সাক্ষাৎকার গ্রহণ: মনজুর কাদের
কবি সেলিনা শেলীর জন্ম ১৯৬৭ সালের ১৭ জুলাই, চট্টগ্রামে। তিনি কবিতা লেখার পাশাপাশি ছিলেন প্রগতিশীল বামধারার রাজনীতির সঙ্গেও সম্পৃক্ত। অভিনয়, আবৃত্তি ও সাংস্কৃতিক সংগঠক হিসেবেও ছাত্রজীবনকে উজ্জ্বল করে রেখেছেন তিনি। লিটল ম্যাগাজিনসহ কয়েকটি পত্রিকার সঙ্গেও কাজ করেছেন। আজীবন মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির বিপক্ষে তাঁর সাহসী অবস্থান। সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে শারীরিকভাবে আক্রান্তও হয়েছেন। বর্তমানে পেশাগত জীবনে তিনি চট্টগ্রাম বন্দর মহিলা কলেজের উপাধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত। নেশা তাঁর একমাত্র লেখালেখি। বোধ ও মননের বহুমাত্রিক প্রসঙ্গ উঠে আসে তাঁর সঙ্গে এই আলাপচারিতায়। স্মৃতির প্রিজম থেকেও ঠিকরে বেরোয় নানা কথা-উপকথা।
মনজুর কাদের: আমরা অনেকেই দশক বিচারে বিশ্বাসী নই। কিন্তু একজন কবির আবির্ভাবকাল নির্ণয়ে দশক গণনা করা হয়। দশক বিচারে আপনি আশির দশকের কবি। গদ্যকার। গল্পও লিখেছেন। দশক বিচার নিয়ে আপনার মন্তব্য এবং আপনার দশকের লেখালেখি প্রসঙ্গে বলুন।
সেলিনা শেলী: বোঝা যাচ্ছে, খুব আঁটঘাট বেঁধে এসেছো। আমার সত্যি খুব ভালো লাগছে। তারচে বেশি ভালো লাগছে এই ভেবে যে, এর পেছনে তোমার অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই অর্থাৎ আমি কোনো পত্রিকার সম্পাদক, আমলা কিংবা রাঘববোয়াল টাইপের কেউ নই যে, এতে তোমার কোনো প্রাপ্তি ঘটতে পারে। লোকসানকেই প্রাপ্তি ভাবতে পারো। তোমার এই সততা আজকের সাহিত্য সম্পাদকদের ভেতর যতই থাকবে ততই সাহিত্যের মঙ্গল।
যা-ই হোক, শুরু করা যাক। একসঙ্গে তুমি বেশ ক’টা প্রশ্ন করেছ। দশকভিত্তিক কাব্যালোচনার প্রক্রিয়াটিকে আমি কোনোমতেই স্বীকার করি না। বরং গুরুত্ব দেই কবির কাব্যপ্রবণতা এবং তার উত্তরণের ধারাবাহিক প্রক্রিয়াকে। তবে আমি একথাও মনে করি যে, কবি যে সময়ে আবির্ভূত হয়েছেন তার পূর্বজ এবং সমকালকে ছুঁয়ে তিনি কতটা সামনের দিকবিস্তারী; সেটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এজন্যেও দশক জানা প্রয়োজন। নয়তো, পৃথিবীর বড় বড় কবিদের দশক আমরা মাথায় রাখি না, রাখি, দশক ও শতক উত্তীর্ণ পঙ্ক্তিগুলো, যা আজও সমান স্বাদু এবং সমকালীন। তবে একথা তো সত্যি যে, একত্রিতভাবে একটি দশকের কবিদের স্বতন্ত্র একটি স্বর আবিষ্কার করা সম্ভব। কিন্তু কবি যদি নির্বিশেষ থেকে বিশেষ হয়ে না ওঠেন, যদি তার স্বর ও সুর আলাদা করে দাগ কাটতে না পারে, তাহলে দশকের অতলেই তো তিনি তলিয়ে যাবেন। মোদ্দাকথা হচ্ছে, কবিতায় যদি কবিতাই না থাকে, তো, কবির দশকটশক বলেও আর কিছু থাকে না।
আসলে দশক-দল-দলাদলি, কবিতার জন্য এরচে বড় শত্রু আর নেই। এজন্যেই জীবনানন্দ দাশ বলে গেছেন, কবি হওয়ার জন্যে একটি শাদা পাতাই যথেষ্ট। তবে তিনিই বড় কবি, যিনি পুরাকাল এবং সমকালকে নিয়ে এগিয়ে যান মহাকালের দিকে। দশক কখনো বড় বিষয় ছিল না, এখনো নেই। রচয়িতার চেয়ে রচনাই বড় হয়ে উঠবে, এটিও বড় সত্য। শিল্পসৃষ্টির আদি ইতিহাস থেকে আমরা দেখেছি, শিল্পই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে। কোথায় হারিয়ে যায় সৃজনকার, কখনো কখনো তার হদিস পর্যন্ত পাওয়া যায় না। অজন্তা ইলোরা গুহাচিত্রে আমরা মুগ্ধ হই। কিন্তু বলো, সৃজনকার কে? অথবা মমি প্রস্তুতকারক সম্রাট কিংবা উচ্চকোটির অভিজাতবর্গের শবাধারে গলিত স্বর্ণ এবং মিশ্র ধাতুর যে কারুকাজ, শোভা, সৌকর্য রয়েছে, তাতো রয়ে গেছে। কিন্তু শিল্পী কে? তিনি তো তাঁর নামটি পর্যন্ত উৎকীর্ণ করেননি। মমির শবাধারের সৌন্দর্যে তিনি নিজের আমিত্বকে বিসর্জন দিয়েছেন। কিংবা ধরো, দাকিকির ব্যালাড থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে শাহনামা লিখেছেন, ফেরদৌসীর এই স্বীকারেক্তি আমরা জানি। কিন্তু দাকিকি কে? আমরা তো তাকে চিনিনে। এমনকী পারসিকরাও। সোনারতরী কবিতায় রবীন্দ্রনাথ এই আক্ষেপটুকুইতো করে গেছেন। কাজেই দশক শতকের অন্তরালে যেখানে কবিই হারিয়ে যান, সেখানে কবিতাকে টিকে থাকতে হলে মহাকালিক হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই।
তুমি ঠিকই ধরেছ, আশির দশকের গোড়া থেকে আমি লিখছি। আসলে লিখছি আরও আগে থেকেই। কবিতার প্রকাশ (বিভিন্ন পত্রিকায়) যদি ধরো, তো সেটা আশির দশক। প্রথম থেকেই কবিতায় আমার স্বরটি বলিষ্ঠ ছিল বলে কখনো আমাকে নারীদের জন্য বরাদ্দ পাতায় লিখতে হয়নি। আমার বয়স চট্টগ্রামের আশির দশকের কবিদের চেয়ে প্রায় ৬/৭ বছর কম হওয়ার পরও দ্রুত আমি তাদের দলের হয়ে উঠি। ওই সময় সুমন ইসলাম বের করতেন ‘অব্যয়’, আহমেদ রায়হান ‘হৃদপিণ্ড’, এজাজ ইউসুফী ‘লিরিক’, কেশব জিপসী ‘পালকী’ আরও বেশকিছু ছোটকাগজ। ওগুলোতে লিখতাম। প্রথমদিকে স্থানীয় পরে জাতীয় দৈনিকে লেখা শুরু করি। লেখালেখির প্রায় ১৭/১৮ বছর পর ১৯৯৪ সালে প্রথম বই (কবিতা) ‘অন্ধকার হে অন্তর্গত’ প্রকাশিত হয়। বইটির ব্যাপারে একটি কথা না বললেই নয়, পাণ্ডুলিপিটি নিয়ে আমার বন্ধু দুলাল দাশগুপ্ত (বর্তমানে গুটেনবার্গ প্রেসের স্বত্বাধিকারী) মোমেন ভাইকে দিলেন। তিনি একটি মাত্র শব্দ গোরখোর বদলিয়ে গোরখোদক করা ছাড়া আর কিছু করলেন না। ফ্ল্যাপে লিখলেন,
‘এটি মহিলা কবির গ্রন্থ নয়। খণ্ডিত, তদুপরি আচ্ছাদিত, ছায়াবৃত এবং অনিশ্চিতির ভীরুতায় অর্ধস্ফূট জগতের যে মেয়েলি কবিতার সাথে আমরা পরিচিত এ-কবিতা তা নয়। প্রেম, বিরহ, বেদনা ও নৈঃসঙ্গ নিছক মেয়েলি আকুতিতে নিঃশেষিত হয় না, যে কোনো বোধই সেলিনা শেলীর অগ্নিতে জ্বলে ওঠে। প্রেমের বোধোদয় ঘটে প্রশ্নে, সূর্যাস্তের মতো ঘনায় দহন, অমোঘ হয়ে ওঠ যন্ত্রণা ও হাহাকার। তীব্র তিক্ত প্রতিক্রিয়ায় কবি টলে ওঠেন, কবিতাও টলে, ছলকে পড়ে তখন। অস্থির অনিশ্চিত বটে, তবু পা বাড়ান, অন্ধকারকেও আপন করে নিয়ে।’
