ব্যাকরণের দিকে যাচ্ছি না। শব্দ বা ধ্বনিগত ভাষার দিকে যাওয়ার আগে কতিপয় বিষয়ের দিকে চোখ রাখা যেতে পারে—
সিরিজ ১: ক. মুখের ভাষা
খ. প্রার্থনার ভাষা
গ. স্লোগানের ভাষা
ঘ. …………….
ঙ. …………….
সিরিজ ২: ক. চোখের ভাষা
খ. দেহের ভাষা
গ. .. …………..
ঘ. …………….
সিরিজ ৩ : ক. প্রবন্ধের ভাষা
খ. চিঠির ভাষা
গ. গল্পের ভাষা
ঘ. উপনাসের ভাষা
ঙ. …………….
চ. …………….
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে উপর্যুক্ত সিরিজভিত্তিক বিষয়ের ভাষা আর কবিতার ভাষা এক নয়। শুধু তাই নয়, উল্লেখিত বিষয়ের প্রত্যেকটির ভাষা অন্যটির ভাষা থেকে আলাদা। ব্যবহারিকভাবে ‘শব্দ’ই কমন শব্দ যা প্রত্যেকটি ভাষার অপরিহার্য উপাদান। এখানেই রহস্য। অপরিহার্য উপাদান এক কিন্তু ভাষা হয়ে গেল আলাদা! তাহলে এখানো কোনো অদৃশ্য শক্তি কাজ করে! সেই অদৃশ্য শক্তি এমন কোনো আবহ তৈরি করে যার মাধ্যমে সহজেই পৃথক করা যায় মুখের ভাষা থেকে প্রার্থণার ভাষাকে কিংবা প্রার্থণার ভাষা থেকে স্লোগানের ভাষাকে। সেই অদৃশ্য শক্তি হচ্ছে শব্দটির যথার্থভাবে উপযুক্তভাবে শাব্দিক হয়ে ওঠা, বহনমাধূর্যতা ধারণ করা, অপরাপর শব্দ পরম্পরার সাথে সংযুক্তিকরণের ক্ষমতা নিয়ে বিকশিত হওয়া।
তাহলে কবিতায় শব্দের ভূমিকা কী? দৃশ্যমান শব্দ কোন অদৃশ্যকে উপস্থাপন করে? যার কারণে কবিতাটি কবিতাই হয়ে ওঠে? প্রবন্ধ বা উপন্যাস হয়ে ওটে না? এর প্রধান কারণ কবিতায় ব্যবহৃত শব্দটি প্রথমেই তার অভিধানিক অর্থের পোশাকটি খুলে ফেলে। এই পোশাকটি খুলে ফেলার জন্য সে কিন্তু নগ্ন হয়ে যায় না। বরং আভিধানিক অর্থকে উপেক্ষা করে, উজিয়ে, অতিক্রম করে সে ভিন্নার্থিকতার প্রতিনিধি হয়ে ওঠে (কখনো কখনো আভিধানিক অর্থকে ধারণ করেও)। এই কারণে শব্দ চয়নের ক্ষেত্রে যিনি যথার্থতার পরিচয় দিতে পারবেন, যিনি যথাশব্দ প্রয়োগের কাছাকাছি যেতে পারবেন তিনিই হয়ে উঠবেন যথার্থ কবি। আর ব্যর্থ হলে তার কাব্যপ্রয়াসটি নিছক শব্দ-সমবায় ছাড়া কিছুই হয়ে উঠবে না।
শব্দ-সমবায়ের ফলে কয়েকটি ঘটনা ঘটতে পারে।
এক. কবির প্রয়াসটি কবিতার কাঠামো ধারণ করে প্রকৃত অর্থে হয়ে উঠবে অর্থহীন, খাপছাড়া, সঙ্গতীহীন।
দুই. কবির প্রয়াসটি সৃষ্টি করতে পারে এক বিভ্রান্তিময় কুহকী পরিবেশ ।
তিন. পারম্পার্যহীন, খাপছাড়া, অধারাবাহিক ।
চার. নামকরণের সাথে সাযুজ্যহীনতার জন্য বিরক্তিকর বালখ্যিতা
আবার এই শব্দ ব্যবহারে যিনি পরম নিপুণতার পরিচয় দেবেন, শব্দের ওপর নিয়ন্ত্রণে যিনি অধিকতর কুশলী হবেন তিনি ঠিকঠিকই যথাশব্দ প্রয়োগ করে চরম শিল্প কুশলতার পরিচয় দেবেন। এখানে এই ধরনের ব্যবহারের ক্ষেত্রে কবি আবার দুভাবে শব্দ ব্যবহার করতে পারেন।
