহারের মধ্যে নিজেদের স্বরূপকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা দেখা গেল। নতুন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার চলমানতা উঠে আসতে শুরু করল অনেক গল্প-উপন্যাসে; কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি বদলে গেল এবং সামনে চলে এলো ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীকারের প্রশ্নটিও।
এরপর ঝঞ্ঝামুখর রাজনৈতিক পরিবেশে সাহিত্যচর্চার চেয়ে অধিকার আদায়ের স্লোগান ও মিছিলই বড় হয়ে উঠল। এরকম অস্থিরতা ও আন্দোলনের ভেতর দিয়ে চলে এলো ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে অসংখ্য প্রতিভা হারানোর পরও বাঙালি নতুন উদ্যমে নতুন আশায় দেশগড়ায়, সাহিত্য রচনায় ব্যাপৃত হলো; কিন্তু ভাঙন ও ধ্বংসের খেলা থেকে প্রকৃত পক্ষে এ দেশের সহসা মুক্তি মিলল না। স্বার্থসিদ্ধি ও রাজনৈতিক মেরুকরণের খেলা শুরু হয়ে গেল চরমমাত্রায়। নতুন বিপ্লবী তত্ত্বে আকৃষ্ট হলো এ দেশের সিংহভাগ মেধাবী তরুণ; চলল নৈরাজ্য, হত্যা, ধ্বংস ও দুর্ভিক্ষের লীলাখেলা। এতসব বাস্তবতার আগুনে পুড়ে মানুষের চিত্ত বদলে গেল এবং সাহিত্য সব ঔপনিবেশিক বন্ধন ও কলকাতার বন্ধন ছিন্ন করে একেবারেই এদেশীয় হয়ে উঠতে শুরু করল।
চার. অনেক কবি আছেন, যারা প্রধানত নিজের ও অন্যের কবিতাকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে গদ্য লেখার জন্য কলম ধরেন। কবিতার ভাষাভঙ্গি যুগোপযোগী কি-না, ছন্দের শ্রেণীবিভাগ, নানারূপ অলঙ্কার ব্যবহারের প্রয়োজন বা যৌক্তিকতা, পরাবাস্তবতার বোধ— এসবই পাঠককে জানান দেওয়ার ধরনই ঠিক করে দেয় তাদের গদ্যের মূল বিষয়। দুর্বোধ্যতা কোন পর্যায়ের হতে পারে, আধুনিক ও উত্তরাধুনিকতার প্রবণতাগুলো কেমন— এমন সব বিষয়ও তাদের গদ্যে স্থান পায়। এই শ্রেণীর লেখকরা প্রধানত কবিতাবিষয়ক গদ্যই লিখেন, তবে কেউ-কেউ ব্যতিক্রমও আছেন। সাধারণ পাঠকের চেয়ে কবিদের নিকটই এসব গদ্যের কদর বেশি। জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধ অনেক কবির কাছে আজো সমান আদরের। তার ‘কবিতার কথা’র প্রথম বাক্য ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’— বাক্যটি আজও অনেকেই কবিতার আলোচনায় ব্যবহার করেন। বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্তসহ ওই সময়ের অনেক কবিই গদ্যচর্চা করেছেন। তাদের গদ্য মূলত বিপুলভাবে বিদেশি সাহিত্য পঠন-পাঠনের পরিচায়ক। কবি লিখিত কবিতাবিষয়ক গদ্যের ধারাবাহিকতায় আরও অনেক কবি-গদ্যকারের নাম উল্লেখ করা যায়। অনেকের লেখাই মূলত সমালোচনামূলক প্রবন্ধ— যাদের লেখা দৃষ্টান্তস্বরূপ হয়ে আছে। এছাড়া গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধবিষয়ক প্রবন্ধ এবং সমাজনীতি, দর্শন, ধর্ম, রাজনীতিবিষয়ক প্রবন্ধের সংখ্যাও আমাদের প্রবন্ধ-সাহিত্যে নেহাৎ কম নয়। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের বিশেষ করে সাতচল্লিশের দেশভাগের পর থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত প্রবন্ধ লেখকের নাম উল্লেখ করতে গেলে যে নামগুলো উচ্চারিত হবে, তার সংখ্যাও প্রচুর। এই লেখার পরিসরের কথা বিবেচনা করে সবার নাম উল্লেখ সম্ভব নয়। তবে কিছুসংখ্যক নাম বলতেই হয়, যাদের লেখার সঙ্গে প্রায়ই সাক্ষাৎ ঘটে।
