প্রথম পর্ব:
আধুনিক কবিতার প্রবাদপুরুষ টিএস এলিয়ট। পুরো নাম টমাস স্টিয়ার্নস এলিয়ট। জন্ম ১৮৮৮ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর, আমেরিকার মিসৌরির সেইন্ট লুইসে। ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত এলাকার স্মিথ একাডেমি, পরে বস্টনের বাইরে মিল্টন একাডেমি এবং শেষ পর্যন্ত হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেন। কবিতা লেখা শুরু চৌদ্দ বছর বয়সে, ফিটজেরাল্ডের অনুবাদ রুবাইয়াত অফ ওমর খৈয়াম দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে। তাঁর প্রথম প্রদর্শিত কবিতা প্রকাশিত হয়, প্রথমে স্মিথ একাডেমি রেকর্ড, এবং পরে দ্য হার্ভার্ড অ্যাডভোকেট-এ। ১৯০৯-১০ কালপর্বে তিনি কবি হিসেবে নিজস্ব কণ্ঠস্বর আবিষ্কার ও প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হন। ১৯১০ থেকে ১৯১১ সালের মধ্যে তিনি তাঁর প্রাথমিক দিককার বিখ্যাত কবিতাগুলো, যেমন ‘দ্য লাভ সংস অফ জে. আলফ্রেড প্রুফ্রক’, ‘পোর্ট্রেট অফ এ লেডি’, ‘প্রিলিউড্স’ এবং ‘র্যাপ্সডি অন এ উইন্ডি নাইট’ লিখে ফেলেন।
১৯১৪ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে তৎকালীন কাব্যজগতের পুরোধা এজরা পাউন্ডের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ তৈরি হয়। এজরা পাউন্ড প্রথমে পাত্তা না দিলেও পরে তাঁর কবিপ্রতিভার প্রতি আস্থা স্থাপন করেন এবং বিখ্যাত ‘পোয়েট্রি’ পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশের ব্যবস্থা করে দেন। বলা বাহুল্য, এই দুজন মিলে পরে অ্যাংলো-অ্যামেরিকান তথা পুরো বিশ্বের কবিতা-প্রকল্পনার আঙিক, বিষয় এবং বোধকে আমূল পালটে ফেলেন।
তাঁর প্রথম বই প্রুফ্রক অ্যান্ড আদার অবজার্ভেশন্স প্রকাশিত হয় ১৯১৭ সালে, কবি এজরা পাউন্ড ও তাঁর স্ত্রী ডরোথি পাউন্ডের আর্থিক সহায়তায়। ১৯২০ সালে তাঁর ক্ষীণকায়া দ্বিতীয় কবিতাগ্রন্থ পোয়েমস এবং প্রথম সমালোচনাগ্রন্থ দ্য স্যাক্রেড উড্স প্রকাশিত হয়।
১৯২২ সালে তিনি একটি সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনার প্রস্তাব পান। উচ্চমান সম্পন্ন এই পত্রিকা ক্রাইটেরিয়ন-এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ওই বছরের অক্টোবরে। এই পত্রিকা তাঁকে যেমন ইংরেজি সাহিত্যের মহারথী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের সুযোগ করে দেয় তেমনি তিনি এটির মাধ্যমে ইউরোপীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে আধুনিকতার পথে চালিত করতে সক্ষম হন। ১৯২৫ সালে বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা ফেবার অ্যান্ড গয়ার (পরবর্তী কালের ফেবার অ্যান্ড ফেবার)-এ যোগদান করেন। একই সময়ে তিনি ধর্মের দিকেও ঝুঁকে পড়েন। যোগ দেন অ্যাংলিক্যান চার্চে। তাঁর এই ধর্মবিশ্বাসের প্রতিফলন পাওয়া যাবে দি হলো মেন-এ, যেটাকে ওয়েস্টল্যান্ড-এর ধারাবাহিকতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯২৭ সালের জুনে তিনি চার্চ অফ ইংল্যান্ডের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। একই বছর নভেম্বরে তিনি বৃটিশ নাগরিকত্ব পান। এসব নিয়ে তখন চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯২৮ সালে আবার তিনি আলোড়ন তোলেন রক্ষণশীল রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এতে তিনি নিজেকে ‘সাহিত্যে ধ্রুপদীবাদী, রাজনীতিতে রাজতন্ত্রী এবং ধর্মে অ্যাংলো-ক্যাথলিক’ বলে ঘোষণা দেন। এরপর থেকে তাঁর কবিতার আরব্ধ হয়ে ওঠে ধর্ম এবং অধ্যাত্ম্যচিন্তা। এ ধরনের কবিতার উদাহরণ ‘এ জার্নি অফ দ্য ম্যাজাই’ (১৯২৭), ‘এ সং ফর সাইমিওন’ (১৯২৮), ‘অ্যানিমিউলা’ (১৯২৯), ‘মেরিনা’ (১৯৩০) এবং ‘ট্রায়াম্ফাল মার্চ’ (১৯৩১)। এই ধারার কাব্য অ্যাশ-ওয়েন্সডে (১৯৩০) ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
এলিয়ট তাঁর লেখক জীবনের শেষার্ধে নাটক লেখায় মনোনিবেশ করেন। এরকম একটি নাটক দি রক (১৯৩৪)। ১৯৩৫ সালে লেখেন মার্ডার ইন দ্য ক্যাথেড্রাল। বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশক জুড়ে এলিয়ট যে নাট্যচর্চা করেন তাতে সামাজিক আচরণের সঙ্গে আধ্যাত্মিক সংকটকে তুলে ধরেন। ১৯৩৯ সালে দ্য ফ্যামিলি রিইউনিয়ন মঞ্চস্থ হলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়। ১৯৪৯ সালে লেখেন জনপ্রিয় নাটক দ্য ককটেল পার্টি। একই জনপ্রিয়তার ধারায় এরপর আসে দ্য কনফিডেনশিয়াল কার্ক (১৯৫৩) এবং দ্য এলডার স্টেটসম্যান (১৯৫৮)।
এলিয়টের কবিখ্যাতি এবং পা-িত্যের সুনাম ১৯২০ সাল থেকে শুরু, এবং তা ক্রমেই বাড়তে থাকে। ১৯২৬ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি তাঁকে সম্মানজনক কার্ক লেকচার দিতে ডাকে। ১৯৩২-৩৩ সালে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে নর্টন লেকচার দেন। ১৯৪৮ সালে পান নোবেল পুরস্কার। ১৯৫০ সাল নাগাদ ইংরেজি সাহিত্যে তাঁর মান-অবস্থান স্যামুয়েল জনসন কিংবা কোলরিজের মতো ব্যক্তিত্বদের কাতারে উঠে যায়। ১৯৩২ সালে তাঁর বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে। ১৯৪৭ সালে তিনি তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘বার্ন্ট নর্টন’ রচনা করেন। সেটা কাব্যগ্রন্থ কালেক্টেড পোয়েমস ১৯০৯-১৯৩৫ (১৯৩৬)-এর শেষ কবিতা হিসেবে সংকলিত হয়। এই কবিতাটি এলিয়টকে পরবর্তী এক দশক পর্যন্ত প্রধান কবির আধিপত্য দান করে।
১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হলে ‘ক্রাইটেরিয়ন’-এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় তিনি কিছু কাল এয়ার-রেইড ওয়ার্ডেন হিসেবে কাজ করেন। তারপর চলে যান গ্রামে এক বন্ধুর আতিথেয়তায়। সেখানে বসে লেখেন তিনটি কবিতা—‘ইস্ট কোকার’, ‘দ্য ড্রাই স্যালভেজেস’, এবং ‘লিটল গিডিং’। ‘বার্ন্ট নর্টন’ এবং এই তিনটি কবিতার সমন্বয়ে তিনি গ্রন্থনা