এক. যথাশব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে তিনি যথার্থতার স্বাক্ষর রাখবেন।
দুই. নীরিক্ষা করতে গিয়ে, খেলতে গিয়ে কবি শব্দকে অধিকতর মায়ার পোশাক পরাতে পারেন। আভিধানিক পোশাকটি খুলে ফেলার পর, ভিন্নার্থিকতার প্রতিনিধি করে তোলার পর, অন্যান্য সমবায়ী শব্দের সমস্বয়ে তিনি তৈরি করতে পারেন মায়াবী স্বাক্ষর। এতে একদিকে যেমন কবিতায় মায়াবী ধূসর জগতের সৃষ্টি হতে পারে যা আধো চেনা আধো অচেনা, যা কল্পনাপ্রবণ করে পাঠককে করে তুলতে পারে সৃজনশীল। তেমনি তৈরি হতে পারে মায়াবাদ। যা অধরা।
তো এই যথাশব্দ নিয়ে যে এত কথা, সেই শব্দই বা কতটা স্বয়ংসম্পূর্ণ। শব্দ তো প্রকাশের মাধ্যম। এটা যে আড়ালের মাধ্যমও সেটাও তো বলাই বাহুল্য। এক শব্দ প্রয়োগ করার পর অনুভতিতে যে অনুরণণ সৃষ্টি করল পরবর্তী শব্দটি সেই অনুরণণকে বাধাগ্রস্ত করে দিতে পারে। অসমবায়ী শব্দ ব্যবহারের ফলে দেখা যাবে প্রথম শব্দ মনের ভেতর যে কল্পনা বা চিত্রকল্প তৈরি করল পরবর্তী শব্দটির জন্য তা একেবাইে বিপরীতার্থকতার দিকে চলে গেল। এভাবেই শব্দ প্রকাশের মাধ্যম হয়েও আড়ালের কারণ হতে পারে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে কবিতায় শব্দের এই একচ্ছত্রতার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। বরং কবি যদি তার ভাব প্রকাশের জন্য প্রতীক বা রূপকের দ্বারস্ত হন তখনও শব্দই তার একমাত্র বাহন হয়ে ওঠে। ভাব প্রকাশের জন্য তিনি যে বাক্য গঠন করবেন তারও একক তো ওই শব্দই। তাহলে বলা যায় ভাব ও ভাষার প্রকাশের জন্য শব্দের এক বিশাল নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। কিন্তু শব্দের উপর রয়েছে কবির আরেক বিশাল মহিমা। শব্দ যখন ওই মহিমাপ্রাপ্ত হয় তখনই তা অনন্য হয়ে ওঠে। যেমন, আমি চিল শব্দটি যদি উচ্চারণ করি তাহলে মনের ভেতরে কয়েকটি দৃশ্য ভেসে উঠবে। দৃশ্যগুলো হলো একজন ব্যক্তি মানুষের চিল সঙক্রান্ত অভিজ্ঞতা। একজন তাত্ত্বিকের কাছে চিল সঙক্রান্ত বিভিন্ন তত্ত¦। একজন পরিবেশবিদের কাছে চিলের অবলুপ্ততার বিবরণ ভেসে উঠবে এবং তদসংক্রান্ত পরিবেশ বিপর্যয়ের চিত্র। যদি একজন কবি বা পাঠককে ‘চিল’ শব্দটি বলা হয় তাহলে তার প্রতিক্রিয়া বর্ণিত বিষয়ের মতো হবে না। একজন পাঠককে যদি আবার জীবনানন্দের চিলের কথা বলা হয় তাহলে সেটা আরও অন্যরকম হয়ে তার চেতনায় ধরা দেবে। শুধু তাই নয় স্বয়ং জীবনানন্দের কবিতার সব চিলও এক নয়। তাহলে চিল শব্দটি ব্যবচ্ছেদ করে কী কী পাওয়া গেল? যা যা পাওয়া গেল, কবিতায় যা পাওয়া গেল, জীবনানন্দের কবিতায় চিল যা হয়ে উঠল— এতসব হয়ে ওঠা ও পৃথকত্বের কারণ, স্বাতন্ত্রিক হয়ে ওঠার কারণ কবির প্রযুক্ত নিজস্ব মহিমা।