’৮৬ তে যখন দৈনিক পূর্বকোণ বেরোয়, তখন মোমেন ভাই আমার ‘কিশোরী সময় যায় সখাহীন একা/ বাড়ন্ত রোদ্দুরে পোড়ে হৃদয় মৃত্তিকা’ (সময়) কবিতাটি সাহিত্য পাতায় খুব গুরুত্ব দিয়ে ছাপেন। শিশির দত্ত তখন সাহিত্য সম্পাদক। বহু বহু লেখা তিনি আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিলেন। আমরা যারা লেখালেখি করতাম, প্রায় সবাই কবি আবুল মোমেনর যত্নে গড়ে উঠেছি। ‘অচিরা’ নামে একটি পত্রিকাও এসময় তিনি সম্পাদনা করতেন, যদিও কবি তপন জ্যোতি বড়ুয়াসহ আরও দু’একজন এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ‘অচিরা’ নামে যে পাঠচক্র ছিল, আশির দশকের কবি ও কবিতার পরিচর্যায় তার অবদান সুদূরপ্রসারী। সে এক বিরাট অধ্যায়। আমার কাব্যগ্রন্থ ‘চিতাচৈতন্যের গান’ তো আমি তাঁকেই উৎসর্গ করেছি। যা-ই হোক, আশির দশকের শুরুর দিকে আমরা বেশ ক’জন কবি (আসাদ মান্নান, মহীবুল আজিজ, হাফিজ রশিদ খান, এজাজ ইউসুফী, শ. ম. বখতিয়ার, আবু মুসা চৌধুরী, লুলুল বাহার, শাহিদ আনোয়ার, গৌতম আশীষ, ডা. বিশ্বনাথ, ডা. ইমদাদুল হক (পরে তার গ্রামের বাড়িতে চরমপন্থীদের হাতে নিহত) ডা. জিল্লুর রহমান, সোহেল রাব্বি (২০০৪-এ সিরাজগঞ্জে অপঘাতে নিহত), আহমেদ রায়হান, সুমন ইসলাম, এরকম আরও কেউ কেউ মিলে ‘ক’ নামে একটি কবিতা সংগঠন গড়ে তুলি। সারা চট্টগ্রামে ‘ক’-এর নানা অনুষ্ঠান করেছি আমরা। লোকে কবিতা শোনার জন্য ব্যাপকভাবে সাড়া দিতো। প্রায় সব অনুষ্ঠানই পরিচালনা করতাম আমি। মহীবুল আজিজ আমাদের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। আর তেমন কিছু মনে নেই। লালদিঘির তালসুপারি তলায় আর নোবেলটি রেস্তোরাঁয় (লালদিঘি) আমাদের আড্ডা বসতো। অন্যদিকে নাসিরাবাদ সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ কবি-লেখক চেমন আরার সরকারি বাসভবনের সেই উঁচু টিলায় তার ¯স্নেহ ছায়ায় কত না কাব্যের বিকেল গড়িয়ে রাত হয়েছে আমাদের। কাপাসগোলায় সবুজ হোটেলও সাক্ষী হয়ে আছে আমাদের আড্ডার। বোস ব্রাদার্সেও আমরা বসতাম প্রায়ই। শেষের দিকে গুটেনবার্গ-কাটাপাহাড় লেনে।
পাস করার পরে ভাবলাম এত কাজ একসঙ্গে করা কঠিন। কেবল লিখব, আর চাকরি করব। শুরুতে ‘সুপ্রভাত বাংলাদেশ’-এর সম্পাদক রুশো মাহমুদের উদ্যোগে খোকন কায়সার, রেহানা বেগম রানু, রফিকুল বাহার, বাবরসহ বেশ ক’জন মিলে আমরা দু’টো পত্রিকা করি। একটা শায়েস্তা খান স্যারের তত্ত্বাবধানে ‘হ্যাট্রিক’ (খেলার কাগজ, এত ভালো পত্রিকা আজও চোখে পড়ে না) অন্যটি ‘পথ থেকে পথে’। শেষ অব্দি সবাই নানাভাবে কর্মজীবনে (চাকরি) ঢুকে পড়ায় পত্রিকা দু’টিও বন্ধ হয়ে যায়। এত কাজ এত স্মৃতি, ভোলা যায় না। চট্টগ্রামে যখন আবুল মোমেন বীর প্রতীক ফারুক ই আজমসহ প্রথম বিজয় মেলা হয়, সম্ভবত ’৮৮ সালে; সেই কমিটিতে আমিও ছিলাম। ’৮৯-এ রাঙামাটিতে প্রথম বিজয় মেলার উদ্বোধনে তাঁদের সঙ্গে অতিথি হিসেবে আমিও গিয়েছিলাম। একবার একটা মজার ঘটনা ঘটলো। বড় জোব্বা পরে কোনো এক অনুষ্ঠানে ত্রিদিব দস্তিদার এলেন। আমার সঙ্গে তাঁর জানাশোনা নেই। হঠাৎ সামনে এসে বললেন, জানেন, আমি আপনার দশটা কবিতা মুখস্ত বলতে পারব। আমি হা করে তাকিয়ে রইলাম, তিনি অনর্গল আবৃত্তি করে গেলেন। অনেক লোক জমা হয়ে গেলো। পরে জানলাম, কবি ত্রিদিব দস্তিদার বহুকবির পুরো বই মুখস্ত বলতে পারতেন। যা-ই হোক, এত স্মৃতি শেষ করা যাবে না।
হ্যাঁ কবিতার পাশাপাশি আমি সবসময়ই গদ্য লিখেছি নানা বিষয়ে, গল্পও। সেসময় ‘সংবাদ’ আর ‘ভোরের কাগজ’ খুব নামি পত্রিকা ছিল। কিছু কিছু গল্প ওগুলোতে ছাপা হলো। অনেক পরে ২০০০ সালের দিকে শৈলী প্রকাশনীর কবি রাশেদ রউফ জোর করে বই বার করলেন। নাম দিলাম ‘হনন’। অবাক কাণ্ড বছর না ঘুরতেই সব বই বিক্রি হয়ে গেলো। এমনকী শৈলীতেও দু’এক কপি আছে কি-না সন্দেহ।
মনজুর কাদের: দশকভিত্তিতেই কবিতার বাঁক বা পরিবর্তন নির্ণীত হচ্ছে। কবিতার বিশেষ পরিবর্তনটা কোথায়?
সেলিনা শেলী: দ্যাখো, দশকের ভিত্তিতেই কবিতার বাঁক পরিবর্তন হচ্ছে; তোমার এই প্রশ্নের কিছুটা উত্তর আগে পেয়েছো। শিল্পসাহিত্য করতে গেলে এই রাজ্যের শাসকদের সময়কাল জন্মপরম্পরা জানাটাও জরুরি। তাতে তুলনামূলক বিচার বিশ্লেষণী চোখটিও খুলে যায়।
বাংলা কবিতার বাঁক বদল যদি বলো, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ এঁদের পরে তিরিশের দশকের মতো এতো প্রভাববিস্তারী সময় আর আসেনি। এমনকী মহান মুক্তিযুদ্ধও আমাদের কবিতা বা শিল্পকলাকে ত্রিশের দশকের চেয়ে তীব্র মাত্রা দিতে পারেনি। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মুক্তিযুদ্ধ টোটাল শিল্পসাহিত্যের বাঁক বদলে দিয়েছে। কিন্তু কবিতার যে চিন্তন প্রকরণ, যে গঠনপ্রক্রিয়া সেখানে কল্লোলীয় কবিদের যে বাঁক নেওয়া, যে বিদ্রোহ, তা তো আর আসেনি। কেবল বিষয় পাল্টেছে।
কবিতা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। ৫০ এবং ৬০ এর কবিরা বাঙালির একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। ৬০ এর কবিতায় যে স্যাডনেস কাজ করেছে তার উত্তরণ দেখি ৭০-এ এসে। বিবরণধর্মী দীর্ঘ দীর্ঘ কবিতা রচিত হয় এসময়। ৮০-তে যদিও এই ধারাটি একেবারেই বিলুপ্ত হয় না। তবু দেখি পৃথুল বাগভঙ্গীর কবিতার বদলে ফরাসি কবিতার মিতবাক সংযত কবিতাও এসময় রচিত হয়েছে। স্বৈরাচারী এরশাদ শাসনামলের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদী সেইসব কবিতা সময়ের দলিল হয়ে থাকবে। মৃন্ময় একটি দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ৮০-র দশকের কবিতায়। নব্বইয়ের কোনো কোনো কবির কবিতায় দেখি সেটি একেবারে গুহ্যতান্ত্রিকতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। অথচ সেই সময়েই মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল স্বাধীনতাবিরোধীদের চরম উত্থান ঘটেছে এদেশে। তবে মোদ্দা কথা হচ্ছে, কোনো কবিতা যদি পাঠান্তেই ফুরিয়ে না যায়, তোমাকে ঘোরের মধ্যে রাখে, বারবার নতুন স্বাদ এনে দেয়, আমার বিবেচনায়, তাই কবিতা। বিষয়আশয় সেখানে মুখ্য নয়। একটি কবিতা তো নানাভাবেই উৎরে যেতে পারে। তার ধ্বনিময়তা, শব্দবিভা, তার ছন্দ, উপমা, ব্যঞ্জনা বহুরৈখিকতা…। নানা দশকে নানান কবি তো এভাবেই বেঁচে থাকেন। ভারতচন্দ্রের আশ্রয়ে বলতে পারি, যে হৌক সে হৌক ভাষা, কাব্যরস লয়ে।
মনজুর কাদের: বাংলা কবিতার বাঁক পরিবর্তনের ঐতিহ্যময় ধারায় কোন কবিদের কবিতা আপনাকে বিশেষ আলোড়িত করে?
সেলিনা শেলী: তোমার এই প্রশ্নের উত্তরে আমি বলব, কোনো বিশেষ কবিদের বা দশককে আলাদা করে কিছু বলাটা সম্ভব নয়। বাংলা কবিতার ইতিহাস যদি তুমি দেখো, তো দেখবে ১৮৫৭ সালে বিশ্বসাহিত্যে আধুনিকতার জনক বলে খ্যাত বোদলেয়ারের ‘ফ্ল্যর দ্য মাল’ যখন প্রকাশিত হয়, তার আগেই মাইকেলের ‘দ্য কেপটিভ লেডি’ (১৮৪৮) আর ‘ভিশন অব দ্য পাস্ট’ (১৮৪৮) প্রকাশিত হয়েছিল। পরের বছর প্রকাশিত হয়েছিল রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’। তিনিই প্রথম আধুনিক শব্দটি ব্যবহার করেন, যদিও তিনি মাইকেলের মতো আধুনিক ছিলেন না। ‘ফ্ল্যর দ্য মাল’ যখন প্রকাশিত হয় তখন রবীন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেননি। বোদলেয়ারের জন্মের চল্লিশ বছর পর রবীন্দ্রনাথের জন্ম। বোদলেয়ার যখন মৃত্যুবরণ করেন, তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ছয়। যে বছর মাইকেলের ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’ আর ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ প্রকাশিত হয়; সেবছরই রবীন্দ্রনাথেরও জন্ম। বোদলেয়ারের আধুনিকতা নিয়ে এত এত মাতামাতি করে ভারতচন্দ্রকে আমরা আখ্যা দিয়েছি মধ্যযুগের কবি। যিনি বলেন, ‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়?’