করেন ফোর কোয়ার্টেট্স (১৯৪৩)। এর আগে কবিতাগুলো আলাদা আলাদা ভাবে প্রকাশিত হয়। এলিয়ট ফোর কোয়ার্টেট্সকে তাঁর মাস্টারপিস গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। এই কাব্যে কালের চারিত্র্য এবং মানবীয় পরিস্থিতির সঙ্গে এর সম্পর্ককে যাচাই করে দেখা হয়েছে আধ্যাত্মিক, ঐতিহাসিক এবং পার্থিব প্রেক্ষিতে। এতে দান্তের মতো ব্যক্তিত্বদের আধ্যাত্মিকতা, শিল্প, প্রতীকবাদ ও ভাষা এবং সেইন্ট জন অফ দ্য ক্রস ও জুলিয়ান অফ নরভিক-এর মতো ব্যক্তিত্বদের আধ্যাত্মিকতার মিশ্রণ ঘটানো হয়েছে। এই গ্রন্থটি সে সময় ওয়েস্টল্যান্ড-এর সাফল্যকেও ছাড়িয়ে যায়।
এরপর এলিয়ট তেমন বড় ধরনের কবিতার কাজ করেননি। বরং নাটক এবং সাহিত্যসমালোচনা নিয়ে মগ্ন থেকেছেন। ১৯৫৭ সালের জানুয়ারিতে তিনি ভ্যালেরি ফেচারের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের দাম্পত্য জীবন সুখের হয়েছিল এবং ১৯৬৫ সালের ৪ জানুয়ারি এলিয়টের মৃত্যু পর্যন্ত এ বিয়ে টিকে ছিল। মৃত্যুর পর এলিয়টকে তাঁর ইচ্ছানুযায়ী ইস্ট কোকার-এর সেইন্ট মাইকেল চার্চে সমাহিত করা হয়। তাঁর সমাধিতে তাঁর স্বনির্বাচিত এই বাণী (ফোর কোয়ার্টেটস থেকে নেওয়া) খোদিত করা হয়—‘আমার সূচনাতেই নিহিত আমার শেষ, আমার সমাপ্তিতেই নিহিত আমার শুরু।’
কবি হিসেবে তাঁর আগ্রহ ও ঐতিহ্যিক যোগসূত্র ছিল সপ্তদশ শতাব্দীর ইংলিশ দার্শনিক কবিদের (বিশেষভাবে জন ডান) এবং উনবিংশ শতাব্দীর ফরাসি প্রতীকবাদী কবিদের (বিশেষত বোদলেয়র এবং লাফর্জ) প্রতি। কিন্তু তিনি কবিতার প্রকরণ এবং বিষয়বস্তু নিয়ে সব সময় নতুন-নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। তিনি ভিক্টোরীয় যুগের সাহিত্যিক ও সামাজিক মূল্যবোধ এবং নিয়ম-প্রথা নিয়ে প্রথম মহাযুদ্ধ-পরবর্তী তরুণ প্রজন্মের মোহমুক্তির বিষয়টিকে বিভিন্নভাবে চিত্রিত করেছেন। একইসঙ্গে, ধর্মীয় নীতি-নৈতিকতার মধ্যে আধ্যাত্মিক ও বৈষয়িক শান্তি ও স্বস্তির সন্ধান করেছেন। সেজন্যে তাঁর শেষদিককার জীবন এবং সাহিত্যকর্মে খ্রিস্টীয় সামাজিক ও ধর্মীয় রক্ষণশীলতার প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়।
এলিয়টকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যসমালোচক হিসেবেও গণ্য করা হয়। তাঁর প্রবন্ধগুলো সাহিত্যসমালোচনাতত্ত্বের বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। ‘নিউ ক্রিটিসিজম’ তত্ত্বকে তিনি বিশেষভাবে প্রভাবিত করেন। তিনি তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘ট্রাডিশন অ্যান্ড দ্য ইনডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট’-এ বলেছেন, শিল্পকে শূন্য থেকে বিবেচনা করলে চলবে না, একে পূর্বসূরিদের প্রেক্ষাপটে স্থাপন করে পরীক্ষা করতে হবে। তিনি বলেছেন, একজন শিল্পীকে অবশ্যই অতীতের মান দ্বারা বিচার করতে হবে। অর্থাৎ কোনো শিল্পকর্মই ঐতিহ্যবিচ্যুত হতে পারবে না।