দুই
সেই চর্যাপদ থেকে শুরু করে আজ যে নতুন কবি লিখছেন তার মধ্যে রয়েছে এক ধরনের প্রচ্ছন্ন ধারাবাহিকতা। আমাদের ক্ষধা, আমাদের বঞ্চনা, আমাদের প্রত্যাশা, আমাদের প্রাপ্তি, আমাদের প্রেম… এভাবে আমরা যে সমগ্রতা নিয়ে জীবন যাপনের ব্যাপ্তি নির্ধারণ করি সেই সমগ্রতার তেমন কোনো হেরফের হয়েছে বলে মনে হয় না। তবে উপকরণিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে সে-কথা না বললেও চলে। যেমনঃ একজন আদিম মানুষের প্রত্যাশা ছিল আমাদেরও আছে। একজন আদিম মানুষের মনে প্রেম ছিল আমাদের মনেও প্রেম আছে। কিন্তু একজন আদিম মানুষ যে উপকরণ ব্যবহার করে ক্ষুধা নিবারণ করতো আমরা সেই উপকরণ ব্যবহার করি না। কিংবা সেই উপকরণকে যথেষ্ট মোডিফাই করতে পেরেছি। তেমনি বস্তুগত প্রত্যাশার কাঠামোতে পরিবর্তন ঘটলেও প্রত্যাশাজনিত আবেগের কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমরা এখনো কাঁদতে পারি। আমরা এখনো রেগে উঠি। আমরা এখনো প্রাপ্তিতে আমরা এখনো ছোঁয়ায় আহ্লাদিত হই। কিন্তু একজন আদিম মানুষ যেভাবে আবেগ প্রকাশ করতো আমরা কি সেভাবে আবেগ প্রকাশ করি? না। তার মানে আবেগ চিরন্তন, অনুভ’তি চিরন্তন, প্রত্যাশা চিরন্তন কিন্তু এসবের প্রকাশ, প্রকাশের ভঙ্গি চিরন্তন নয়। এই ভঙ্গি পরিবর্তনের ধারা যে কোনো দেশের যে কোনা ভাষার কবিতার ভাষাগত পরিবর্তনের একটি মৌলিক দিক। এর সঙ্গে যুক্ত হতে পাওে পরিবেশিক পরিবর্তন।
অতপর ঘটনা-অনুঘটনা-প্রতিঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সমাজ জীবনে বা রাষ্ট্রীয় জীবনে ঘটে যায় নানাবিধ পরিবর্তন। সেই পরিবর্তনের ছোঁয়া এসে আছড়ে পড়ে ব্যক্তি মানুষের হৃদয়। প্রশ্ন উঠতে পাওে স্বতঃস্ফূর্ত সামাজিক পরিবেশের পরিবর্তনের ধারাতেই তো সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আসে, ঘটনা-প্রতিঘটনা তো সেখানে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেই। একটি খণ্ডচিত্র:
ইউরোপের শিল্পবিপ্লব
প্রথম মহাযুদ্ধ
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ
জাপানে পারমানবিক বোমা হামলা
কম্যুনিজমের পতন
চরমপন্থী মৌলবাদেও উত্থান
কিংবা
নীল বিদ্রোহ
কৃষক বিদ্রোহ
ফকির আন্দোলন
তেভাগা আন্দোলন
বৃটিশ শোষণ
পাকিস্তানী শোষণ
ভাষা আন্দোলন
গণ অভ্যত্থান
মুক্তিযুদ্ধ
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-