যারা সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সমাজ-চিন্তামূলক প্রবন্ধ লিখে প্রবন্ধের প্রতি পাঠককে আকৃষ্ট করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন— সৈয়দ আলী আহসান, হাসান হাফিজুর রহমান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, আহমদ শরীফ, সরদার ফজলুল করিম, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, সৈয়দ শামসুল হক, আবু বকর সিদ্দিক, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, যতীন সরকার, আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আব্দুশ শাকুর, রশীদ করিম, শামসুজ্জামান খান, ড. সফিউদ্দিন আহমদ, আহমদ ছফা, যতিন সরকার, সৈয়দ শামসুল হক, কামাল, হাসান আজিজুল হক, আকতারুজ্জামান ইলিয়াস, হায়াৎ মামুদ, আনিসুজ্জামান, মনসুর মূসা, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, আবদুল কাদির, নাজমা জেসমিন চৌধুরী, রফিকুল ইসলাম, ওয়াকিল আহমদ, সৈয়দ আকরম হোসেন, করুণাময় গোস্বামী, সৈয়দ আবুল মকসুদ, হুমায়ুন আজাদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, অসীম সাহা, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, সলিমুল্লা খান, ফরহাদ মজহার, রফিকুল্লা খান, আলতাফ হোসেন, সেলিম আল দীন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, মাহবুব সাদিক, মাহবুব হাসান, আবু জাফর, ময়ূখ চৌধুরী, আবু হাসান শাহরিয়ার, মনিরা কায়েস, ভুঁইয়া ইকবাল, আমিনুল ইসলাম আকিমুন রহমান, সরকার আবদুল মান্নান, শহীদ ইকবাল, জাকির তালুকদার, কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, হুমায়ুন মালিক, আহমাদ মোস্তফা কামাল, আবু হেনা মোস্তফা এনাম, সরকার আমিন, তপন বাগচী, সরকার মাসুদ, জাফর আহমেদ রাশেদ, সানজিদা আখতার, ফরিদা সুলতানা, বিশ্বজিৎ ঘোষ, ভীষ্মদেব চৌধুরী, মহীবুল আজিজ, মাসুদুজ্জামান, মাসুদুল হক, অনু হোসেন, হামীম কামরুল হক, চঞ্চল আশরাফ, আহমেদ স্বপন মাহমুদ, মজিদ মাহমুদ, আমিনুর রহমান সুলতান, শিরীন আখতার, অনীক মাহমুদ, আজহার ইসলাম, সৈকত হাবিব, চঞ্চল কুমার বোস, মজিদ মাহমুদ, আমীর খসরু স্বপন, আমিনুল ইসলাম, ফাহমিদুল হক, কামরুল হাসান, কুমার চক্রবর্তী, কাজী মহম্মদ আশরাফ, বীরেন মুখার্জী, মোহাম্মদ নূরুল হক, চন্দন চৌধুরী, মামুন রশীদ, মিজান রহমান, আর কে রনি প্রমুখ।