নিউ ক্রিটিসিজম-সম্পর্কিত আরেকটি ধারণা প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর ‘হ্যামলেট অ্যান্ড হিজ প্রোব্লেমস’ প্রবন্ধে, যেখানে প্রতিবেদনের শব্দ, মানসিক অবস্থা এবং অভিজ্ঞতার মধ্যে একটা যোগসূত্র স্থাপনের কথা বলা হয়েছে। এই ধারণা একথাই সত্য বলে ধরে নেয় যে কবিতার অর্থ তার বক্তব্যের মধ্যেই নিহিত, কিন্তু বিভিন্ন পাঠকের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যার কারণে তার অবস্তুগত বিচারও করা চলে। তাছাড়া, তাঁর ‘ধ্রুপদী’ আদর্শ এবং ধর্মীয় চিন্তা, সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিককার কবিতা ও নাটকের প্রতি মনোযোগ, রোম্যান্টিক কবিদের, বিশেষত শেলীকে খারিজ করে দেওয়া, ‘ভাল কবিতা আবেগের বহিঃপ্রকাশে নয়, বরং আবেগ থেকে মুক্তির মাধ্যমে নির্মিত হয়’ এই ধারণা, এবং তাঁর সিদ্ধান্ত যে ‘কবিদের… বর্তমান কালে অবশ্যই দুর্বোধ্য হতে হবে’, এসব থেকে নিউ ক্রিটিসিজম-এর অনুসারীরা অনেক সূত্র আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন। অধ্যাত্মবাদী কবিদের প্রতি আগ্রহ পুনরুজ্জীবনেও এলিয়টের প্রবন্ধ সাহিত্য বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য গদ্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ট্রাডিশন এন্ড ইনডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট (১৯২০), দ্য স্যাক্রেড উড : এসেজ অ্যান্ড ক্রিটিসিজম অন পোয়েট্রি অ্যান্ড ক্রিটিসিজম (১৯২০), সিলেক্টেড এসেজ (১৯৩২), দি ইউজ অফ পোয়েট্রি অ্যান্ড দি ইউজ অফ ক্রিটিসিজম (১৯৩৩), দ্য থ্রি ভয়েসেস অব পোয়েট্রি (১৯৫৪), দ্য ফ্রন্টিয়ার্স অব ক্রিটিসিজম (১৯৫৬), অন পোয়েট্রি অ্যান্ড পোয়েট্স (১৯৫৭), ইত্যাদি।
মৃত্যুর পর ইউরোপ-আমেরিকায় এলিয়টের খ্যাতি ও চর্চা কিছুটা হ্রাস পায়। কিন্তু পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় তিনি আধুনিকতার প্রবাদপুরুষ হিসেবে বরিত হন। তিনি এমন একজন কবি যিনি কখনও পুনরাবৃত্তি করেননি, ঐতিহ্যানুসারী থেকেও আবিষ্কার করেছেন নতুনতর কাব্যপ্রকৌশল ও বাগভঙ্গি দিয়েছেন নতুনতর জীবনবোধ, উন্মুক্ত করেছেন কাল ও অন্তর্জীবনের ভয়াবহতাকে। বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কবি তিনি, যাঁর প্রভাব বিদ্যমান এখনও।
দ্য প্যারিস রিভিয়্যু ২১তম (বসন্ত-গ্রীষ্ম, ১৯৫৯) সংখ্যায় ‘কবিতার শিল্পরূপ’ শিরোনামে এলিয়টের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে। সেটি সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর সংক্ষিপ্ত ভূমিকাসহ সম্পূর্ণ অনূদিত হলো।
