বিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী পাবলো পিকাসোর দীর্ঘায়ু, নিরন্তর শিল্পভ্রমণ ব্যস্ততা এবং বৈচিত্র্য নিয়ে যত কথা আলোচনায় আসে, তার জীবনে প্রেম এবং নারীও ততটা আলোচিত, সমালোচিত, তর্কিত ও বিতর্কিত বিষয়। নারীসঙ্গ নিয়ে সমালোচনা করাটা অনেকটা ঈর্ষারও বিষয়। তবে পিকাসোর জীবনের শিল্প এবং নারী জীবন থেকে ভিন্ন কিছু না। এত নারীরর আগমন না ঘটলে তার জীবনে শিল্পবৈচিত্র্য সৃষ্টি করা সম্ভব ছিল না।
পাবলো পিকাসোর বাবার নাম হোসে রুইজ ব্লাসকো। মায়ের নাম মারিয়া পিকাসো লোপেজ। মায়ের নামের অংশ থেকেই পিকাসোর বিশ্বজুড়ে পরিচিত নামটির উৎপত্তি। জন্ম ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দের ২৫ অক্টোবর। দক্ষিণ স্পেনের ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী বন্দর-শহর মালাগায়। বাবা ছিলেন প্রাদেশিক চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের চিত্রাঙ্কনের শিক্ষক এবং স্থানীয় জাদুঘরের কিউরেটর। বিখ্যাত আন্দালুসিয়ার মধ্যে মালাগা ছিল চারুকলার জন্য বিখ্যাত কেন্দ্র।
পাবলো শৈশবে সরল ধরনের থাকলেও পিঠাপিঠি ছোট বোন কঞ্চিতার ডিপথিরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনায় দারুণভাবে শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এ ঘটনার পর থেকে পাবলো হাবাগোবার মতো হয়ে যান। মৃত্যু নামক বিষয়টা এ বয়স থেকে তাকে ভাবিয়ে তোলে। মৃত্যু কোনো বন্ধন মানে না। এর থেকে নিস্তারও নেই। কাজেই মৃত্যুর ধ্বংসাত্মক থাবা থেকে বাঁচতে হলে অমরত্ব লাভের উপযোগী করে কাজ করতে হবে—এ ধরনের ভাবনা তাকে সর্বদাই সজাগ রেখেছে। একমাত্র শ্রমই মানুষকে অমর করে রাখতে পারে।
তবে আন্দালুসিয়ার প্রভাব তার মনে ছিল। আন্দালুসিয়া প্রদেশটি আরবদের শাসনে ছিল সাত শতাব্দীকাল। সেখানে আরবদের নিজস্ব স্থাপত্যরীতিতে গড়ে উঠেছিল অনেক মসজিদ, প্রাসাদ, সমাধি বা মাজার, বাড়ি, সেতু, মিনারসহ অনেক স্থাপনা। আরবদের ইসলাম ধর্মে জীবন্ত প্রাণীর ছবি আঁকা নিষেধ ছিল বলে আরব শিল্পীরা বিমূর্ততা ও নকশার দিকে ধাবিত হন। আরব-পারস্যের ইসলামি শিল্পকলার একটি প্রধান রীতি ছিল জ্যামিতিক রেখার ব্যবহার। চারু ও কারুকলায়, নকশায় সে ধরনের রেখার কাজের প্রাধান্য থাকে। দরজা-জানালা-চৌকাঠসহ নানা আসবাবে, প্রাসাদের দেয়াল-মেঝে ও ছাদে, ফরাসে-গালিচায়, দরজা-জানালার পর্দায়, বিছানা-বালিশ-কম্বলে, তশতরি-রেকাবিসহ নানা তৈজসপত্রে নকশা ও ট্যাপেস্ট্রির কাজে সেই রেখা ও নিজস্ব রঙের ব্যবহার বিশিষ্ট ও বিখ্যাত হয়ে আছে। কয়েক শতকের আরবি শিল্পের প্রভাব পাবলোর পরিবারে, অঞ্চলে, ও স্থানীয় শিক্ষিত অনেকের মনে সর্বদাই ছিল। আরব শাসনের অবসানের পরে খ্রিস্টানধর্মের প্রভাব বৃদ্ধি পেলেও আরব শিল্পরীতি আন্দালুসিয়ার শিল্পে অবশিষ্ট ছিল। পাবলো তার লেখা কবিতায় স্বীকারও করেছেন।