তবে ভাষার অতিক্রমণটা একটু লক্ষণীয়। মধ্যযুগের উদাহরণ দেই, নানা ‘কাব্যকথায় কৌতুক মনের সুখে।/ মুনিকে করিল বশ যত সভ্যলোকে।’
কিন্তু এই ভাষাকে অতিক্রম করে গেলো ১৯৫৯ সালে ‘তিলোত্তমা সম্ভব কাব্য’- ‘ধবল নামেতে গিরি হিমাদ্রির শিরে/ অভ্রভেদী-আত্মা, ভীষণ দর্শন;/ সতত ধবলাকৃতি, অচল অটল;/ যেন উর্ধ্ববাহু শুভ্রবেশধারী,/ নিমগ্ন তপঃসাগরে ব্যোমকেশ শূলী/ যোগী কুলধ্যয় যোগী!’
তখনই বাংলাকাব্য বিশারদরা চমকে উঠলেন। এই কী ভাষা, এই কী প্রকাশ প্রকরণ!
তারপর দ্যাখো, বাংলাকাব্যে নতুন আত্মবোধের উদ্ভাসে নতুন প্রকরণের কী খেলাই না শুরু হলো। ‘তুমিও আইস, দেবী তুমি মধুকরী/ কল্পনা। কবির চিত্ত ফুলবন-মধু/ লয়ে, রচ মধুচক্র, গৌড়জন যাহে/ আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি।’
এবং তারপরে পশ্চিমা পুঁজি-প্রযুক্তি দৃষ্ট হাওয়া গৌড়জনের চিত্তকে কিভাবে চঞ্চল করে দিলো, বদলে দিলো, দ্যাখো ‘আমি সব দেবতারে ছেড়ে/ আমার প্রাণের কাছে চলে আসি,/ বলি আমি এই হৃদয়েরে/ সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়।’
এভাবেই তো কবিদের ভেতর আরও এক বিপন্ন বিস্ময় জেগে ওঠে। কাজেই উষ্ণা উষ্ণা পাবত তহি বসই সবরী বালী থেকে এপর্যন্ত সর্বত্রই আমার মুগ্ধ বিচরণ, এককভাবে কোনো বিশেষ কাল বা কবিকে আলাদা করা যাবে না।
মনজুর কাদের: এই সময়ের কবিতার ছন্দ প্রসঙ্গে আপনার অভিমত কী? বর্তমান সময়ের কবিতা সম্পর্কে বলুন।
সেলিনা শেলী: তোমার এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, বাক্যং রসাত্মকং কাব্যম। রসাত্মক বাক্যই কাব্য। কবিতার ছন্দ বা ব্যাকরণ নিয়ে কত না কথা হয়েছে হচ্ছে হবে, তাই বলে ব্যাকরণ যেমন কবিতা হয়ে যায়নি, কবিতাও ব্যাকরণ নয়। বাক্য তুমি উচ্চারণ করো, তারপর পাণিণিগণ খোঁজেন তার ব্যাকরণ। কবিতাও তা-ই। এ দু’য়ের তাহলে আর ব্যাকরণ কী। এ-তো নিত্য ভাঙাগড়ার, এরভিন শ্রয়েডিঙ্গার যাকে গাণিতিক স্ববিরোধ বলেছেন, তারই মতো। তবে ভাঙাগড়ার আগে সবটুকু জানতে হবে, জানার মুন্সিয়ানা দেখাতে হবে। বাংলা কবিতা এযাবৎ কালে কখনোই ছন্দহীন হয়ে ওঠেনি। চালের নানা হেরফের করে ভেঙেচুরে নতুন অপ্রচল ছন্দটি যদি সঠিকভাবে প্রয়োগ করা না যায় পাঠক তা মানবে কী করে। মাইকেলের সনেট জীবনানন্দে এসে যেমন বদলে গেছে আল মাহমুদে তেমনি আরও। শক্তিমান কবি ছাড়া এই ভাঙচুর খেলা কেবলি কবিতার সর্বনাশ ডেকে আনে। ইদানিং ছন্দের নানারকম ভাঙচুর হচ্ছে; যার কোনো স্ট্যান্ডার্ড হিসাবনিকাশ নেই। কবিকে মনে রাখতে হবে, একটি ছন্দকে অস্বীকার করতে হলে তার চেয়ে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য ছন্দকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। যদি তুমি গদ্য কবিতার কথা বলো, তা-ও কিন্তু ছন্দহীন নয় এবং মনে রাখতে হবে ছন্দে সিদ্ধহস্ত কবিদের হাতেই গদ্যকবিতার সবচেয়ে বেশি উত্তরণ ঘটেছে।
আমি প্রচুর পড়ি। সব বিষয়েই আমার সমান আগ্রহ। দর্শন রাজনীতি অর্থনীতি বলে কোনো কথা নেই। ছোট কবি বড় কবি বলেও কোনো কথা নেই। যে কবিতা এক পাঠেই ফুরিয়ে যায় না, যা আমাকে ধরে রাখতে পারে, তা-ই পড়ি। এসময়ে প্রচুর ভালো কবিতা লেখা হচ্ছে। পাশাপাশি মন্দ কবিতাও। তবে ছন্দহীনতা কখনো কবিতা হতে পারে না।
মনজুর কাদের: কবিতায় প্রভাব নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে এবং হচ্ছে। পাঠক হিসেবে যখন আপনি সেলিনা শেলীর কবিতা পড়েন তখন কোথায় কোথায় আপনার স্বাতন্ত্র্য খুঁজে পান? এখানে সেলিনা শেলীকে ব্যাখ্যা করুন।
সেলিনা শেলী: একজন কবির ওপর পূর্বজের প্রভাব থাকবে, এটা তো খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তা যেনো হয় একটা পর্যায় পর্যন্ত। কবিকে সেই প্রভাব কাটিয়ে উঠে স্বভাষা নির্মাণ করতে হবে। আমার কবিতায় কারও প্রভাব আছে কি-না, থাকলে কতোটুকু; তা তো তোমরাই ভালো বলতে পারবে। আমি শুধু বলব, সচেতনভাবে আমি আমার কাব্যভাষায় এবং ভঙ্গিতে নিজস্বতা নিয়ে আমাকে প্রকাশ করতে চাই।
আমরা যখন আমাদের প্রিয় মানুষটি ভালোভাবে দেখতে চাই, তখন মুখ বা দৃষ্টি একটু তফাতে আনতে হয়। তেমনি কবিতা লেখার পরও একটু সময় নিয়ে সেটাকে পাঠ করি। কখনো বদলাই কখনো বদলাই না, ছিঁড়েও ফেলি। আমার কবিতা একরৈখিক নয়, চিন্তানুচিন্তনে, বিষয়ে, প্রকরণে বহুমুখী। কবি আবু হাসান শাহরিয়ার, ওপার বাংলার শ্রুতি আন্দোলনের কবি মৃণাল বসু চৌধুরী বা আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ড. মনিরুজ্জামানসহ আরও অনেককেই এই বিষয়গুলো মুগ্ধ করেছে, অন্তত, তাদের আলোচনা একথাই বলে। সেজন্য আমি কৃতজ্ঞ। সেদিন এক পত্রিকায় দেখি ‘প্রমা’র পরিচালক আবৃত্তিশিল্পী রাশেদ হাসান এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘সেলিনা শেলীর ‘ব্ল্যাক রেইন’ কবিতাটি সব অনুষ্ঠানে শুরুতেই আমি আবৃত্তি করি। দুই বাংলার বহু সংগঠনে আমার কবিতা আবৃত্তি হচ্ছে, যারা আমাকে চেনে না, আমিও না। এই প্রাপ্তির কোনো তুলনা হয় না। কিন্তু আমার গদ্যের বিশেষ করে, গবেষণাধর্মী প্রবন্ধের বই ‘কবিতার ব্যঞ্জন ও ব্যঞ্জনা’ আরও বেশি আলোচিত হলে আমি খুশি হতাম। কারণ কবিতার আলোচনা করতে গিয়ে আমি প্রাচীন ইতিহাস, পুরাতত্ত্ব, মিথ, নৃতত্ত্ব, সব আদ্যোপান্ত ঘুরে কবিতাকে বিশ্ববীক্ষায় উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি। আমি দাবি করে বলতে পারি, আমার গদ্যভাষারও আলাদা একটি শৈলী আছে, যা কেবলি আমার।
তবে আমাকে অনেক বেশি পারিবারিক এবং সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে হয়। বিখ্যাত পাঞ্জাবি কবি অমৃতা প্রীতমের একটি কথা সবসময় আমার মনে পড়ে, নারীর লেখার ক্ষমতা থাকা পাপ। কত গভীর বেদনা থেকে বেরিয়ে এসেছে, এই কথাটিতে ভাবতে পারো? লেখার জন্য তিনি ভারতের সর্বোচ্চ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। কিন্তু প্রথম সংসার ছেড়ে জীবন পাল্টাতে হয়েছিল তাকে। কষ্ট পেয়েছিলেন সিলভিয়া প্লাথ, কমলা দাশও। কিন্তু আমি তো সেরকম বড় কেউ নই। সেই যোগ্যতাও নেই। অনেক ক্লান্তির ভেতর জীবিকার জটিল জঙ্গমে আমি যখন হাঁপিয়ে উঠি, তখনো নিজেকে পুনঃনির্মান করতে চাই। আজকে সেলিনা শেলী হয়ে উঠতে বহু বহু কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে আমাকে। পরিবার-সমাজ এবং পুরুষতান্ত্রিক কবিমানসের ভেতর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার এই যুদ্ধ অনেক কঠিন। আমি কখনও দশের মধ্যে এক হতে চাইনি, এগারো হতে চেয়েছি। যা ভালো, অকপটে বলি, ভালো না হলে তাও বলি। আমাদের কবিরা নিজের প্রশংসা শুনতে ভালোবাসে কিন্তু অপরের প্রশংসায় বড় কৃপণ। এই দীনতা কাউকে বড় করে না। সমস্যা যে, রক্তের মতো আমাদের বোধের তো উত্তরাধিকার ঘটে না। আমরা এই জাগতিক বিশ্বের এমন এক প্রাণী, যারা কেবল ইচ্ছা-পদ্ধতিতেই চলি। আর সেই ইচ্ছা-পদ্ধতিটি নারীর জন্যে আজও পুরোপুরি অর্গলমুক্ত নয়। আবার উল্টো করেও বলা যায়, সে চাইলেই পুরোপুরি অর্গলমুক্ত হতে পারে, তবে তার আগে আরও বহু জায়গা থেকে তাকে মুক্তি নিতে হবে। সেলিনা শেলী এইসব ঘেরাটোপের বাইরে নয়, ভেতরে।
মনজুর কাদের: তবে আমি মনে করি অর্থনৈতিক মুক্তিই নারীমুক্তির প্রধান উপায়।
সেলিনা শেলী: একদম ঠিক কথা। কিন্তু বিষয়টিকে একটু ঘুরিয়ে দ্যাখো, অর্থনৈতিক মুক্তি ছাড়া একজন পুরুষও কি মুক্ত? আসলে আর্থিক নিশ্চায়ন একজন মানুষকে তার অন্যান্য যে সম্পর্ক এবং স্বপ্ন; সেগুলোকে করায়ত্ত করতে সাহায্য করে। তার ক্ষমতায়ন ঘটায়, সিদ্ধান্ত দেওয়ার জায়গাটি তৈরি করে। সেজন্য অর্থনৈতিক মুক্তি কেবল নারীর নয়, সবারই মুক্তি ঘটায়।
মনজুর কাদের: বর্তমানে বাংলা সাহিত্যের আলোচনা-সমালোচনা চর্চা কতটা গঠনমূলক কিংবা কেমন হচ্ছে?