সরদার ফজলুল করিম দর্শন ও রাষ্ট্রনীতি বিষয়ে অসাধারণ সব ইতিহাস, ঐতিহ্য, রাজনীতি-সচেতনতার দিকগুলো নিয়ে কাজ করেছেন। মুনতাসীর মামুন ইতিহাস বিষয়েই লিখেছেন বেশি। ঢাকার ইতিহাস অনুসন্ধানে তার অনেক লেখা আলোকবর্তিকা স্বরূপ। মনসুর মূসার গদ্য প্রধানত ভাষাতত্ত্ববিষয়ক। ভাষা-সংশ্লিষ্ট ও সামাজিক অনেক বিষয়ে তার লেখা প্রবন্ধগুলো দৃষ্টি কাড়ে। সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রে যার মেধা ও মননশীলতা কিংবদন্তির পর্যায়ে বললে অত্যুক্তি হবে না তিনি হলেন সৈয়দ আলী আহসান। তিনি যেমন ছিলেন উঁচুদরের কবি, তেমনি কবিতা বিষয়ে তার চিন্তা-চেতনা ছিল অত্যন্ত উঁচু স্তরের। বিশ্লেষণধর্মী লেখার সঙ্গে-সঙ্গে নিজস্ব ভাষাভঙ্গি তৈরি করেছেন তিনি। তার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধের বইগুলো বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারকে করেছে সমৃদ্ধ। তার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’, ‘কবিতার কথা’, ‘কবিতার কথা ও অন্যান্য’ ও ‘আধুনিক কবিতা: শব্দের অনুষঙ্গে’। ড. আহমদ শরীফ প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। বাংলাদেশ ও বাঙালি সত্তার স্বরূপ সন্ধানমূলক তার লেখাগুলো মূল্যবান। সাহিত্য-চিন্তার ওপর তার অনেক গ্রন্থ রয়েছে। বাংলাদেশের নিজস্ব চিন্তা-চেতনার উন্মোচনের ক্ষেত্রে আরেকজন মনীষী হচ্ছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাস রচনায় তার অবদান অনস্বীকার্য। ‘বাংলা সাহিত্যের কথা’ নামে দুই খণ্ডের বইয়ে তিনি অনেক তত্ত্ব ও তথ্য উপস্থান করেছেন। যাতে বাংলা সাহিত্যের অনেক বিতর্কিত বিষয় মীমাংসা করা সহজ হয়েছে। চর্যাপদের ওপর মূল্যবান গবেষণা রয়েছে তার। চর্যাপদের কাল নির্ণয় এবং চর্যাপদ যে বাংলা ভাষায় রচিত তাও নিশ্চিত করেছেন তিনি। ভাষাতত্ত্ব, সাহিত্য-সমালোচনা, ধর্মতত্ত্ব ও গবেষণার মতো বিষয়গুলো তিনি তার প্রবন্ধের উপজীব্য করেছেন। হাসান হাফিজুর রহমানের প্রবন্ধ প্রধানত বিশ্লেষণাত্মক। তুলনামূলক আলোচনায় তিনি সিদ্ধহস্ত। তার প্রবন্ধগ্রন্থ ‘আধুনিক কবি ও কবিতা’ সমালোচনা-সাহিত্যে একটি ব্যতিক্রমী বই। একই রকমের গদ্যভঙ্গি আবু হেনা মোস্তফা কামালেরও। চিন্তার মুক্তি ও স্বদেশচেতনা ছিল তাদের রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য। তার উল্লেখযোগ্য বই হলো— ‘শিল্পের রূপান্তর’, ‘কথা ও কবিতা’। আরেক অসাধারণ গদ্যকার জিললুর রহমান সিদ্দিকী। তিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও কবি। ‘শব্দের সীমানা’ ও ‘আমার দেশ, আমার ভাষা’ তার উল্লেখযোগ্য দুটি বই। মুস্তাফা নূরউল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। কাজী নজরুল ইসলামের ওপর তার অনেকগুলো বই রয়েছে। কবির চৌধুরীর প্রবন্ধের বিষয় প্রধানত বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রিক। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিবুদ্ধি, সংস্কৃতির নানা বিষয়েও লিখেছেন তিনি। যতীন সরকারের প্রবন্ধ মুক্তিবুদ্ধি, মুক্তিযুদ্ধ ও দর্শনকেন্দ্রিক। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে— ‘সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা’, ‘বাংলাদেশের কবি গান’, ‘মানবমন মানবধর্ম ও সমাজবিপ্লব’ ও ‘পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু দর্শন’। আহমদ রফিক আরেকজন প্রখ্যাত প্রবন্ধকার। নজরুল-রবীন্দ্রনাথসহ বাংলাভাষার কয়েকজন বিখ্যাত কবির ওপর তার গবেষণামূলক গ্রন্থ রয়েছে। শিল্প -সাহিত্য ছাড়াও তিনি রাজনীতি ও সমাজ নিয়ে লিখেছেন। তার উল্লেখযোগ্য বইগুলো হলো— ‘আরেক কালান্তর’, ‘বুদ্ধিজীবীর সংস্কৃতি’, রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রচিন্তা ও বাংলাদেশ’। বদরুদ্দীন উমর লিখেছেন প্রধানত রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী অসংখ্য বিষয়ের ওপর সুচিন্তিত ও ঋদ্ধ প্রবন্ধ লিখেছেন। ‘সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা’, ‘বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি মধ্যবিত্ত’, ‘উনিশ শতকের বাংলা গদ্যের সামাজিক ব্যাকরণ’ তার উল্লেখযোগ্য বই। আহমদ ছফার প্রবন্ধ সমাজ-রাষ্ট্র-ধর্ম-সাহিত্যকেন্দ্রিক। বক্তব্য প্রকাশে তিনি অকপট। কোনো রকমের পরিমার্জন ছাড়াই নিজের কথা প্রকাশ করেছেন তিনি। ‘বাঙালি মুসলমানের মন’, ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’ প্রভৃতি গ্রন্থে তিনি বাঙালি মুসলমান ও মধ্যবিত্তের মানসপ্রকৃতি, সুবিধাবাদী আচরণ ব্যাখ্যা করেছেন। ধর্মনিরপেক্ষতা, সম্প্রদায়িকতাবিরোধী মনোভাব এবং সম্পূর্ণ বাংলাদেশি চেতনায় উজ্জীবিত ছিলেন তিনি। এই চেতনারই পরিপূর্ণরূপ আজ আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের গদ্যচর্চার ক্ষেত্রে। সব ধরনের ধোঁয়াশামুক্ত হয়ে আমাদের গদ্যকারগণ নিজস্ব উপলব্ধির কথা অনায়াসে লিখতে পারছেন। মানদণ্ডের উচ্চতা অনুযায়ী এটি শিখর স্পর্শ না করতে পারলেও সবার সমবেত অবস্থান সমতলকে যে সুসজ্জিত ও সুফলা করেছে সন্দেহ নেই। এরই সুবাতাসে বেড়ে উঠছে আগামীর দুর্লভ প্রতিভার চারা গাছ। এদিক থেকে হুমায়ুন আজাদ ব্যতিক্রমী— তার অধিকাংশ গদ্যই নিজের পাঠপরিধি জানানোর উদ্দেশ্যে রচিত। সলিমুল্লাহ খানের প্রবন্ধে সাহিত্যের অনুসঙ্গ হয়ে দর্শন, ধর্ম, ঐতিহ্য ও মিলের বিষয় নিয়ে কাজ অধিক দেখা যায় এবং একধরনের সরস ভাষাভঙ্গি দ্বারা তার লেখাগুলো স্বতন্ত্রমমণ্ডিত। আবুল মোমেনের ‘সংস্কৃতির সংকট ও সাম্প্রদায়িকতা’ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বই। তার প্রবন্ধের মূল বিষয় মানুষ-দেশ-রবীন্দ্রনাথ রাজনীতি। আবুল কাশেম ফজলুল হক, আবুল আহসান চৌধুরী, বেগম আখতার কামালের ভাষা ঝরঝরে। শিল্প-সাহিত্য থেকে শুরু করে সংস্কৃতির নানা দিক তাদের লেখার বিষয়। তবে আলাদা করে তাদের রচনাভঙ্গি সহজে শনাক্ত করা যায় না।
রশীদ করিম আরেকজন শক্তিমান গদ্যশিল্পী। কবিতা-ছোটগল্প-উপন্যাসই তার আলোচনার মূল বিষয়। বিশ্বসাহিত্যের পাঠ, ভাষাতত্ত্ববিষয়ক গবেষণায় ড. সফি উদ্দিন আহমেদ অনন্য। ‘বৃত্তাবদ্ধ রবীন্দ্রনাথ’ তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি। হাসান আজিজুল হক ও আকতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রবন্ধের বিষয় সাহিত্যকেন্দ্রিক। মূলত কথাসাহিত্যবিষয়ক। হায়াৎ মামুদ, আনিসুজ্জামান, রফিকুল ইসলাম, ওয়াকিল আহমদ, সৈয়দ আকরম হোসেন, করুণাময় গোস্বামী, সৈয়দ আবুল মকসুদের প্রবন্ধ সমাজ-রাষ্ট্র-সাহিত্য-ধর্ম-দর্শন-সঙ্গীতকেন্দ্রিক। আবার বহুমাত্রিক প্রাবন্ধিক আবদুল মান্নান সৈয়দ। প্রবন্ধে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা প্রান্তর চষে বেড়িয়েছেন তিনি। খোন্দকার আশরাফ হোসেনের প্রধান পরিচয় তিনি কবি। তবে সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধে তার দখল ছিল উল্লেখ করার মতো। ‘বাংলাদেশের কবিতা: অন্তরঙ্গ অবলোকন’ সমালোচনা সাহিত্যে ব্যতিক্রমী সংযোজন।