এই সাক্ষাৎকারের ঘটনাস্থল নিউইয়র্ক, এলিয়ট দম্পতির বন্ধু হাউস অফ বুকস লিমিটেড-এর মিসেস লুই হেনরি কোনের অ্যাপার্টমেন্ট। আকর্ষণীয় লিভিংরুমের বুককেসগুলোয় আধুনিক লেখকদের বইয়ের উল্লেখযোগ্য সংগ্রহ শোভা পাচ্ছে। ঢুকতেই দেয়ালে ঝুলছে মিস্টার এলিয়টের একটা ড্রয়িং, সেটা তার ভ্রাতৃবধূ মিসেস হেনরি ওয়্যার এলিয়টের আঁকা। একটা টেবিলের ওপর রৌপ্যফ্রেমে রক্ষিত এলিয়টের বিয়ের ছবি। মিসেস কোন এবং মিসেস এলিয়ট ঘরের এক প্রান্তে সোফায় বসে আছেন, আর মিস্টার এলিয়ট এবং সাক্ষাৎকার-গ্রহণকারী মধ্যস্থলে মুখোমুখি বসেছেন। টেপরেকর্ডারের মাইক্রোফোনটি তাদের মাঝখানে মেঝেতে রাখা।
মিস্টার এলিয়টকে বিশেষভাবে চমৎকার দেখাচ্ছিল। নাসউতে ছুটি কাটিয়ে লন্ডন ফেরার পথে যুক্তরাষ্ট্রে একটা সংক্ষিপ্ত ভ্রমণে রয়েছেন তিনি। তামাটে রং, এবং তার সঙ্গে সাক্ষাৎকার-গ্রাহকের শেষ সাক্ষাতের পর গত তিন বছরে বোধ হয় তার ওজন কিছুটা বেড়েছে। যাই হোক, তরুণ দেখাচ্ছিল তাকে, এবং প্রফুল্ল। সাক্ষাৎকারের সময় তিনি ঘন ঘন মিসেস এলিয়টের দিকে তাকাচ্ছিলেন, উত্তর দিতে গিয়ে যে-কথা তিনি বলছিলেন না সেটা যেন তার সঙ্গে আলাপ করে নিচ্ছিলেন।
সাক্ষাৎকার-গ্রাহক এর আগে তার সঙ্গে লন্ডনে কথা বলেছেন। ফেবার এন্ড ফেবার-এর ছোট্ট অফিসটা রাসেল স্কয়ার থেকে কয়েক ধাপ দূরে, তার দেয়ালে অনেকগুলো ছবি টাঙ্গানো: ভার্জিনিয়া উলফের একটা বিশাল ছবি, ইনসেটে দ্বাদশ পিউস-এর পোর্ট্রটে; আই. এ. রিচার্ডস, পল ভালেরি, ডব্লিউ. বি. ইয়েটস, গ্যেটে, মেরিয়েন মুর, চার্লস হুইবলে, ডিজুনা বার্নেস, এবং অন্য অনেকের।
মিস্টার এলিয়টের সঙ্গে আলাপের সময় অনেক তরুণ কবি তাদের মুখদর্শন দিয়ে গেছে। তাদের একজন একটা গল্প শুনিয়েছে যার কারণে মিস্টার এলিয়টের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত কিছু পাওয়া গেল। ঘণ্টাখানেকের গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক আলোচনার পর আর কিছু বলার আছে কিনা ভাবার জন্যে একটু থামলেন মিস্টার এলিয়ট। তরুণ আমেরিকান কবিটি অক্সফোর্ডে যাচ্ছে, চল্লিশ বছর আগে মিস্টার এলিয়ট যা করেছেন। তারপর, যেন মুক্তির উপায় বাতলাচ্ছেন এমন গম্ভীর স্বরে মিস্টার এলিয়ট তাকে একটা লম্বা উলের আন্ডারওয়্যার কেনার পরামর্শ দিলেন, কারণ অক্সফোর্ডের পাথর স্যাঁতসেঁতে। মিস্টার এলিয়ট পিতৃসুলভ মুরুব্বী হতে সক্ষম, যদিও শিষ্টাচার ও উপদেশের মধ্যকার কৌতুককর বৈষম্য সম্পর্কে তিনি পুরোপুরি সচেতন।
একই রকম সংমিশ্রণ তার অনেক মন্তব্যকে সংশোধিত করেছে যেগুলো এখানে বিবৃত হয়েছে, আর অঙ্গভঙির কূটাভাস কাগজের পৃষ্ঠায় অদৃশ্য থেকে গেছে। সাক্ষাৎকার, কখনও কখনও, সত্যি সত্যিই, কূটাভাস এবং কিছুটা কৌতুককর থেকে উল্লাসময়তার দিকে এগিয়েছে। মাঝে মাঝে হো-হো করে হেসেছেন মিস্টার এলিয়ট, বিশেষ করে এজরা পাউন্ড সম্পর্কে তার প্রথম দিককার নিন্দাবাদ, অপ্রকাশিত রচনা, এবং তার হার্ভার্ড দিনগুলোর কিং বোলো কবিতার অশুদ্ধ সংকলক প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে।
—ডোনাল্ড হল, ১৯৫৯
হল : আমার সম্ভবত শুরু থেকেই আরম্ভ করা দরকার। শৈশবে সেইন্ট লুইসে থাকার সময় আপনি কোন পরিস্থিতির চাপে কবিতা লিখতে শুরু করেন, মনে পড়ে কি?