সেলিনা শেলী: আসলে সস্তা চটকদার গিমিক দিয়ে তো আর কবিতা হয় না; সমালোচনাও পিঠচুলকানি বা একেবারেই খারিজি পদ্ধতির হতে পারে না। কোনোও কাজের সমালোচনা-আলোচনা বলতে আমি বুঝি, সেই কাজটি আরও পরিশীলিতভাবে এগিয়ে নেওয়ারই একটি প্রক্রিয়া। সমালোচকের কাজ হচ্ছে লেখক এবং পাঠকের বহুদর্শী চোখ খুলে দেওয়া। এটি একটি গঠনমূলক প্রক্রিয়া। এ কথার প্রমাণ তুমি আমার কবিতার ‘ব্যঞ্জন ও ব্যঞ্জনা’ গ্রন্থেও পাবে। শিল্পসৃজন এবং অনুরাগ এই দু’য়ের মূলেই থাকে জন্মগত প্রবণতা। তাই খুব শিক্ষিত হলেই খুব কবিতা বুঝবেন কেউ; এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। অধীত বিদ্যা কবিতার উৎস নয়। কবিতার উৎস কবিস্বভাব। যার এই স্বভাব আছে, বিদ্যা তার সৃজনকে আরও সমৃদ্ধ করে। কিন্তু যার তা নেই, বিদ্যা তাকে সত্যিকার সৃজনে সাহায্য করতে পারে না। একজন পাঠকের কবিতায় সাড়া দেওয়াটাও সেরকমই। যার মধ্যে এই সংবেদনশীলতা জন্ম থেকেই আছে, অধীত বিদ্যা তার গ্রহণক্ষমতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। কিন্তু যার নেই, হাজার কবিতা পড়লেও কবিতার প্রবেশদ্বার তার জন্যে রুদ্ধই থেকে যাবে। সমালোচক কবিতা নিয়ে কথা বলার আগে কবিকেই সে কাজটি করতে হবে। বোদলেয়ার তো বলেই গেছেন, প্রত্যেক বড় কবি স্বভাবতই অনিবার্যরূপেই সমালোচক। একজন সমালোচক কবি হয়ে উঠলে আশ্চর্য হওয়ার কথা, কিন্তু একজন কবির মধ্যে যদি একজন সমালোচক জেগে না থাকে, সেটা আরও আশ্চর্যের। ত্রিশের দশকে কেউ কেউ যেমন রবীন্দ্রনাথকে খারিজ করে দিয়েছিলেন তেমনি জীবনানন্দ দাশকেও পাত্তা দেওয়া হয়নি। এক বুদ্ধদেব বসুই তাঁকে তুলে এনেছিলেন। তা জীবদ্দশায় ৫/৬টির বেশি কবিতা প্রকাশিতও হয়নি, জীবনানন্দের। অন্যদিকে হেমচন্দ্র বাগচীকে বুদ্ধদেব বসু তাঁর আধুনিক বাংলা কবিতায় কবি হিসেবে স্থান দিলেও আজকের পাঠকেরা তাকে চেনেনই না বলতে গেলে। আমাদের সমালোচকদের অনেকেই কবিতার ক্রমবিবর্তন-রূপান্তর প্রক্রিয়াটি না জেনেই কবিতার সমালোচনায় কলম ধরেন। এদেরই জীবনানন্দ দাশ অশিক্ষিত পটু বলেছেন। আমি মনে করি, কবিতার মতো পাঠক-সমালোচককেও পরিবর্তমান হতে হয়, আর এটি করতে প্রচুর পঠন-পাঠনের দরকার। তেমনি কবি ও অকবিকে চিহ্নিতকরণেও লাগে একনিষ্ঠ প্রজ্ঞা আর হিম্মত। সততার সংজ্ঞা বলতে আমি বুঝি, কেবল নিজে সৎ থাকা নয়, অন্যের অসততাকেও প্রতিরোধ করা। কবিতার সমালোচনাকেও আমি সেই কষ্টিপাথরে যাচাই করতে চাই। এক্ষেত্রে কবি আবু হাসান শাহরিয়ারের দু’টি কথা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এক. সৎ সমালোচককে সম্পর্কবিচারী হলে চলে না। হতে হয় গুণবিচারী দুই. কোনও সমকালে সম্পাদক-সমালোচক একযোগে কবিতামূর্খ হলে একার সন্ন্যাসই খাঁটি কবিদের উত্তম অবলম্বন।
কবিতা বরাবরই পুনঃনির্মান। এ হচ্ছে মানবজীবনের অন্তরের মনিকোঠার সেই কণ্ঠস্বর; যা হাজার হাজার বছর বয়সী, আবার তোমার আমার সমকালের সমানও। এমনকী যে অনাগত, তারও বয়সী। অক্টাভিও পাজ যাকে হাতের কাছের এবং সর্বদা দূরের বলেছেন, সেই স্বরটিকে বুঝতে না পারলে সাহিত্য সমালোচনায় হাত না দেওয়াই উচিত।
একটা লেখাকে ইমোশনালি দেখা আর ক্লিনিক্যালি দেখা, দুটোর তো দুই আবেদন হবে। টেলেন্টেড ক্রিটিক না থাকলে ভালো লেখাগুলো সবসময় পাঠকের চোখে পড়ে না। আমি তো গত ২০/২৫ বছরে তেমন কোনো ক্রিটিক দেখিনি, যিনি সাহিত্যের নতুন দিক নতুন চিন্তাকে আমাদের সামনে ভিজুয়ালাইজড করেছেন। ফুকো, দেরিদা, মার্কস, এঙ্গেলস্ করে করে মূল বাস্তবতার (যা তার বলার কথা) জায়গাটিই সে হারিয়ে ফেলেছে। তাকে জিজ্ঞেস করো, আপনি যাকে নিয়ে বললেন, তার বিশেষ দিকগুলো কী কী এবং কেন? দেখবে গুলিয়ে ফেলবে।
মনজুর কাদের: আপনি তো ছাত্রজীবনে প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
সেলিনা শেলী: সেসময় আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী হিসেবে কাজ করেছি। পাশাপাশি নাটক করেছি সারাদেশে কামাল উদ্দীন নীলু স্যার এবং জিয়া হায়দার স্যারের নির্দেশনায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থিয়েটারের হয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক জোটের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলাম (আমার সঙ্গে অন্যজন ছিলেন মহীবুল আজিজ)। বি.এস.ইউ এর কালচারাল স্কোয়াড চালাতাম। তুমি বিশ্বাস করতে পারো, আমার এক ডাকে চার পাঁচশ ছেলেমেয়ে বেরিয়ে পড়তো মিছিলে। মৌলবাদী চক্রের হাতে বার কয়েক আহত হলাম। একবার, ইংরেজি বিভাগের একটি ছেলে, যার সঙ্গে কোনোদিন একটি কথাও হয়নি আমার; সে ছুরি নিয়ে উন্মত্তভাবে আমাকে তাড়া করল। দীর্ঘসময় ধরে আমার বন্ধুরা আমাকে বাঁচাবার লড়াই করে গেলো। শেষ পর্যন্ত গোলাম মুস্তাফা স্যারের রুমে আশ্রয় নিলাম। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও গোলাম মুস্তাফা স্যার, শামসুল আলম স্যার, অনুপম সেন স্যার আমাকে বাসায় দিয়ে গেলেন। ’৯০ এর ৮ জানুয়ারি শিবিরের বিরুদ্ধে সংগ্রামী ছাত্রঐক্য বিশাল ব্যবধানে জয়লাভ করলো। আমাকে চাকসুর সাংস্কৃতিক সম্পাদকের পদটি দেওয়া হয়েছিল। পরে ঐক্যের স্বার্থে আমরা ছাত্রইউনিয়ন পদ ভাগাভাগির রাজনীতি থেকে সরে ত্যাগের আদর্শে সবগুলো পদ ছেড়ে কেবল টোকেন সদস্য পদটি রেখে নির্বাচন করলাম। নির্বাচন উত্তরকালে এরশাদের পতনের পর ছাত্রশিক্ষকদের সমবেত মিছিলে হামলা করে শিবির। এবং যে ছেলেটি প্রতিদিন আমাকে দু’বার সালাম দিতো, রিকশা ছেড়ে জোর করে তাতে আমাকে তুলে ভাড়া দিয়ে দিতো, সেই ছেলেটিই সবচে আগে আমার পিঠে মাথায় হকি স্টিক চালায়, লাথি দেয়। আমি অজ্ঞান হতে হতে তার বিভৎস মুখটিই দেখতে পেয়েছিলাম। তিনমাস চট্টগ্রাম মেডিক্যালে, বিভিন্ন ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন ছিলাম। মেয়র মহিউদ্দীন ফ্রি চিকিৎসার বন্দোবস্ত করেছিলেন। ভিসি আবদুল মান্নান স্যার (তখনও ভিসি হননি, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রধান)সহ আরও শিক্ষক বি.বি.সি-র উর্মি রহমানকে নিয়ে আমাদের বাসায় এসেছিলেন আমার সাক্ষাৎকার নিতে। বি.বি.সি সেটি প্রচার করেছিল যেদিন, সম্ভবত সেদিনই সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যু সংবাদটিও প্রচারিত হয়েছিল। আমার কবিতা, রাজনীতি আর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের প্রগতিশীল শিক্ষকদের কাছে আমাকে স্নেহভাজন করে তুলেছিল। চট্টগ্রাম শহরে তখন আমার ওপর নির্মম হামলার প্রতিবাদে পোস্টার বের হয়েছিল। বহু বহু ছাত্রছাত্রী শিক্ষক সেদিন আহত হয়েছিলেন, নিহতও। আমার ‘সেদিন কী দিন ছিল, এদিন কী দিন’ নামের দীর্ঘ গদ্যে এসব বিস্তারিত আছে।
মনজুর কাদের: আপনার এই অসাম্প্রদায়িক চেতনায় ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস কতটুকু? আপনি লিখেছেন গ্রন্থবিহীনধর্ম মানি কবিতায়, ঈশ্বরকে মুক্তি দিলাম/ অবশেষে মানুষ হলাম।