এরশাদীয় সামরিক শাসন
জিয়াউরীয় সামরিক শাসন
মৌলবাদের পুনর্বাসন
যুদ্ধাপরাধীর উত্থান
নিকটবর্তী কয়েক শতাব্দীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই কত নগ্ন সত্য বেরিয়ে আসে! উপরোক্ত প্রতিটি ঐতিহাসিক ঘটনার (এর বাইরেও রয়েছে অনেক ঘটনা) পরিপ্রেক্ষিত বদলে দিয়েছিল তৎসময়িক নানাবিধ প্রবণতা। এই প্রবণতা এক বিশাল ঢেউ হয়ে সংবেদনশীল মনকে আলোড়িত করেছে, ফলে চেতনে-অবচেতনে ঘটেছে স্বতঃস্ফূর্ত পরিবর্তন। বহিস্রোতে ও আন্তঃস্রোতের মতো তা সমাজ জীবনে প্রভাব ফেলেছে। তাছাড়া বিজ্ঞানের বিকাশ বদলে দিয়েছে দৈনন্দিন জীবনকে। একজন রবি ঠাকুরের দৈনন্দিন জীবন আর একজন শামসুর রাহমানের দৈনন্দিন জীবন যাপনের ধরনে পার্থক্য থাকবেই।
সমাজ বা রাষ্ট্রীয় জীবন, দৈনন্দিন জীবন এবং ব্যক্তি মানুষের অন্তঃস্থ আলো-বাতাস কবিতার ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করে। ব্যক্তিপ্রবণতাও এর জন্য বহুলাংসে দায়ী। একজন ব্যক্তিগত জীবনানন্দ যে প্রকৃতির ছলেন তার সুস্পষ্ট ছাপ তার কবিতায়, কবিতার ভাষায় রয়েছে। এই উদাহরণ সব কবির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
তিন
আরেকটি তালিকা
স্যাটেলাইট
বিজ্ঞাপন
ইংরেজি মাধ্যম
ইসলাম কায়েমের জন্য জঙ্গি-জিহাদ
প্রযুক্তির বিস্ফোরণ
এক কথায় এসবের কারণে কোনো দেশের ভাষাই আর পবিত্র শিখা নেই। একবিংশ শতাব্দীর এই কালখন্ডে এসে কোনো দেশ বা জাতি সে আশাও করে না। কিন্তু নিজের মাতৃভাষার উপর মমত্ব ও দখল থাকা বাঞ্ছনীয় । কিন্তু সেটা তখনই সম্ভব যখন পাঠ-সংস্কৃতিটা গড়ে ওঠে। এক সময় একটা ছিলও। একসময় পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরি থাকতো। সেখান থেকে সদস্য হয়ে ভাড়ায় বই নেয়া যেত। এখন এই পাঠ সংস্কৃতি দখল করে নিয়েছে দৃশ্য-সংস্কৃতি। পাশাপাশি তো ভার্চুয়াল জগত তো রয়েছেই। ফলে পাঠ সংস্কৃতির এই সংকোচন আর দৃশ্য সংস্কৃতির এই বিস্ফোরণ প্রভাব ফেলেছে ভাষার ওপর। সেটা কথ্য ভাষাই হোক, ব্যবহৃত ভাষায় হোক। এর প্রভাব তো সাহিত্যে পড়বেই। কিন্তু সেই প্রভাব কতটা ইতিবাচক, কতটা নেতিবাচক। কতটাইবা সমৃদ্ধ-প্রবণ। সত্যি কথা বলতে কি, একটি সমাজ যখন পাঠ-সংস্কৃতির চর্চা থেকে সরিয়ে এসে দৃশ্য-সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকে পড়ে তখন প্রথমত ভাষার উপর তার দখলদারিত্বটা কমে যায়। ফলশ্রুতিতে সমাজের চলমান সাংস্কৃতিক মানটাও নিম্নমুখী হয়। তার প্রভাব সাহিত্যে, সাহিত্যের ভাষায় তো পড়বেই।