এলিয়ট : আমি শুরু করেছিলাম, আমার মনে হয়, চৌদ্দ বছর বয়সে, ফিটজেরাল্ডের ওমর খৈয়্যাম দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে; লিখেছিলাম বেশ কিছু বিষণ্ণ, নাস্তিকতা ও নৈরাশ্যবাদী চতুষ্পদী শ্লোক, সৌভাগ্যবশত আমি সেগুলোকে সম্পূর্ণ গোপন রাখতে পেরেছিলাম—এতটাই পুরোপুরি যে সেগুলোর আর অস্তিত্বই নেই। ওগুলো আমি কখনও কাউকে দেখাইনি। প্রথম প্রদর্শিত কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল প্রথমে স্মিথ একাডেমি রেকর্ড, এবং পরে দ্য হার্ভার্ড অ্যাডভোকেট-এ; সেটা লিখেছিলাম আমার ইংলিশ শিক্ষকের অনুশীলন হিসেবে, বেন জনসনের অনুকৃতি ছিল সেটা। তিনি সেটাকে পনর-ষোল বছরের একটা বালকের জন্যে খুব ভাল হিসেবে গণ্য করেছিলেন। তারপর কিছু লিখি হার্ভার্ড-এ, দ্য হার্ভার্ড অ্যাডভোকেট-এর সম্পাদকগিরির নির্বাচনে জেতার জন্যে, সেটা আমি খুব উপভোগ করেছিলাম। তারপর জুনিয়র এবং সিনিয়র কাসের দিনগুলোয় বিস্ফোরণ ঘটার মতো অবস্থা হয়েছিল। আমি খুব বেশি লিখছিলাম, প্রথমে বোদলেয়র এবং পরে জুল লাফর্জ-এর প্রভাবে, তারা হার্ভার্ড-এ আমার জুনিয়র কাসের সময়কার আবিষ্কার।
হল : বিশেষভাবে কেউ কি আপনাকে ফরাশি কবিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল? আরভিং ব্যাবিট নয়, আমার ধারণা।
এলিয়ট : না, ব্যাবিট সর্বশেষ ব্যক্তি হতে পারেন! প্রশংসা করার জন্যে যে-একটি কবিতাকে ব্যাবিট ওপরে তুলে ধরেন তা হলো গ্রে-র এলিজি। সেটা একটা সুন্দর কবিতা, কিন্তু আমি মনে করি সেটা ব্যাবিটের একটা সীমাবদ্ধতার পরিচায়ক, খোদা তাকে শান্তি দিন। আমার মনে হয় আমি আমার উৎসের কথা জানিয়েছি; সেটা হচ্ছে ফরাশি কবিতার ওপর লেখা আর্থার সিমন্সের বই, হার্ভার্ড ইউনিয়নে পেয়েছিলাম। সে সময় হার্ভার্ড ইউনিয়ন এমন একটা মিলনস্থল ছিল যেখানে যে কোনও আন্ডারগ্রাজুয়েট ছাত্র ইচ্ছে করলে তার সদস্য হতে পারত। সেখানে খুব সুন্দর ছোট্ট একটা লাইব্রেরি ছিল, এখন যেমন হার্ভার্ডের অনেক জায়গায় দেখা যায়। তার উদ্ধৃতিগুলো আমার পছন্দ হয়েছিল এবং আমি বস্টনের একটা বিদেশী বইয়ের দোকানে (আমি তার নাম ভুলে গেছি এবং জানি না সেটা আজও টিকে আছে কিনা) গিয়েছিলাম; সেটা বিশেষভাবে ফরাশি, জার্মানি এবং অন্য সব ভাষার বইয়ের জন্যে বিখ্যাত ছিল, সেখানে লাফর্জ এবং অনান্য কবির বই পেলাম। আমি ভেবে পাই না সেই দোকানে লাফর্জের মতো গুটিকয়েক কবির বই কেন পড়ে ছিল। খোদাই জানেন কতদিন ধরে সেগুলো ওখানে জমে ছিল বা তাদের আর কোনও চাহিদা ছিল কিনা।