সেলিনা শেলী: অসাম্প্রদায়িক চেতনা থাকলেই ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস কম থাকে অথবা থাকে না, বিষয়টি তা নয়। অসাম্প্রদায়িকতা হচ্ছে, অন্য ধর্ম-সম্প্রদায়ের প্রতিও সমান শ্রদ্ধা সহনশীলতা দেখানো। সুফী মোতাহের হোসেন চৌধুরীর ‘সংস্কৃতি কথা’ প্রবন্ধের সেই বিখ্যাত উক্তিটি আমি জীবনেও যাপন করে নেই, ধর্ম সাধারণ লোকের কালচার, কালচার শিক্ষিত মার্জিত লোকের ধর্ম। আর একজন কবির চিন্তাচেতনা বিশ্বাস অবিশ্বাসের দলিলই তো তার কবিতা।
দ্যাখো, বাঙালির চিন্তা-চেতনা, দর্শন, কর্মকাণ্ড, বিশ্বাস, ধর্ম; সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে সামাজিক শ্রেণী। এক্ষেত্রে মধ্যবিত্ত শ্রেণীটি ক্রমবর্ধিষ্ণু। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ আর চাকরির মাধ্যমে এই শ্রেণীটি যে জীবনযাপন করে, সেটি ঠিক তার পূর্ববর্তী মাটিলগ্ন মানুষের ধ্যান ধারণার মতো নয়, অনেকটাই আরোপিত। আর বাদবাকি ৮০/৮৫ ভাগ মানুষ অশিক্ষিত স্বল্পশিক্ষিত কিন্তু গ্রাম্য সরলতায় নানা ধর্মের মিশেলে অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার আর অলৌকিক ব্যাপারস্যাপার নিয়েই থাকে। এভাবেই তারা একটা মিশেল ধর্মজীবনও পরিচালনা করে। এটিই তাদের সংস্কৃতি, যা আমাদের মতো মেকি বা আরোপিত নয়। যা দেখে, বোঝে, তা-ই বলে। অন্যদিকে উচ্চবিত্তের লোকেরা মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তের সংস্কৃতির ধারই ধারে না। এ রকম একটি পরিস্থিতিতে সমাজ নিয়ন্ত্রণের চাবিটি যখন নিম্নবিত্তের হাতে নেই, তখন সেই স্তর থেকে উঠে এসে যদি কেউ তথাকথিত শিক্ষিতকে চক্ষুষ্মান করতে চান, তা হয়ে ওঠে এক কঠিন কাজ। জীবনসত্য দিয়ে উপলব্ধ নিম্ন শ্রেণীর মুখোশহীন আরজ আলী যখন সত্য এবং ধর্ম বিশ্লেষণ করে তা মেলে ধরেন, ভয়ানক আত্মদর্পণে আত্মদর্শনে আমরা আঁতকে উঠি। এই কথাগুলো আরজ আলী মাতুব্বরের ওপর লেখা এক গদ্যেও আমি বলেছি।
দ্যাখো, শিশুরা সবসময়ই প্রশ্ন করে। ততক্ষণ প্রশ্ন করে, যতক্ষণ না উত্তরটি তার মনঃপুত হয়। আর আমরা বয়োজ্যেষ্ঠরা অন্তহীন এসব প্রশ্নের উত্তর সবসময় দিতে পারি না। দিতে চাইও না। কখনো কখনো নিজেরাও জবাবের দ্বিধায় ভেতরে ভেতরে আড়ষ্ট থাকি, উত্তর জানি না। জানলেও মনে মনে মানতে পারি না। মেকি মধ্যবিত্ত মনে সেই কথাটা প্রকাশ করতেও সংকোচ বোধ করি। তাই শিশুকে আশ্বস্ত করতে আঙুল উঁচিয়ে বলি, এসব প্রশ্ন করা পাপ। আর এভাবেই শিশুর প্রশ্নশীল মনটি অঙ্কুরেই আমরা বিনাশ করে দেই। সে জেনে যায়, প্রশ্ন করা পাপ। তাদের আমরা বামন হিসাবে গড়ে তুলি। অথচ সক্রেটিস বলেছেন, প্রশ্ন করো, উত্তর জেনে নাও। আবার সক্রেটিস সম্বন্ধেও ছাত্রদের কী রাখঢাক আমাদের। তাঁর ওপর এত পড়ানো হয়, অথচ বলা হয় না, তিনি নাস্তিক ছিলেন। পাছে ছাত্ররা জেনে যায় নাস্তিক্য কী জিনিস। অথবা যদি জেনে যায় যে, পৃথিবীর বহু খ্যাতিমান ব্যক্তিই সৎ এবং নাস্তিক ছিলেন।
মনজুর কাদের: আপনার কবিতায় শোষিতের অসহায় কান্না ও ক্রোধের শক্তি কিংবা প্রাত্যহিক জীবনের অনেক সংগ্রাম ও স্বপ্নের ছবি অঙ্কিত হয়।
সেলিনা শেলী: কবিতা তো একটি স্বতোঃপ্রণোদিত শিল্পমাধ্যম। কবি চিরকাল সমাজ ও মননের বিনির্মাণকারী। আমি যা ভাবি, করি, তাই তো আমার কবিতা বপন করবে। আমার দুই সন্তান জন্মালো। সেই আনন্দ বেদনার অনুভূতিও আমার কবিতায় আছে। সূঁচের ভেতর দিয়ে আসে জীবনীপ্রাণ/ মনে হলো কে জন্মালো, আমি, না আমার সন্তান। আমার কবিতা বহুরৈখিক। জীবনের সকল অনুভূতিকে বিষয়কে ধারণ করতে চায় সে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আমার কাছে মোহনীয়। অনেক অকাজেও খরচ হয়ে যায়, এই ছোট্ট জীবন। সেটিকেও কাজ ভেবে তৃপ্ত হতে চেষ্টা করি। আমার অদম্য প্রাণশক্তি আমাকে হারতে দেয় না, হতাশ করে না। কবিতায় তো, তাদেরই প্রতি-ছায়া পড়ে। আমার চিতাচৈতন্যের গান এ তুমুল প্রেম আছে, একেবারে মানুষের জীবনের তৃষ্ণাকাতর প্রেম। এখানে যে লিরিকগুলো আছে তার প্রশংসা বহুজনের কাছে শুনেছি, কেউ কেউ লিখেছেনও।
যেমন ধরো, ‘আমার বারান্দা জুড়ে মেঘে-রোদে চুমোচুমি হয়/ যে ডাকে গভীর সেও কানে কানে বুনো কথা কয়/ কথাই অকথা যদি কথকেরও না থাকে প্রতিভা/ জীবনের যতো রঙ, যতো স্বাদ– তারও বেশি বিভা/ যে জলে নেভে না তাপ– সে-ই জলই উর্বশীর খাড়–/ দু’পায়ে জড়িয়ে নিলে জং ধরা শরীরও সাঁতারু। ‘
আবার সেই ছিয়াশি সালে যখন লিখেছিলাম ‘কিশোরী সময় যায় সখাহীন একা/ বাড়ন্ত রোদ্দুরে পোড়ে হৃদয়মৃত্তিকা/ … জেনো, কিশোরীর বুকে অপেক্ষারা হিমায়িত থাকে।’ (সময়) তখন কবি আবুল মোমেন, শিশির দত্তসহ অনেকেই বলেছিলেন, তুমি বড় হতে পারবে। যদিও আজও বড় হতে পারিনি, কিন্তু লেখা চালিয়ে যাচ্ছি, যা একটি; এই ব্যস্ত জীবনে। আবার দ্যাখো, প্রাপ্ত কৈশোরে এসে কাঁচুলি পরার যে অভিজ্ঞতা প্রায় প্রতিটি মেয়েরই হয়, তার যে রোমাঞ্চ, শিহরণ, কী অবলীলায় সেটি আমি ব্যক্ত করেছি ‘হাওয়ায় হাওয়ায়’ কবিতায়: ‘বৃষ্টির মতো হালকা চালে চলি/ গোপনেই তাকে গোপন কথাটি বলি/ সে কী সে কথা গোপন রাখার পাত্র/ পাহাড়ে নদীতে, আকাশে সর্বত্র/ উড়ছে, ঘুরছে, হাসছে, নাচছে কেবলি/ আড়চোখে চায়, জেনেছে সবাই সকলি/ বাতাসের কানে, কানে কানে আমি বলেছিলাম গতরাতে/ ওরে হাওয়া শোন্, কিশোরী তো নই/ কাঁচুলি পরেছি গাত্রে’। অথবা ‘কী যে করি হায় বাতাসও তাকায়/ যুবকের মতো চোখে/ লজে মরে যাই, লজ্জায় ঢাকি/ উড়ুনীর ভাঁজে তাকে/ উদ্ধত ফনা তবু তোলে মুখ/ ভেতরে তুমুল তৃষ্ণা/ ওরে হাওয়া তুই উড়াসনে আর/ লজ্জাও ভেঙে দিস্ না।’
আবার রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা; দেশভাবনারও অনেক কবিতা আমার। যখন বিভীষণ বড়ই ভীষণ, ব্ল্যাক রেইন, গ্যালিওর বন্দিজীবন এরকম বহু কবিতায় অসাম্প্রদায়িক শক্তির পুণর্জাগরণ চেয়েছি আমি। যেমন ‘স্বদেশ আমার দ্রাঘিমা থেকে ছিটকে/ ঝুলে আছো ক্লীব হাওয়ায়/ লজ্জাও বুঝি লজ্জায় ঢাকে মুখ/ যখন বিভীষণ বড়ই ভীষণ।’
বহু কবিতায় শুধুই নিসর্গ যাপন করেছি আমি। যেমন আমার শঙ্খযাম কবিতাটির কথাই যদি ধরো ভূবনজোড়া সমুদ্র, পাহাড়, বৃক্ষ আর পাখ-পাখালির গান ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। ইনসাইটফুল-ভিশনারি, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পাঠককে সেগুলো খুঁজে নিতে হবে। ধর্ম নিয়ে আমার বোধন-চিন্তানুক্রমটিও ধরা পড়ে কবিতায়। আমার এই জীবিকা জটিল জীবনের যতো গ্লানি-বেদনার ছবিও ধারণ করেছে আমার কবিতা। আমার প্রার্থনা এবং শেষ আশ্রয়ের নামই তো কবিতা।
জীবনের দুঃখসুখ বেদনাবিপদ সকল সময়কেই আমি উদযাপন করি। রাজনীতি করতে গিয়ে ব্যাপক একটা জীবনবোধ তৈরি হয়েছে আমার। আবার কামাল উদ্দীন নীলু স্যারের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা নাট্য নির্দেশকের সঙ্গে নাটক করতে গিয়েও আমার যে অভিজ্ঞতা, আমি মনে করি, এসব আমাকে এত বেশি ঋদ্ধ করতে পেরেছে যে, যেকোনো পরিস্থিতিতে আমি পজেটিভ থাকতে পারি। রবীন্দ্রনাথ নজরুলদের মতো মানুষকে যখন দেখি, মাধুরী কিংবা বুলবুলের মৃত্যুকেও তারা সৃজনশীলতায় উদযাপন করেন, তখন শক্তি পাই। সাহস পাই।