ইতালির বুদ্ধিজীবী আন্তোনীয় গ্রামসি বলেন কোনো সমাজে এক ধরনের সংস্কৃতি থাকে না। এর পাশাপাশি অন্যান্য রূপও প্রবাহিত হতে থাকে। কিন্তু কোনো একটি রূপ হয় প্রভাবশালী। তা প্রভাবিত করে অন্যগুলোকে। বিশেষ করে নিম্নবর্গের সংস্কৃতিকে। তিনি এক সংস্কৃতি কর্র্তৃক অন্য সংস্কৃতির উপর এই রকম প্রভাব বিস্তারের ব্যাপারটিকে হেজেমনি বলেন। এই হেজেমনির কারণেই প্রভাবশালী গোষ্ঠীটি নিম্নবর্গের গোষ্ঠীর কাছে স্বীকৃতি পায়। বিশ্বের পরাশক্তিগুলো, আধিপত্যবাদীরা তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগের পাশাপাশি সাংস্কৃতির এই প্রয়োগটাও করে থাকে। তারা চায় তাদের সকল ক্ষমতা স্বীকার করুক পাশাপাশি সংস্কৃতির শ্রেষ্টত্ব ও উৎকর্ষও স্বীকার করুক এবং প্রবাভিত হয়ে চর্চা করুক। শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করে এই চর্চাটাকেই গৌরবের ব্যাপার মনে করুক। চেইন অব সার্কেলের মতো তারা সাংস্কৃতিক আধিপাত্যের মাধ্যমেও তারা তাদের আধিপত্যতার প্রযোগ করতে চায়। কারণ সংস্কৃতিটা যদি ধারণ ও লালন করে ওই নিম্নবর্গ তাহলে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা আরো সহজতর হয়ে গেলো। আজকের স্যাটেলাইট ও অন্যান্য প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের দরুণ এই হেজেমনির প্রয়োগটা অত্যন্ত সহজ হয়ে গেছে। এতই সহজ হয়ে গেছে যে নিম্নবর্গের সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্য-ধর্ম-প্রথা সব কিছুকেই তারা গিলে ফেলেছে। ফলে তাদের পক্ষে অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর উপরে প্রভাব বিস্তার করা সহজতর হয়েছে। অর্থনৈতিক বিষয়ের উপর প্রভাব ফেলতে পারলে তো রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলাটা সহজ। এই দৃশ্যমান বাস্তবতা এটাই বলে দেয় সাংস্কৃতিক আধিপত্যের সাথে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্যের গূঢ় লেনাদেনা। এক্ষেত্রে এডওয়ার্ড সাইদের একটি উক্তিও প্রাণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যে মূলত অর্থনৈতিক সে কথা মানি, কিন্তু তা চলছে আমেরিকা সম্পর্কিত সাংস্কৃতির মত ও মতাদর্শের ওপর ভর দিয়ে, এগুলোর সাথেই পা মিলিয়ে।
চার
কাঠামো বলি, প্রকরণ বলি কিংবা অবয়ব যেটাই বলি না কেনো যুগে যুগে বাহ্যিক খোলস পাল্টিয়ে কবিতা যে রূপ বর্তমানে গ্রহণ করেছে তার অন্তরে রয়েছে একই রসের আত্মা। না, সংস্কৃত ভাষায় কবিতার সাথে যে ‘রসাত্মক কথা’টি যুক্ত রয়েছে সেই কথা দিয়ে অন্যভাষার কবিতার আত্মাকে প্রতিস্থাপন করার প্রচেষ্টা নয়। বরং ধরা-অধরার মাঝখানে বিরাজমান বস্তু-অবস্তুর সন্ধানই