সলিমুল্লা খানের প্রবন্ধে মূলত লালন-নজরুল আর ভাবান্দোলনের প্রাধান্য। রফিকুল্লা খানের প্রবন্ধ মূলত সাহিত্যবিষয়ক, বিশেষত কবিতাকেন্দ্রিক প্রবন্ধে তিনি স্বতঃসিদ্ধ। ‘বাংলাদেশের কবিতা: সমবায়ী স্বতন্ত্রস্বর’ তার উল্লেখযোগ্য বই। আবু হাসান শাহরিয়ারের প্রবন্ধের বিষয় কবিতা, সমাজ, মিডিয়া এবং ব্যক্তিগত অনুষঙ্গ। কবিতার পাঠোদ্ধারমূলক গদ্যে বলা যায় তিনি এদেশে পথপ্রদর্শক। তার গদ্যে কেবল পাণ্ডিত্যের ছাপ থাকে না, হƒদয়ের ছোঁয়াও থাকে। ‘কবিতার বীজতলা’, ‘কবিতা অকবিতা অল্পকবিতা,’ ‘সমাত্মজীবনী’, ‘নৈঃশব্দ্যের ডাকঘর’, ‘কালের কবিতা কালান্তরের কবিতা’ প্রভৃতি গ্রন্থে তিনি সমাজ-রাষ্ট্র-মিডিয়া-শিল্পসাহিত্য সম্পর্কে নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। জাকির তালুকদারের প্রবন্ধ মূলত কথাসাহিত্যকেন্দ্রিক। সরকার মাসুদ বিদেশি সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়ে অনেক গদ্য লিখেছেন, কামরুল হাসানের লেখার বিষয় বিস্তৃত। আহমাদ মোস্তফা কামালের গদ্যের বিষয় প্রধানত ছোটগল্প। ‘শিল্পের শক্তি, শিল্পীর দায়’ ও ‘সংশয়ীদের ঈশ্বর’ তার উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ। মাসুদুজ্জামান, মাসুদুল হক, মজিদ মাহমুদ, হামীম কামরুল হক, আহমেদ স্বপন মাহমুদের প্রবন্ধে তথ্য-তত্ত্ব উপস্থাপন ও বিশ্লেষণের প্রমাণ পাওয়া যায়। তাদের কেউ-কেউ সাহিত্যের নানা অপ্রচলিত অনুষঙ্গ প্রবন্ধের বিষয় করেছেন। দর্শন ও জীবনবোধ তাদের অনেকের প্রবন্ধের উপজীব্য বিষয়। সরকার আমিনের প্রবন্ধ মূলত গবেষণাধর্মী। তার রচিত ‘বাংলাদেশের কবিতায় চিত্রকল্প’ কবিতাবিষয়ক একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণামূলক গ্রন্থ। তপন বাগচীর আগ্রহ মূলত লোকসাহিত্য। এ-সংক্রান্ত প্রচুর কাজ করেছেন তিনি। ‘লোকসংস্কৃতির কতিপয় পাঠ’, বাংলাদেশের যাত্রাগান : জনমাধ্যম ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত’ তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। যাদের প্রবন্ধের বিষয় কেবলই গল্প তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মনি হায়দার। এই গদ্যশিল্পীদের মধ্যে ব্যতিক্রম অনু হোসেন। তার প্রবন্ধের বিষয় মূলত ভাষা ও সাহিত্য। তুলনামূলক ও বিশ্লেষণাত্মক গদ্যে তিনি সিদ্ধহস্ত। চঞ্চল আশরাফ তার বেশির ভাগ লেখায় পঠন-পাঠনের কথা জানান দেন এবং তার সমালোচনামূলক গদ্যগুলো মূলত আক্রমণাত্মক। তার অধিকাংশ গদ্যে হুমায়ুন আজাদের কণ্ঠস্বরই শোনা যায়।