মনজুর কাদের: একজন কবির রাজনৈতিক সত্তা, রাজনৈতিক কবিতা ও রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির কবিতা সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
সেলিনা শেলী: তোমার প্রশ্নের তিনটি অংশ। প্রথম অংশের উত্তরে বলব, কবি তো এই সমাজেরই মানুষ। শুধু তা-ই নয়, তাকে আমি অগ্রজ মানুষ বলে মনে করি। প্রাচীন পুরাণে তাকে তত্ত্বজ্ঞ আর সত্যদ্রষ্টা বলা হয়েছে, কেন? কারণ তিনি সমাজও রাষ্ট্রকে জানবেন, বুঝবেন, বিনির্মাণ করবেন। তাকে ত্রিকালজ্ঞও বলা হয়, কেননা, তিনি অতীতের হাত ধরে সমকালে ভবিষ্যৎবিস্তারী হতে জানেন। এই চেতনাবোধেরই আরেক নাম রাজনীতি। এই রাজারনীতি আদিষ্ট হয়ে খ্রিস্টের জন্মেরও আগে যেমন বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় কালিদাস লিখেছিলেন, মধ্যযুগের বহু কবির মতো ভারতচন্দ্রও। আবার আজকের কবিরাও রাজার আদেশে না হলেও রাজনীতির আদর্শে লিখছেন। সচেতন মানুষমাত্রই রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী হবেন; এ তো আমরা সবাই জানি। কবি তার বাইরে নন, বরং অগ্রগামী। আর সেকারণেই তো প্লেটো তাঁর আদর্শ রাষ্ট্রে কবিদেরকে নিষিদ্ধ করেছিলেন।
রাজনৈতিক কবিতা সময় ও সমাজের অকাট্য দলিল। পাবলো নেরুদা, কাহ্লিল জিবরান, মাহমুদ দারবিশসহ বহু বহু কবির নাম বলা যায়, যারা রাজনৈতিক কবিতা লিখে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিলেন। বাংলাভাষায়ও এরকম অনেক কবি রয়েছেন, তুমি জানো। তবে এই যে, আগেই বলেছি, বিষয় কোনো ব্যাপার নয়, শেষ পর্যন্ত তাকে কবিতাই হয়ে উঠতে হবে। রাজনৈতিক কবিতার দু’টি ঝুঁকি হচ্ছে, তাৎক্ষণিকতা এবং স্লোগানধর্মিতা। যে কবিতায় এই দু’টিই কেবল আছে কিন্তু কবিতা নেই তা তো টিকে থাকতে পারে না। কবিতার ইতিহাসে রাজনীতি ছিল, থাকবে। গ্রিক নাগরিকরা, অভিজাত এবং বর্ধিষ্ণু রোমানরা, মধ্যযুগের যাজকসহ বহ বহু রাজরাজরাগণ- এর জন্যে কবিরা কবিতা লিখতেন। আজ কিন্তু কবিরা আর রাজার জন্যে কবিতা লেখেন না, লেখেন নিজের জন্যে। অবশ্যি আশির দশকে স্বৈরাচারী এরশাদকে তোষামোদ করেও দু’চারজন কবি কলম ধরেছিলেন। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি করে কবিতা কেনো, কোনো শিল্পকলাই সার্থক হতে পারে না। লেজুড়বৃত্তি শব্দটিই তো মেরুদণ্ডহীন। কবিতা একটি স্বাধীন এবং ঋজুশিল্প। লেজুড়বৃত্তি দিয়ে আর যা-ই হোক কবিতা হয় না। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির কবিতায় সত্যি, সময় আর সংগ্রাম, কোনোটার ছবিই পাওয়া যায় না। উদ্দেশ্যটি খুব নেক্কারজনকভাবে প্রকাশিতও হয় বলে কাব্যরসও নষ্ট হয়ে যায়। ওই কবি এবং কবিতা- দু’টোই তখন নষ্টদের তালিকায় নাম লেখায়।
মনজুর কাদের : সাহিত্যে নারীবাদী কথাটির প্রচলন রয়েছে। এক্ষেত্রে নারীবাদী শব্দটির প্রয়োগ কতোটা যুক্তিসঙ্গত? আপনি সূতোয় বাঁধা ঘুড়ি কবিতায় লিখেছেন, ‘আমি তো গৃহপালিত জীব এক/ রাত্রির কোলে আকাশ তাড়া করে/ ঘুম আসে না।’ এই গৃহপালিত কষ্ট কি একজন নারীর সামাজিক অবস্থানগত বিষয়?
সেলিনা শেলী: দ্যাখো, নারীবাদ, পুরুষবাদ এতকথা আমি বুঝতে চাই না। আমি মনে করি নারীপুরুষ যেহেতু পরস্পরের চাহিদা মেটায়, তার ভোগ এবং উপভোগ দু’টোকেই মূল্য দিতে হবে। পুরুষ প্রধান সমাজ ও ধর্ম ব্যবস্থায় নারী সেই মূল্যটি পায় না। কিন্তু নারীরই প্রথম দায়িত্ব, সেটি অর্জন করার। নারীবাদ নিয়ে তো বিশ্বজুড়ে বহু বহু বই লেখা হয়েছে। হচ্ছে। কিন্তু নারী কতোদূর এগিয়েছে। সে যে মানুষ এই বোধটিও আমরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। মুখে বলা আর কাজে প্রয়োগ করায় এখনও দুস্তরব্যবধান। প্রত্যেক পরিবারে স্বামী যদি তার স্ত্রীকে সম্মান করেন, সন্তান তা শেখে। পুরুষসন্তান তখন তার বোধটিকে এবং পরে স্ত্রীকেও মূল্য দেয়। তারও আগে নারীকেই আত্মমর্যাদাশীল, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং কর্মক্ষম হয়ে উঠতে হবে। অর্থনীতির চাবি তারও হাতে থাকতে হবে। আমার বেশক’টি কবিতায় এসব বিষয় পাবে। যেমন, ‘বাঁচো নদী নিরন্তরে, বাঁচো মোহনায়/ নিজে না জাগিলে, মেয়ে, কে তোকে জাগায়!’ (রক্তের নুন থেকে তুলে আনি আলো)
অর্থ-ধর্ম-রাজনীতি-পুরুষতান্ত্রিকতা-মিডিয়া ইত্যকার শাসিত যুগে নারীবাদীরা তাদের লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। সেই নারীরও অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন তলে। সুজান মুয়দ্দি, ক্যাথরিন হল, বিটি ফ্লাইডেন থেকে আফগানিস্তানের কিশোরী মামলা পর্যন্ত নারীর অধিকার আর নির্যাতনের কতো না লড়াই আমরা জানি। কিন্তু যে অর্থে সাহিত্যে নারীবাদী শব্দটির প্রয়োগ ঠিক সে অর্থে আমি লিখি না। মানুষ হিসেবে আর আর সবাই যা পায়, করে তা-ই আমিও করি, পেতে চাই। নারীবাদ বিষয়ে আমার দু’চারটে গদ্যও আছে। সেগুলো অবশ্য বিভিন্ন পত্রিকার ফরমায়েশি লেখা। নারীবাদ শব্দটি নিয়ে আমার তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। আমি মানুষের মতোই চলি। আর যারা চলতে পারছে না, তাদের পথ বাতলে দেওয়ার বহু লোক, বহু সংগঠন আছে। প্রশ্নের শেষাংশে যে কবিতার উদ্ধৃতি দিয়েছ, তা তুমি ঠিকই ধরতে পেরেছ। আমি চট্টগ্রাম বন্দরের মেয়ে। প্রায়দিনই শহরের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে কবিবন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে যেতাম, তখনো বিয়ে হয়নি। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবার, অনেক ভাইবোন। দেরি করে ফিরলে বকা শুনতে হতো। ওরা নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত থাকতো। আড্ডার মাঝমাঝি প্রায়শই আমাকে উঠে পড়তে হতো। এই কবিতায় বেদনারই সেই ছবি তুমি পাবে।
সেই সময় ঢাকার কাপ্তান বাজার থেকে রূপান্তর নামে প্রায় ২৫/৩০ পৃষ্ঠার হাফডিমাই সাইজের একটি পত্রিকা বের হতো। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আনু মুহাম্মদ, শাহীন আকতার (তালাশ-গ্রন্থখ্যাত), শামীম আকতারসহ আরও বেশক’জন নারীবাদী লেখক-গবেষক এই পত্রিকাটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই সময় শিল্পীদম্পতি ঢালী আল মামুন আর দিলারা বেগম জলি আমাকে বেশক’টি সংখ্যা পত্রিকা দিয়ে ঢাকায় ওঁদের সাথে দেখা করতে বললেন, লেখাও নিলেন। ঢাকায় শামীম আপার বাসায় (তাঁর নির্মিত বিখ্যাত ছবি, ইতিহাস কন্যাগণ) বাসায় গিয়ে সেসময় নারীবাদ বিষয়ে কিছু কাজও করেছি, লেখাও ছাপিয়েছি কয়েকটি। সেই সময় অনার্স দ্বিতীয় কি তৃতীয় বর্ষে পড়ছি, হঠাৎ আমার এক বন্ধু বম্বে থেকে নিয়ে এলো বেশক’টি পত্রিকা। একটি কবিতায় চোখ আটকে গেলো, যৌনতা নিয়ে এমন সাহসী উচ্চারণ! তখনো তসলিমা নাসরিন, ততটা আলোচিত নন। পত্রিকার নাম, ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অফ ইন্ডিয়া। তিন চারটি সংখ্যা। কবির নাম কমলা সুরাইয়া (দাশ)। আমি চমকে উঠলাম। এত অকপট প্রকাশ! ১৯৮৮ সালের দিকে কমলা সুরাইয়ার মাইস্টোরি বের হয় তার প্রকাশনা সংস্থা স্টার্লিং পাবলিশার্স