পাবলোর বাবা নিজ হাতে ছেলেকে ছবি আঁকা শেখান। স্টুডিওতে নিয়ে কেমন করে ইজেলে ছবি টানাতে হয়, কেমন করে প্যালেটে রঙ মেশাতে হয়, কোন রঙের সঙ্গে কোন রঙ মেশালে কোন রঙ হয় তা শেখাতেন। কেমন করে প্যালেট থেকে অবশিষ্ট রঙ ধুয়ে ফেলতে হয় এসব শিখতে শিখতে স্টুডিওর পরিবেশ ভালো লেগে যায় পাবলোর। বাবাও ছেলেকে স্টুডিওতে পেয়ে আনন্দিত।
বাবা হোজে পাঁচ বছর পরেই কোরুনা থেকে বার্সিলোনার ‘লা লোঞ্জা আর্ট স্কুলে’ চারুকলার শিক্ষক হিসেবে চাকরি নিয়ে চলে যান। এ সময়ই ঘটে পিকাসোর জীবনে প্রথম মানসিক আঘাতের ঘটনা। ছোট বোন কঞ্চিতা মাত্র সাত বছর বয়সে মারা যায় ১৮৯৫ সালে। এর পরে আবার পুরো পরিবার বার্সিলোনা চলে আসে। কাতালোনিয়ার রাজধানী, ভূমধ্যসাগর তীরের ও পিরেনিজ পর্বতমালার শহর বার্সিলোনা অনেক বড় শহর। ফ্রান্সের কাছাকাছি উত্তর স্পেনের এ শহরে পাবলো মনের মতো করে ছবি আঁকার সুযোগ পেলেন। এখান থেকে ফ্রান্স যাওয়া সহজ। এখানে আন্তর্জাতিক শিল্প-সাহিত্যের ঢেউ এসে লাগে।
এ সময় তিনি ‘অয়েল অ্যান্ড চ্যারিটি’ নামে একটি ছবি আঁকলেন। ছবিটি দেখে বাবা নিজেই মাদ্রিদে জাতীয় প্রদর্শনীতে পাঠিয়ে দেন। সেখানে ছবিটি মর্যাদার আসন লাভ করে। পরে জন্মভূমি মালাগার একটি প্রদশর্নীতে ছবিটি আবার পাঠালেন বাবা। সেখানে ছবিটি স্বর্ণপদক পায়। এভাবে কিশোর পাবলো শিল্পী জীবনে সসম্ভ্রমে প্রবেশ করেন।
ছোটবেলা মা তাকে বলেছিলেন, তুমি যদি সেনাবাহিনীতে যোগ দাও তাহলে জেনারেল হবে। যদি সন্ন্যাসী হও তাহলে পোপের পদ পর্যন্ত অলঙ্কৃত করবে।’ কিন্তু পাবলো মায়ের দেখানো পথে হাঁটেননি। তবে মায়ের ধারণার মতোই বড় মাপের মানুষ হয়েছেন। হয়েছেন বিশ্বখ্যাত এই পাবলো পিকাসো। তার মা জানিয়েছেন শিশুকালে পাবলোর মুখে প্রথম উচ্চারিত শব্দ ছিল ‘পিজ’ ‘পিজ’! ‘পিজ’ আসলে ‘লাপিজ’ শব্দের শিশুতোষ সংক্ষিপ্ত উচ্চারণ। ‘লাপিজ’ অর্থ পেনসিল।
তবে বাবার কর্মস্থল ‘লা লোঞ্জা আর্ট স্কুলে’ পাবলো বেশিদিন থাকলেন না। তিনি এক বছর পরেই মাদ্রিদের ‘সান ফার্নান্দো রয়্যাল একাডেমি’তে ভর্তির আবেদন করলেন। এই নামকরা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করানোর ব্যাপারে বাবার এবং কাকার বিশেষ আগ্রহ ছিল। এখানেও পাবলো ভর্তি পরীক্ষায় চমৎকার নৈপুণ্য দেখিয়েছেন। ভর্তি হওয়ার আগেই শহরের একটি চিত্রপ্রদর্শনীতে তার একটি চিত্রকর্ম বিচারকদের মুখে প্রশংসিত হয়। এখানে থাকতেই পরের বছর জন্মশহর মালাগার চিত্রপ্রদর্শনীতে একটি চিত্রকর্ম স্বর্ণপদক লাভ করে।