অনতি তরুণ প্রাবন্ধিকদের মধ্যে কাজী মহম্মদ আশরাফের গদ্যে ড. আহমদ শরীফের মতো যুক্তি, বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত থাকে। চন্দন চৌধুরীর গদ্য নানামাত্রিক। মিজান রহমান মূলত গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। মোহাম্মদ নূরুল হকের প্রবন্ধ বিবিধ ও বিচিত্র বিষয়মুখী। তার লেখার পরিমাণও বেশি। প্রাচীন ভাষাভঙ্গিকে মাঝে-মধ্যে বর্তমানের প্রচলিত ভঙ্গির মধ্যে সহজে মিশেল দেওয়ার দক্ষতা রয়েছে তার। এ কারণে তার ভাষাভঙ্গি একটি স্বতন্ত্র অবয়ব ধারণ করে। অনেক বিষয়ে নিজস্ব মত প্রকাশের মাধ্যমে তিনি অকুণ্ঠ। কবি ও গল্পকার হওয়া সত্ত্বেও প্রবন্ধের প্রতি অত্যধিক আকর্ষণের কারণেই এ মাধ্যমেই তার কাজের কেন্দ্রবিন্দু তৈরি হয়েছে। তার ‘সাহিত্যে দশক বিভাজন ও অন্যান্য’ ও ‘সমকালীন সাহিত্যচিন্তা’ সাহিত্য সমালোচনার ধারায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
পাঁচ. আমাদের সাহিত্য অঙ্গনের অনেক ইতিবাচক দিকের বিপরীতে বেশকিছু সীমাবদ্ধতা এ বৃত্তাবদ্ধ থাকার প্রবণতা রয়েছে। আমরা আবেগ দ্বারা চালিত হতেই পছন্দ করি; কিন্তু আবেগকে যথার্থ মননশীলতা ও প্রখর বুদ্ধিদীপ্ততার রেখাগুলো দ্বারা অঙ্কিত করি না। এর বাইরে রয়েছে বাণিজ্যমুখিতা। বাণিজ্যের প্রয়োজনে অসংখ্য দৈনিক পত্রিকা চালু রয়েছে এবং দৈনিকলগ্ন সাহিত্য সাময়িকীর পাতায় প্রয়োজন পড়ে প্রচুর গদ্যের। এছাড়া প্রকাশিত হয় অসংখ্য ঢাউস আকারের লিটল ম্যাগাজিন ও সাহিত্য পত্রিকা। এতসব পত্রিকার জন্য লেখা জোগান দিতে গিয়ে আমাদের গদ্যকারদের প্রচুর লিখতে হয়। হয়তো এ কারণেই একইসঙ্গে অগণিত গদ্যকারের আবির্ভাব হয়েছে। যারা কোনোভাবে গদ্যাকারে লিখতেই কেবল পারেন, সেই লেখার আবেদন ও শুদ্ধতা খুব একটা থাকে না। পত্রিকার পাতা ভরানো এবং সহজেই বই ছাপিয়ে গদ্যকার হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার সহজতর পথে অত্যন্ত নিম্নমানের গদ্য অহরহ পাঠকের সামনে আসে। পাঠককে বিচলিত করে ও পাঠবিমুখও করে অনেকাংশে। আর এক শ্রেণীর লেখক আছেন, যারা প্রধানত উচ্চপদস্থ সরকারি চাকরিজীবী। কিছুটা লেখালেখির অভ্যাস থাকার ফলে তারা চাকরির উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হওয়া মাত্রই লেখকখ্যাতি পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এ রকম অনেক আমলা গদ্যকার আমাদের অঙ্গনে আছেন, যারা অফিস-ফাইলে নোট লেখার মতো করেই প্রবন্ধ লিখতে চান। অনেকে বই থেকে সরাসরি লেখা উদ্ধৃতি করে বা কপি অ্যান্ড পেস্ট করে সাধ্যমতো একটা গদ্য দাঁড় করান এবং প্রভাব খাটিয়ে ভালো দৈনিকলগ্ন সাহিত্যপাতায় প্রকাশ করেন। এভাবে কিছু গদ্য লেখা হয়ে গেলে নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে নামি-দামি প্রকাশনী থেকে বই বের করে কেবল আত্মপ্রসাদই লাভ করেন না, স্থান দখলেও মনোযোগী হন। এক সময় কোনো ভুঁইফোড় সংগঠনের কাছ থেকে পুরস্কারও কিনে নেন।