প্রা. লি. থেকে। বইটি তখন অসম্ভব জনপ্রিয়তা পায়। মুহূর্তেই নিঃশেষ হয়ে যায়। বইটির ফটোকপি পর্যন্ত সংগ্রহ করেছিলাম আমি। খোদ খুশবন্ত সিং পর্যন্ত প্রশংসা করে পত্রিকায় বিরাট রিভিউ ছেপেছিলেন। নিন্দুকেরা এটিকে নষ্ট বই আখ্যা দিয়ে হৈচৈ বাঁধিয়ে দিয়েছিল। এরপরে অ্যান সেক্সটন, সিমন দ্য বোভেয়ারসহ আরও আরও নারীবাদীদের লেখায় আমি মগ্ন হলাম। কিন্তু নারীবাদীদের মতো প্রকটভাবে চিন্তাকে আমার লেখায় আনতে পারিনি। যা খুব স্বতঃস্ফুর্তভাবে আসে তা-ই আমি লিখতে চাই। সেটিই আমার ধাঁচ। প্রবণতা। তার মানে এই নয় যে, নারীর বঞ্চনা-অধিকার-স্বপ্ন-শঙ্কা, যৌনতা বা আর আর বিষয়ে আমি সচেতন নই। বিশ্ববীক্ষায় আর্থসামাজিক এবং ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে নারী এবং পুরুষ চরিত্রের গূঢ় অতলে ডুব দিতে না জানলে তো ভালো লেখক বা কবি হওয়া সম্ভব নয়। যতদিন পর্যন্ত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ভোগবাদী থাকবে, নারীর গুণবিচারী না হয়ে রূপবিচারী হবে, ততদিন পর্যন্ত এই সমাজে বা বিশ্বে নারীর নিরাপত্তা এবং অধিকার, মর্যাদা ও মনুষ্যত্ব বিঘ্নিত হবেই।
মনজুর কাদের: আপনি তো ছোট কাগজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?
সেলিনা শেলী: দু’একটি লিটল ম্যাগাজিন করেছিলাম। উল্লেখযোগ্যও নয়। খুব কৈশোরে ডানপিঠে নামে একটি পত্রিকা করতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’একটি ছোটকাগজ করেছি। আসলে ছোটকাগজ করার মূলমন্ত্র ধৈর্য আর সাহস কোনোটিই আমার ছিল না। তবে মাস্টার্স শেষ করার পর পর আজকের দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ পত্রিকার সম্পাদক রুশো মাহমুদ, গল্পকার খোকন কায়সার, ব্যবসায়ী বাবর, প্রাক্তন কাউন্সিলর অ্যাডভোকেট রেহেনা বেগম রানু, ডা. ফাতেমা সুইটিসহ আরও দু’একজন মিলে পাক্ষিক ও মাসিক দুটো পত্রিকা বের করি- পথ থেকে পথে এবং হ্যাট্রিক। হ্যাট্রিক পত্রিকার প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন শায়েস্তা খান স্যার। পত্রিকা ভালোই ছিল। কিন্তু এদিয়ে তো আর পেট চলে না। ক’দিন পর চাকরি নিয়ে যে যার পথে। কেবল রুশো ভাই দীর্ঘ বিরতির পর আবারও ‘পথ থেকে পথে’, ‘সুপ্রভাত বাংলাদেশ’ এ।
রফিকুল বাহার (বর্তমানে সুপ্রভাত বাংলাদেশ এর বার্তা সম্পাদক) এর মাথা থেকে দারুণ দারুণ সব কাজের পরিকল্পনা বের হতো। আমরা কাজে লেগে যেতাম। আমরা মানে আমি (বয়োজ্যেষ্ঠ), খোকন কায়সার, ফাতেমা সুইটি আর দেবাংশু হোর (কনিষ্ঠ)। একটি কথা বলতেই হয়, বাহারই বাংলা ভাষায় প্রথম কবিতার কার্ড বের করে, তসলিমা নাসরিনর ওপর। এর আগে এভাবে কবিতার কার্ড কেউ করেনি। প্রিয় প্রণয়ের রঙ আমি, খোকন, বাহার আর দেবাংশু মিলে করেছিলাম।
মনজুর কাদের : ছোটকাগজ নিয়ে আপনার মন্তব্য কী? ছোটকাগজ লেখক জন্ম দেয়; এর যৌক্তিকতা কতখানি?
সেলিনা শেলী : ছোট কাগজ, লিটলম্যাগ, যে নামেই ডাকি না কেন এটি নতুনের পরিচর্যা করে। এটি একটি মহৎ ঘটনা যেহেতু লিটল ম্যাগাজিন করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তাই এখানকার প্রাপ্তিটি খুবই আনন্দের। লিটল ম্যাগাজিন এবঙ তারুণ্য প্রতিশব্দ হতে পারে। প্রতিটি লিটল ম্যাগাজিনেরই একটি নিজস্ব স্বর, সুর, রুচি এবং চেতনা থাকে। তাদের নিজস্ব একটি দল ও সহমত থাকে। খুব অল্প ছোটকাগজই দীর্ঘদিন ধরে তার ধারা অব্যাহত রাখতে পেরেছে। অবশ্য তার একশ একটি কারণও রয়েছে। তবে স্বাধীন চিন্তা, প্রান্তিক প্রকাশের জন্যে, কাছের ও দূরের নতুন সুর ও স্বরকে জানবার জন্যে এর চেয়ে বড় প্লাটফরম আর হয় না। অনুষ্টুপ বা কৃত্তিবাস এর মতো ছোটকাগজ কতো কতো নতুন কবিকে পরিচর্যা করে বাংলা সাহিত্যকে উর্বর করেছে, যারা আজ সকলের নমস্য। এরকম বহু লিটলম্যাগের উদাহরণ টানা যায়; যেখানে কবির প্রথম প্রকাশ। তোমার জহুরি চোখও কী সেই কবিকে চেনার চেষ্টা করছে না?
দেশভাগের পর ১৯৪৭ সালে এই চট্টগ্রামেই সম্ভবত সবচেয়ে উজ্জ্বল লিটল ম্যাগাজিনটি প্রকাশিত হয়েছিল, যার নাম ছিল সীমান্ত। সম্পাদক ছিলেন এক তারুণ্যদীপ্ত কবি—মাহবুবুল আলম চৌধুরী।তাঁর সঙ্গে সুচরিত চৌধুরীসহ আরও দুই-একজন ছিলেন। লিটল ম্যাগাজিন তো রাগী তরুণদের কাজ। এটি সমাজের দুষ্টক্ষত সারাবার সাংস্কৃতিক চেতনা।কাজটি নিঃসন্দেহে কঠিন।তোমাদের আমার অনেকটা আছরে নাওয়া বলে মনে হয়। এইযে, তুমি মিউস করেছ, এখন কঙ্কাল করছো—কী অক্লান্ত তোমাদের এই সম্পাদনা!সারাদেশে উল্লেখযোগ্য ভালো মানের ছোটকাগজ বের হচ্ছে।প্রত্যেক সম্পাদকের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব,বোধ আর কমিটমেন্ট রয়েছে। লিটল ম্যাগাজিনের প্রাপ্তি নগদে না থাকলেও ব্যাপ্তি আছে কালকালান্তরে। আমি ছোটকাগজের জাতক।আজও পছন্দ করি,হাত খুলে লিখতে পারি।
মনজুর কাদের:ঠিকই বলেছেন,প্রতিটি লিটল ম্যাগাজিনেরই একটি নিজস্ব স্বর, সুর, রুচি ও চেতনা থাকে। তাদের নিজস্ব একটি দল ও সহমত থাকে। কিন্তু আমি মনে করি দলীয়তা বা গোষ্ঠীবদ্ধতা পরিহার করা উচিত।
সেলিনা শেলী: যেকোনো কাজে দল থাকা ভালো—তবে দলবাজি ভালো নয়। যেসব লিটল ম্যাগাজিন এই দলবাজির ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি—চিন্তার দৌড়ে তারা বৃত্তাবদ্ধই থেকে গেছে। লিটল ম্যাগাজিনের মুখ্য উদ্দেশ্যটি যদি নতুন চিন্তা চেতনা, আঙ্গিক ও প্রকরণের নবায়ন না হয়ে, এগিয়ে থাকা শিল্পের ভাঁড়ার না হয়ে কেবল অন্যের পেছনে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি হয়—নিজের তোষামোদি হয়—তাহলে দিনের চিন্তা দিনেই অস্ত যাবে। লিটল ম্যাগাজিনকে গোষ্ঠীবদ্ধভাবে কাজ করতে হয় সত্য—কিন্তু অন্যান্য ম্যাগাজিনের আদর্শিক জায়গাটি যদি সাংঘর্ষিক না হয়—তাহলে বৃত্ত ভেঙে নিজেকে আরও বৃহৎ পরিসরে স্থাপন করা উচিত।পারস্পরিক লেনদেন, মত-দ্বিমত-সহমত নিয়েই এগুবে সাহিত্য।নিজেকে ছোট করে, গোষ্ঠীবদ্ধ করে রাখলে—নিজের যেমন কোনো উপকার হয় না—সাহিত্যেরও না। এক্ষেত্রে সম্পাদককে কমিটেড থাকতে হয়।
মনজুর কাদের:সম্পাদককে কমিটেড থাকতে হয়।অর্থাৎ সম্পাদক হতে হবে এমন কোনো দায়বদ্ধতা নেই—কিন্তু সম্পাদক হলেই দায়বদ্ধতা রয়েছে বা কমিটেড হতেই হয়।
সেলিনা শেলী: আসলে ছোটকাগজ সম্পাদককে সমাজের কাছে কমিটেড হতেই হয়। ছোটকাগজের একটি আন্দোলন বা মৌলনীতি রয়েছে। এটির সম্পাদক আর দশটি বারোয়ারি সাহিত্য সংখ্যার সম্পাদক নন।আবার লিটলম্যাগ বা ছোটকাগজ বলতে আমরা কিছু গল্প কবিতা বা প্রবন্ধের সংকলনও বুঝি না। এ কাজটি তো সকলেই পারেন। ছোটকাগজের সম্পাদক হবেন—ত্রিকালজ্ঞ, বহুদর্শী ও সাহিত্যের ভূত-ভবিষ্যৎসহ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেশ ও জনগণের অগ্রসর কল্যাণময় চেতনাকে ধারণকারী একজন শিল্পসাহিত্যযোদ্ধা—যিনি মানুষ দেশ ও জাতীয় চেতনার কাছে সবসময়ই অঙ্গীকারবদ্ধ থাকবেন। আর আমরা যারা নিজেদের কমিটেড লেখক বলে মনে করি, তারাও তোমাদের মতো সম্পাদকদের পত্রিকায় লিখে স্বস্তি পাই।
মনজুর কাদের: আপনাদের সময় ছোটকাগজ লেখক তৈরিতে কতটা ভূমিকা রেখেছে মনে করেন?