হল : আপনি যখন আন্ডারগ্রাজুয়েট ছাত্র, তখন আপনি কি কোনো প্রবীণ কবির প্রভাব অনুভব করতেন? আজকালকার তরুণ কবিরা এলিয়ট, পাউন্ড এবং স্টিভেন্স যুগের কবিতা লিখছে। আপনি কি সাহিত্যিক কাল সম্পর্কে আপনার নিজস্ব ধারণার কথা স্মরণ করতে পারেন? আপনার অবস্থা একেবারে ভিন্ন ছিল কি না, আমার জানতে ইচ্ছে হয়।
এলিয়ট : আমি মনে করি ইংল্যান্ড বা আমেরিকায় এমন কোনও জীবিত কবি না থাকা বরং সুবিধার যার প্রতি কাউকে বিশেষ আগ্রহ দেখাতে হয়। আমি জানি না এ রকম হলে কী হতো, কিন্তু আমি মনে করি এ রকম প্রভাবশীলদের উপস্থিতি বরং কষ্টকর চিত্তবিক্ষেপের কারণ হতো। সৌভাগ্যক্রমে আমরা কেউ কারো জন্যে উদ্বেগের কারণ ছিলাম না।
হল : হার্ডি বা রবিনসনের মতো লোকদের ব্যাপারে আপনি কি আদৌ সতর্ক ছিলেন?
এলিয়ট : আমি রবিনসন সম্পর্কে কিছুটা জেনেছিলাম, কারণ আমি দ্য আটলান্টিক মান্থ্লিতে তার সম্পর্কে একটা প্রবন্ধ পড়েছিলাম যেখানে তার কবিতার কিছু উদ্ধৃতি ছিল; কিন্তু সেগুলো আদৌ আমার কাপের চা ছিল না। হার্ডি সে সময় কবি হিসেবে তেমন পরিচিত ছিলেন না। লোকে তার উপন্যাস পড়ত, তার কবিতা প্রকৃতপক্ষে দৃষ্টি আকর্ষণ করে পরবর্তী প্রজন্মের সময়। তখন ইয়েটস ছিলেন, কিন্তু সেটা তার প্রাথমিক কাল। আমার কাছে তাকে খুব বেশি কেল্টিক চরিত্রের বলে মনে হতো। প্রকৃতপক্ষে আর কেউ ছিল না নব্বইয়ের লোকগুলো ছাড়া, যারা মদ্যপান অথবা আত্মহত্যা বা এটা-সেটা করে মারা যান।
হল : আপনি এবং কনরাড আইকেন যখন অ্যাডভোকেট-এর যৌথ সম্পাদক তখন আপনারা কি কবিতা লিখতে পরস্পরকে সাহায্য করেছেন?
এলিয়ট : আমরা বন্ধু ছিলাম কিন্তু আমার মনে হয় না যে আমরা কেউ কাউকে প্রভাবিত করেছি। বিদেশী লেখকদের প্রসঙ্গ যখন এল তখন দেখা গেল সে ইতালীয় এবং স্পেনীয়দের প্রতি আগ্রহী, আর আমার সমস্ত উৎসাহ ফরাশিদের ঘিরে।
হল : আপনার আর কোনও বন্ধু ছিল কি যারা আপনার কবিতা পড়ত এবং আপনাকে পরামর্শ দিতো?
এলিয়ট : হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমার ভায়ের এক বন্ধু ছিল, তার নাম টমাস এইচ. টমাস, কেমব্রিজে বাস করত; সে দ্য হার্ভার্ড অ্যাডভোকেট-এ আমার কিছু কবিতা দেখেছিল। সে আমাকে একটা খুব উৎসাহব্যাঞ্জক চিঠি লিখেছিল এবং আমাকে আনন্দিত করেছিল। আমার এখনও তার চিঠি পেতে ইচ্ছে করে। আমাকে ওই উৎসাহ দেওয়ার জন্যে আমি তার কাছে খুবই কৃতজ্ঞ।
চলবে…