প্রতিষ্ঠানের একঘেয়ে বিষয়ের পুনরাবৃত্তি থেকে মুক্তির জন্য তিনি ক্লাস ফাঁকি দিতে থাকেন। ক্লাস ফাঁকি দিলেও পাবলো কাজে ফাঁকি দেননি। প্রতিদিন পথে পথে যাকে দেখেন, ভিখারি, অন্ধ, পঙ্গু, কুলি-মজুর, বস্তিবাসী, জেলখালাস দাগি, ফেরিওলা এসব নিম্নশ্রেণীর লোকদের স্কেচ করতে থাকেন।
পড়াশোনা ছেড়ে শুধু ছবি আঁকবেন বলে প্রতিজ্ঞা করলেন। পরিবার পরিজন ছেড়ে বিশাল শহর মাদ্রিদে একাকী জীবন কাটাতে লাগলেন। কখনো এতিম বালকের মতো, কখনো বয়সে বড় বন্ধু কার্লোস কাসাজেমাসের সঙ্গে পথে পথে ঘুরে বেড়ান। জাদুঘর-গ্যালারি ঘুরে স্পেনের কালজয়ী শিল্পীদের ছবি দেখেন আর অনুকরণ করতে থাকেন। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়ানোর কথা জানতে পেরে কাকা রেগে গেলেন। প্রচ- ক্ষোভে তিনি ভাতিজার পড়াশোনার খরচ বাবদ টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিলেন। এর পরে পাবলোর জীবনে নেমে আসে দুর্দশার দিন। এত বড় শহরে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা খুবই কঠিন।
পরে অবশ্য মাদ্রিদেই পাবলোর শিল্পীজীবনের প্রশস্ত পথ খুলে যায়। কিন্তু তিনি এখানেও বেশিদিন থাকলেন না। কারণ এখানে তিনি ঘন ঘন অসুস্থ হয়ে পড়তেন। একবার ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত হলেন। দেখাশোনা করার কেউ নেই। তিনি বাড়িতেও গেলেন না। বার্সিলোনায় পরিচিত, বয়সে বড় বন্ধু কার্লোস কাসাজেমাসের সঙ্গে চলে গেলেন পাহাড়ী গ্রামের দিকে। পিরেনিজ পর্বতের গহীন গ্রাম হোর্তা দ্য এব্রোতে কিছুদিন কাটিয়ে সুস্থ হয়ে আবার বার্সিলোনায় ফিরে আসেন। এবার সেখানে বোহেমিয়ান শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের দলে স্থান করে নেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন, গঞ্জালেস ভ্রাতৃদ্বয়, ম্যানুয়েল পলারেস, তরুণ কবি জেইমি সাবার্তেস, প্রাবন্ধিক-সমালোচক ইউজেনীয় দি’ওরস, চিত্রকলার ইতিহাসবিদ মিগুয়েল উত্রিলো প্রমুখ।
শিল্পীদের কাছে ফরাসি শিল্পরীতি আকর্ষণীয় ছিল, পাবলো সরাসরি ফ্রান্সেই চলে যাওয়ার কথা ভাবলেন। তিনি বন্ধু কাসাজেমাসকে সঙ্গে নিয়ে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে প্যারিসে চলে গেলেন। সেখানে শিল্পী ইসিদ্রের লোনেলের কাছে ৪৯ নম্বর রু গাব্রিয়েল-এ থাকতে লাগলেন। এর মধ্যে একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটে যায় পাবলোর জীবনে। তার বন্ধু কাসাজেমাস এক তরুণীর গভীর প্রেমে পড়ে যায়। সে তরুণী প্রথমে কিছুদিন কাসাজেমাসের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করলেও পরে অন্য এক প্রেমিকের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে। কাসাজেমাসের সঙ্গেও প্রেমের অভিনয় করে গেল তরুণীটি। একদিন কাসাজেমাস তার প্রিয় মানুষটিকে নিমন্ত্রণ জানায়। সেই তরুণী নিমন্ত্রণে আসে; তবে সঙ্গে করে তার নতুন প্রেমিককেও নিয়ে আসে। এ আঘাত সহ্য করা সম্ভব হয়নি কাসাজেমাসের পক্ষে। সে ওই তরুণ-তরুণীর সামনেই মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করে।