সেলিনা শেলী: আমার মতে ৮০র দশকটি শিল্পসাহিত্য নাট্য এবং রাজনীতির একটি স্বর্ণ সময় ছিল। সে সময় লিরিক (এজাজ ইউসুফী), অব্যয় (সুমন রহমান), হৃদপিণ্ড (আহমেদ রায়হান), সমস্বর (খোকন কায়সার), পদাতিক (শাহিদ আনোয়ারসহ অনেকে), অচিরা (মোহাম্মদ রফিক, আবুল মোমেনসহ অনেকে), চারুকৃত, দ্রোপদী (ওমর কায়সার), স্পার্ক জেনারেশন (স্বপন দত্ত), পালকী (কেশব জিপসী)— এভাবে অনেক লিটলম্যাগ বেরিয়েছে।
৮০র দশকের কবিদের মধ্যে বয়োকনিষ্ঠ ছিলাম আমি। পারিবারিক নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে বহু অনুষ্ঠান করেছি। আমার ‘সেদিন কী দিন ছিল, এদিন কী দিন’ প্রবন্ধে সেসব কথা লিপিবদ্ধ রয়েছে। আজও সেই মূল্যবান স্মৃতিগুলোই আমাকে প্রাণিত করে। নোভেলটি, তালসুপারিতলা (লালদীঘি), চট্টগ্রাম মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ ভবন চত্বর, মেডিকেল কলেজ, সবুজ হোটেল—আমাদের কবিতা আড্ডার কী তুমুল সাক্ষী হয়ে আছে আজও! ছোট কাগজ সবসময়ই লেখক তৈরি করেছে করবে।ছোট কাগজের আবেদন কখনো ফুরোবে বলে আমার মনে হয় না।
মনজুর কাদের: এই সময়ের তরুণদের লেখা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কেমন?
সেলিনা শেলী: এসময়ে আবির্ভুত কবিদের আরও পথ অতিক্রমণের পরই তাদের পদরেখা গভীর হয়ে দেখা দেবে। তবু বেশক’জন কবিকে নতুন স্বরে কথা বলতে দেখি আমরা। কবিতার বুনন, ভাষা, তার দৃশ্যকল্প, তার ভেতর বাহির— সবকিছুকে আলাদা করার একটা প্রয়াস দেখা গেছে গত শতকের শেষের দিকেই। তবে এ সময়ে এসে সেটি যেন আরও তীব্রভাবে আলাদা হয়ে উঠছে।কোনো কোনো কবিতা পড়ে মনে হয়—আহা,আমি যদি লিখতে পারতাম। এসময়— প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কবিতাও বেশ লক্ষণীয়ভাবে পাচ্ছি আমরা। ফলে এসময়ে বহুরৈখিক স্থান কাল পাত্রে কবিতার প্রাচুর্য, ভাষা, উপমা, মিথ আর জীবনযাপনের বৈচিত্রে ঋদ্ধ হয়েছে। তবে এসময়ের কবিতায় আশ্চর্যজনকভাকে কমে গেছে— রাজনৈতিক চিন্তাপ্রসূন, জাতীয় সংকট। তবু স্বীকার না করে উপায় নেই— এই স্বরটি পুরনো ও নতুনের মিশেলে অন্যভাবে কথা বলতে চাইছে।
মনজুর কাদের: কবিতা লেখার পাশাপাশি গল্পও লিখেছেন।
সেলিনা শেলী: আমার একটিমাত্র গল্পগ্রন্থ বেরিয়েছে ‘হনন’। আরও কয়েকটি গল্প ইতোমধ্যে লেখা হয়েছে। গল্পগুলো হঠাৎই লেখা। বইও নিতান্ত অনিচ্ছায় শৈলী প্রকাশনীর রাশেদ রউফের তাগাদায় ২০০০ সালে প্রকাশিত হয়। মজার ব্যাপার হলো বইটির সবগুলো কপি বিক্রি হয়ে যায়। আমার কাছে বা রাশেদ ভাইয়ের কাছেও কোনো কপি নেই। সম্প্রতি একটি কপি খুব কষ্ট করে আমি সংগ্রহ করেছি।
একটি উপন্যাসের খসড়া প্রায় ৩ বছর ধরে চলেছে আমার মাথার ভেতর। বেশকিছু তথ্য জানতে হবে। প্রস্তুতি আর দীর্ঘ সময় বের করাও মুশকিল হয়ে পড়েছে। তবে হবে। হতেই হবে। হয়তো ওই একটি উপন্যাসই আমি এই জীবনে লিখবো। তবে গদ্যে আমি কবিতার মতোই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। আমি বিশ্বাস করি আমার গদ্যের নিজস্ব একটি ভঙ্গি আছে। ‘কবিতার ব্যঞ্জন ও ব্যঞ্জনা’তেই তার প্রমাণ মিলবে।
মনজুর কাদের: আপনি তো কবি শাহিদ আনোয়ারকেই বিয়ে করেছেন। কিভাবে বিয়ে হরো, সেই সময়ের কথা…
সেলিনা শেলী: কোনো সন্দেহ আছে? (হা-হা-হা) আশির দশকের সবচে খ্যাতিমান কবিদের একজন ছিল শাহিদ। সরকারি মুসলিম হাই স্কুল এবং চট্টগ্রাম কলেজ থেকে সেই সময়ে সম্মিলিত মেধা তালিকায় তৃতীয় আর সপ্তম স্থান অধিকার করে সবার তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। আমার সঙ্গে যখন কবিতাসূত্রে পরিচয়, তখন সে অনার্স পড়ছে। ছাত্রইউনিয়নের তুখোড় কর্মী এবং জনপ্রিয় কবি। ওর বহু কবিতা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা তাদের আড্ডার বিষয় করে নিয়েছে। কিন্তু আমার সঙ্গে ওর সম্পর্কটা রাজনীতি আর কবিতার গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। আমরা একসঙ্গে মিছিল করেছি, কবিতা পাঠও করেছি। আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পর্যায়ে—তখন শাহিদ আমেরিকা চলে যায়। তার আগে সে দৈনিক পূর্বকোণ আর সংবাদ পত্রিকায় চাকরি করত। কোনো একটি কলেজেও পড়াতো।যাবার আগেই সে আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়।আমার তখন বিয়ের কোনো ইচ্ছে ছিল না। বিসিএস দিতেও বলে গেল। এরই মধ্যে ২/৩ বছর কেটে যায়। আমি কলেজে ঢুকলাম। শাহিদও আমেরিকার জীবনযাত্রায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে ফিরে এলো। আবার বাসায় প্রস্তাব দিলো ঘটক ছিল কবি ওমর কায়সার। মহা ধুমধামে বিয়ে হয়ে গেলো।
মনজুর কাদের: কবি শাহিদ আনোয়ার এবং স্বামী শাহিদ আনোয়ারকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?
সেলিনা শেলী: আমি তো আপাদমস্তক একজন কবিকেই বিয়ে করেছি। কাজেই স্বামী বলতে যেসব খবরদারি আমাদের মগজে চলে আসে—সেরকম কিছুই আমাদের মধ্যে নেই। শাহিদ আর আমি— আমরা পরস্পরের খুব খুব ভালো বন্ধু— এটাই শুধু বলতে পারি।আমার অতীতের এমন কিছু নেই যা সে জানে না, যেমন আমিও তার। রাজনৈতিক এবং কাব্যজগতে বিয়ের আগে থেকেই আমাদের বন্ধুত্বের গণ্ডির ভেতর যারা ছিল—এখনো তারা আছে। আমার কোনো কাজে তার কোনো হস্তক্ষেপ নেই। বরং আমি আটকে থাকি সন্তানদের দায়িত্ব-সীমানায়,স্বামী ও কবি—দুই হিসেবেই শাহিদ আনোয়ার—একেবারেই উদাসীন। তবে মানুষ হিসেবে শাহিদ সত্যিই অনেক বড় মাপের। আমরাই আমাদের কবিতার প্রথম পাঠক এবং সমালোচক। আমার দু’ছেলেও লেখে। পড়েও প্রচুর। কবিতার একটা সংসার বলতে পারো।