একজন ব্যক্তিমানুষকে কবিতার দিকে টানে। ধরা-অধরার মাঝখানে প্রায় অবস্তুগত নির্মাণই কিংবা উৎসারণই একজন কবির মহত্তম পেশা। বাহ্যিক রূপ বা খোলস পাল্টানো সম্ভব হলেও আত্মার বিকল্প আজও সৃষ্টি হয়নি। কবিতার ভাষা, যে ভাষা বাহ্যিক চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আছে মূর্তমান হয়ে, তার অন্তরে সে ধারণ করতে পেরেছে কতটুকু জীবন? এই প্রশ্নটিই মুখ্য। কিন্তু বাহ্যিক ভাষাগত পরিবর্তনকে, বহিরাঙ্গিক পরিবর্তনকেও আমরা গৌণ করতে পারি না। কেননা পরিবর্তনের হাত ধরেই সে পেয়েছে বর্তমান রূপ। এই রূপও আপেক্ষিক। সেও ধীরে ধীওে কোনো একদিন অন্য দিকে বাঁক নেবে। তখন পথের মোড়ে থাকবে নতুন কবির নতুন চোখ। নতুন কলমে সে লিখবে নতুন বাঁকে নতুন বাঁক বদলের কথা।
আমরা সাহিত্যের ইতিহাসকে কালিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করেছি। দেখা যাবে ভাগকৃত অংশেও এর সুস্পষ্ট সাক্ষাৎ মেলে। প্রথমদিকে পরিবর্তনশীলতা ছিল শ্লথ। এজন্য কবিতাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘসময়। পরবর্তীতে পরিবর্তনশীলতা একটু একটু গতিপ্রাপ্ত হলেও কোনো কোনো নক্ষত্রের অত্যধিক জ্যোতির কারণে নতুন মোড়ে বাঁক ফেরা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিংবা ন্যূনতম বিলম্ব হয়েছে। মাইকেলের যে ভাষা ছিল, দেখা যায়, সেখান থেকে রবি ঠাকুরের হাতে নতুন ভাষার জন্মকাল খুব বেশি দূরে নয়। এই নতুন ভাষার জন্য যত সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে তার চেয়ে ঢের বেমি সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে মধ্যযুগের ভাষা থেকে মাইকেলের বেরিয়ে আসতে। রবি ঠাকুরের প্রবল জ্যোতির মাঝেই তখন নজরুল/সত্যেন্দ্রনাথ নতুন পথের নতুন ভাষার বাঁকে ছিলেন। কিন্তু তা ছিল স্বভাবজাত, নিজস্ব স্বাতন্ত্রিকতা। ততদিনে বিভিন্ন কাব্যান্দোলনের হাওয়া এসে লেগেছিল আমাদের বাংলা কবিতায়। সৌভাগ্য বা দূর্ভাগ্য যে রবি ঠাকুর/নজরুল সেই হাওয়া গায়ে লাগতে পারেননি। কিন্তু নতুন যুগের ছেলেদের চেতনে রবি ঠাকুরের প্রবল জ্যোতি, নজরুলের পরাক্রমশালী প্রভা, অন্যদিকে ইউরোপ-আমেরিকার হাওয়া সবকিছুই ধাক্কা দিলো। জন্ম নিলো এক অন্যরকম মনোরসায়নের। একদিনে রবি ঠাকুরকে অস্বীকার করা যেমন দুঃসাধ্য তেমনি বাংলঅ সাহিত্যকে আন্তর্জাতীকীকরণের হাতছনি থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে আনা বেমানান। এই দুয়ের লব্ধিতে শুরু হলো নতুন বাঁকের। বলা হয়ে থাকে রবি ঠাকুরকে অস্বীকার করাইছিল কল্লোলের প্রধান কাজ। কিন্তু না তারা কখনোই রবি ঠাকুরকে অস্বীকার করেন নি। বরং রবীন্দ্রনাথকে এঁরাই বেশি আত্মস্থ করেছিলেন। আর অত্মস্থ করতে পেরেছিলেন বলেই তারা রবীন্দ্রজ্যোতি থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন। নতুন যুগে নতুন ভাষা সৃষ্টি হলো বটে কিন্তু পরিস্ফ’টিত হলো দিক