এ ঘটনায় পাবলো দারুণভাবে মুষড়ে পড়েন। শৈশবে ছোট বোন কঞ্চিতার মৃত্যু দেখেছেন, কয়েক বছর পরেই আবার দেখলেন প্রিয় বন্ধুর মৃত্যু। শোকার্ত শিল্পী প্রয়াত বন্ধুর ছবি আঁকলেন। বিখ্যাত শিল্পী এল গ্রেকোর ‘বেরিয়াল অব কাউন্ট অর্গাজ’-এর মতো করে শেষকৃত্য নিয়ে একটি ছবি আঁকেন। পাবলো ছবিটিতে এল গ্রেকোর ছবির মতো পার্থিব এবং আধ্যাত্মিক দু-স্তরের আবহ দিয়ে ভরে তোলেন। এ সময় থেকে পিকাসো রাতে একা ঘুমাতে ভয় পেতেন।
কার্লোস কাসাজেমাসকে হারানোর পরে প্রায় নিঃসঙ্গ পাবলো সোলারকে বন্ধু হিসেবে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে নেন। দুজনে মিলে প্রতিষ্ঠা করলেন চিত্রকলা বিষয়ক পত্রিকা ‘আর্ত হোভেন’। প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের ৩১ মার্চ।
তার এ সময়ের আঁকা ছবিতে তুলুজ লুত্রেক এর প্রভাব ছিল স্পষ্ট। তিনি ফরাসি ইম্প্রেশনিস্টদের মতো উজ্জ্বল রঙের দ্বারা প্রভাবিত। তখনো তিনি বার্সিলোনার তরুণ বুদ্ধিজীবীদের চিন্তাধারার দৃঢ় অবস্থানে আছেন। এ ছাড়া তখন তিনি ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক ও চিন্তাবিদদের মুক্তি ও স্বাধীনতার আদর্শের অনুসারী। এ সময়ের ছবিতে তার স্বকীয়তা স্পষ্টভাবে দেখা দেয়নি।
ব্লু পিরিয়ড
১৯০১ খ্রিস্টাব্দের দিকে বার্সিলোনা আসার পরে তার চিত্রধারায় একটা পরিবর্তন দেখা গেল। আগে তিনি স্পষ্ট, উজ্জ্বল ও গাঢ় রঙ ব্যবহার করতেন। এ সময় তিনি সে সব রঙ পরিহার করে অনুজ্জ্বল নীল রঙ। এর সঙ্গে ঘন এবং প্রায় কালো রঙ তিনি ব্যবহার করতে শুরু করলেন। এটাই পাবলো পিকাসোর জীবনে ব্লু পিরিয়ড বলে পরিচিত বিশেষ ধারার শুরু।
ব্লু পিরিয়ড অবশ্য শুধু রঙ-তুলি-প্যালেট আর ক্যানভাসের বিষয় ছিল না। শিল্পীর দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ও সংযুক্ত ছিল। আগের প্যারিসের অভিজাত শ্রেণীর, সুখী মানুষদের, ক্যাবারের উজ্জ্বল আলোময়, কিংবা রঙিন উজ্জ্বল পোশাক পরা রোমান্টিক ধাঁচের ছবির জায়গা থেকে সরে এসে পাবলো আঁকা শুরু করলেন সমাজের দুঃখী মানুষদের বেদনা ও বিষণœতার ছবি। এদের ছবিগুলো আঁকতে গিয়ে বাস্তববাদী রেখার ঢঙ ভেঙে নতুন রেখাভঙ্গি তিনি বেছে নিলেন। শীর্ণ দেহাববয়ব, ঋজু কিন্তু বিহ্বলভাবে দাঁড়িয়ে থাকা, অপুষ্ট অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, কৌণিকভাবে বেড়ে ওঠা হাত-পা ইত্যাদি সব মিলিয়ে একেবারে অনাকর্ষণীয় ফিগারে বরে তুললেন। দর্শকের চোখে যেন দার্শনিকের মতো নতুন তত্ত্ব দিয়ে আঘাত করলেন। অন্ধ ভিখারি, অনাশ্রিত, ভবঘুরে নিয়তির কাছে পরাজিত মানুষদের ছবি তিনি মমতা আর সহানুভূতির দৃষ্টি দিয়ে দেখে দেখে আঁকলেন। ফিগারগুলোর চোখের দিকে তাকালে দর্শকের মনে করুণা জাগে, বুকের ভেতর হাহাকার ওঠে। ক্যানভাস থেকে রঙের কোমলতা দূর করে দিয়ে হৃদয়ের কোমলতাকে স্থান দিলেন।