গত বিশ-বাইশ বছরে পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রাবন্ধিকদের বইগুলোর দিকে তাকালেই এর সত্যতা পাওয়া যাবে। এছাড়া রয়েছে আমাদের সমাজে জনপ্রিয় সাহিত্যিকদের দাপট। তারা দই-তিনটি উপন্যাস বা গল্পগ্রন্থ প্রকাশের ফলে কীভাবে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন, তা অনুসন্ধানের বিষয় হতে পারে। প্রবল বাণিজ্যিক যোগাযোগ ও প্রচার-প্রোপাগান্ডা ছাড়া চট করে জনপ্রিয় হওয়ার মতো কোনো দাওয়াই আমরা দেখি না। অনেক ক্যাসিক উপন্যাসের পাঠক নেই, অনেক বিখ্যাত গদ্যকারের বই সম্পর্কে সিংহভাগ মানুষই অজ্ঞাত। অথচ দেখা যায় জনপ্রিয় লেখকদের হাজারো বাণিজ্যিক প্রচারণা। একবার জনপ্রিয় হয়ে উঠলে তারা দ্রুত লিখতে থাকেন। এক বছরে একজন জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক যদি দশটির বেশি উপন্যাস বাজারে ছাড়েন, তাহলে তিনি কীভাবে সক্ষম হবেন কালোত্তীর্ণ সাহিত্যকর্ম উপহার দিতে? শুধুই কলম চালিয়ে যাওয়া আর সাহিত্যের মণি-মাণিক্য তৈরি এক জিনিস নয়। মণি-মাণিক্য সৃষ্টির জন্য চাই চিন্তাশক্তি ও গভীর বোধসম্পন্ন মননশীলতা। তা নগণ্য সংখ্যকের মধ্যে আছে এবং বাণিজ্যিক প্রচারণা থেকে বিমুখ থাকার কারণে তাদের লেখাগুলো সেভাবে প্রচারিতও হয় না। মৌলিক ও ওজনদার গদ্য লেখার জন্য লেখকের অভিজ্ঞতা ও চিন্তাশক্তি থাকা প্রয়োজন।
এ প্রসঙ্গে বলা যায়— পাশ্চাত্যের দার্শনিক ও চিন্তকদের দ্বারা আমাদের অধিকাংশ পণ্ডিত প্রভাবিত। অধিকাংশ পণ্ডিত পাশ্চাত্যের নানা মতবাদকে প্রাধান্য দেন এবং তারা যে সমস্ত প্রবন্ধ লেখেন তার বেশির ভাগই ওই সমস্ত মতবাদের উপস্থাপনা ছাড়া আর কিছু নয়। অবশ্য এটা ঠিক যে, পাশ্চাত্যের বিখ্যাত দার্শনিকদের সমপর্যায়ের লেখক-দাশনিক তারা তাদের বৃত্তে চাইলেও খুঁজে পান না। ফলে তাদের শিক্ষণ-প্রক্রিয়া ও মননে নির্দিষ্ট কিছু বিখ্যাত ব্যক্তিত্বই বসবাস করে। কার্ল মার্কস বা ফ্রয়েডের মতবাদ আমাদের সাহিত্যের বিপুল সংখ্যক সৃষ্টিতে সুস্পষ্ট প্রভাব নিয়ে বিরাজমান। ঘুরকুনো বলে বাঙালির অপবাদ আছে। আমাদের বেশিরভাগ পণ্ডিত লেখকের ঘরবাড়ি মূলত পাশ্চাত্যের লেখকদের গ্রন্থরাজিতে পূর্ণ। তারা মৌলিক লেখার ক্ষেত্রে নিতান্তই অসহায়, কোনো নতুন তত্ত্ব ও মতবাদ আবিষ্কারের স্পৃহা তাদের নেই। অনেক লেখক আবার কিছু বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকের অন্ধ অনুরাগীও। রবীন্দ্রনাথকে দেবতার আসনে বসিয়ে গ্রন্থ রচিত হয়েছে অনেক। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে যথাযথ উন্মোচন ও রবীন্দ্র সাহিত্যকে বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে প্রকৃত সমালোচকের দৃষ্টিতে দেখতে আগ্রহী নয় কেউ-কেউ। রবীন্দ্রানুরাগী অনেক লেখক আছেন, যারা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মের সামান্য সমালোচনাও সহ্য করেন না, হুঙ্কার দিয়ে কলম ধরেন। ব্যক্তিগত পছন্দ, পেশাগত দায়িত্ব পালনের ব্যস্ততা সত্ত্বেও ধ্যানী-স্বভাবের কিছু লেখকের দেখা আমরা বিভিন্ন সময়ে পেয়েছি, তাদের লেখায় তাদের চিত্তের বিশালতাও ফুটে উঠেছে। এই বিশাল চিত্তের জন্য প্রয়োজন যে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বান্ধব-পরিবেশ তার নিশ্চয়তা অবশ্য আমাদের দেশে নেই।