ক. বাংলা কবিতায় ঢুকে পড়লো আন্তর্জাতিকতা
খ. বাংলা কবিতা সাধারণ পাঠককূল থেকে দূরে সরে গেল।
কল্লোলের পঞ্চপাণ্ডবের হাতে বাংলঅ কবিতা পেল নতুন ভাষা। বাংলা কবিতায় যুক্ত হলো বিবিধ বোধ। এদের মধ্যে জীবনানন্দ ছিল আরো অন্যরকম। পরবর্তী সময়ের দিকে তাকালে দেখা যায় চল্লিশ-পঞ্চাশ কিছু ব্যতিক্রম বাদে তিরিশেই সম্প্রসারণ। তবে নতুন পথের জন্মদানের ক্ষেত্রে কল্লোলের কবিদেও যে ভূমিকা ছিল তা অনস্বীবার্য। আজ সর্বশেষ যে নতুন কবি লিখেছে তার সূচনাপর্বও ছিল তিরিশ। চল্লিশ পঞ্চাশের পা ষাটে এসে বাঁকটা একটু বেশি । পরবর্তীতে নব্বইয়ে এসে সে বাঁক নিয়েছে প্রধাণত দু’ভাবে। আবু হাসান শাহরিয়ারের ভাষায় “সমবায় পন্থী নতুনত্ব এবং চরমপন্থী নতুনত্ব।” দেখা যায় সমবায় পন্থী নতুনত্বে ভাষা হচ্ছে কবিতার অনুগাম। অর্থাৎ ভাষার কসরতই মুখ্য নয়। কবিতাকে কবিতার জায়গায় রেখে সূক্ষ্ণ-হৃদয়গ্রাহী পরিবর্তন পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে। অন্যদিকে চরমপন্থী নতুনত্বে কবিতা নামীয় ভাষার খেলা। ভাষাই সেখানে মুখ্য। কবিতা গৌণ।
পাঁচ
মানুষের মুখের ভাষা কবিতা নয়। কবিতা নয় সংবাদপত্রের ভাষাও। এগুলো কবিতা হলে কবিতাকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার প্রয়োজন বোধ জন্মাত না। তবুও যখন ঈশ্বর পাটনি বলেন, আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। তখন কবিতার এই লাইনটি মুখের ভাষার মতোই লাগে। ধীরে ধীরে মানুষের মুখের ভাষার সাথে, চেতনার ভাষার সাথে, বোধের সাথে, অভিজ্ঞতার সাথে, প্রত্যাশার সাথে এতই মিলে গেল যে, কবিতার ওই লাইনটি এখন প্রবাদে পরিণত হয়ে গেছে। তাহলে মুখের ভাষার সাথে কবিতার ভাষার দূরত্ব কোথায় গিয়ে দাঁড়ালো? কিংবা কবিতায় যখন রিকসাওয়ালার কন্ঠে শোনা যায়, পেডেল মাইরা কি চান্দে যাওন যায়!’ তখন দার্শনিকতার স্পর্শে সচেতন হয়ে ওঠে মন। সীমাবদ্ধতা ও প্রত্যাশার বিপরীতার্থকতাও ভেসে ওঠে। কিন্তু কথাটি তো নিছক মুখের ভাষা-ই। কিংবা জীবনানন্দ দাশ যখন বলেন, পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকরি, কিংবা বুদ্ধদেব বসু যখন বলেন, সোনালী আপেল, তুমি কেমন আছ? কিংবা শক্তি চট্টোপাধ্যায় যখন বলেন, যেতে পারি- কিন্তু কেন যাবো? তখন?
তাহলে দেখা যাচ্ছে মুখের ভাষাও তার প্রচলিত অর্থকে ছাপিয়ে বিশেষ অর্থ বহন করতে পারে। তেমনি কবিতার ভাষাও মানুষের মুখের ভাষা হয়ে যেতে পারে। কবিতার বিশেষত্বও সেখানে। একটি শব্দকে সাধারণভাবে উপস্থাপন করলে সে সাধারণ অর্থই প্রকাশ করবে বা আভিধানিক অর্থই প্রকাশ করবে। কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ যদি আভিধানিক অর্থকে অতিক্রম না করতে পাওে তাহলে বলতে হবে কবি তার ভাবকে শব্দের বৈতরণীর মাধ্যমে উপস্থাপন করতে পারেনি। আবার সাধারণ মুখের ভাষাকেও সাধারণ অর্থ থেকে উপওে তুলে তাকে বিশেষ অর্থে অর্থায়িত করা যায়। তখন মুখের ভাষাও হয়ে ওঠে কবিতা। তেমনি, মুজিব ইরম যখন বলেন, হাজার পায়ে তোমার কাছে যাই এক পায়ে ফিরে আসি’ তখন নিতান্তই চিঠির ভাষা মনে হবে না। কিন্তু এটা চিঠির ভাসাও হতে পারতো। হয়নি। না হয়ে প্রেমাষ্পদেও কাছে হতাশ হয়ে ফিরে যাওয়ার সরল অভিব্যক্তির প্রকাশক হয়েছে। হয়ে উঠেছে গভীর ব্যঞ্জনা। যেখানে নিহিত রয়েছে চিরকালিক আবেদন। মূলত প্রেমাষ্পদের কাছে হাজার পায়েই যাওয়া সম্ভব। কারণ সে সময় যে আকুলতা থাকে, মনে হয়, না জানি কত দেরি হয়ে যাচ্ছে। ফিরে আসা যেন ঠিক তার উল্টা।
এভাবে দেখা যায় চিঠির ভাসাও কবিতা পদবাচ্যেও অন্তর্ভুক্তি হতে পারে। কবি যদি শক্তিশালী হন। সাধারণ অর্থে কবিতার ভাষা তো ঐন্দ্রজালিক ভাষা। তাই বলে ঐন্দ্রজালিক স্বর সৃষ্টি করতে হলে শুধুমাত্র যে ঐন্দ্রজালিক পরিবেশ-পরিস্থিতি-ভাষার দ্বারস্থ হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। সাধারণের ভেতর থেকেও তুলে আনা যায় বিবিধ গভীরতা।
কবিতার ভাষা এমন এক ভাষা- ব্যকরণ দিয়ে যাকে সিদ্ধি করানো যায় না। প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা কবিতার ভাষার কাছে প্রায়ই মূর্খ, নিরক্ষর। তাই বলা যায় কবিতার ভাষা একধরনের অভিনব নিরক্ষরতা। সম্পূর্ণরূপে যা অন্যরকম, অন্যরকম এর অভ্যন্তর। ফলে কোনোভাবে একবার যে প্রবেশ করবে তার কাছে মনে হবে চলে এসেছি মনোরম মনোহর দিকশূন্যপুরে। ফলে ফিরে আসা? প্রেমিকার সঙ্গে প্রেমের মাঠে শতশত গল্প করার পর ফিরে যাওয়ার মতো নিষ্পলক বিস্ময় নিয়ে ফিরে ফিরে আসার অসীম অঙ্গীকার।