এই ব্লু পিরিয়ডের ইতিহাসে আছে পাবলোর বন্ধু কার্লোস কাসাজেমাসের করুণ মৃত্যুর শোক। ১৯০১ এর ফেব্রুয়ারি মাসের ৭ তারিখে কাসামেজমাস আত্মহত্যা করেন। ঘটনার সময় পিকাসো প্যারিসে ছিলেন না। গিয়ে যখন এ ঘটনা শোনেন প্রচ- রকম মর্মাহত হন। বন্ধুকে হারিয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। তখন থেকেই তার ক্যানভাসে নীল রঙের আবির্ভাব। এ বিষয়ে পরবর্তী জীবনে পিকাসো নিজেই স্বীকার করেছেন, ‘আমি ব্লু রঙ ব্যবহার শুরু করেছিলাম যখন আমার প্রিয় বন্ধু কাসাজেমাস মারা যায়। তার মৃত্যুর শিক্ষা থেকেই এই পিরিয়ডের শুরু।’
ছবিবিক্রেতা পেদ্রো মেনাক পিকাসোর ছবি এক-দুইটা বিক্রি করলেও ঠিক মতো হিসাব বুঝিয়ে টাকা পয়সা দিতেন না। বন্ধু-হারানো শোক, আর্থিক কষ্ট আর নিঃসঙ্গতার বেদনা পিকাসোর হাতে বিষণœতার রঙ যেন স্থায়ী হয়ে রইল। একের পর এক ক্যানভাসে ঘন নীল, বেদনার, শোকের, বিষণœতার ও বিরক্তির প্রবাহ ধরে আছে। এমন নীল ছবি দেখতে দেখতে পেদ্রো মেনাকের চোখ ক্লান্ত হয়ে গেল। তিনি অনুরোধ করলেন পিকাসো যেন অন্য রঙে ছবি আঁকেন। এই রঙ তার আর সহ্য হয় না। কিন্তু পিকাসো সেই শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে ইতিহাস রচনা করেছেন।
১৯০২ খ্রিস্টাব্দে বার্সিলোনা থাকার সময় বার্থাভিল এবং ভলারের আয়োজনে প্যারিসে পিকাসোর দুটি প্রদর্শনী হয়। বছরের শেষের দিকে তিনি তৃতীয়বারের মতো প্যারিসে যান। কিন্তু পরের বছর শুরুতেই তিনি আবার বার্সিলোনা চলে আসেন। এর পরে একটানা এক বছর তিনি বার্সিলোনা থাকেন। ব্লু পিরিয়ডের উল্লেখযোগ্য অনেক ছবি তিনি এ সময় আঁকেন। তার এ সময়কার চিত্রকর্মে রেনেসাঁ যুগের স্পেনিশ শিল্পী এল গ্রেকোর প্রভাব দেখা যায়। ফিগারগুলোর দেহকাঠামোতে শীর্ণতা-দীর্ঘতা এবং পার্থিব অনুভূতির সঙ্গে অতীন্দ্রিয় ও আধ্যাত্মিকতা স্থান পায় তার ক্যানভাসে। বলতে গেলে ফরাসি চিত্রকলার প্রভাব কাটিয়ে পিকাসো এ সময় স্পেনিশ শিল্পধারায় ফিরে আসেন।
ব্লু পিরিয়ডের প্রথম দিকে আঁকেন বিখ্যাত কয়েকটি চিত্র। এর মধ্যে একটি ‘ওম্যান আয়রনিং’। ছবিটিতে দেখা যায় একজন নারী কাপড় ইস্ত্রি করতে গিয়ে সারা জীবনের ভার নিয়ে নুয়ে আছে। এ চিত্রটি দেখলেই বোঝা যায় যারা সারা জীবন ধরে শুধু শ্রম দিয়েই গেছে কিন্তু সমাজ ও সভ্যতা তাদের কিছুই দেয়নি তারাই পিকাসোর ক্যানভাসে চিত্ররূপ লাভ করেছে। ব্লু পিরিয়ডের বেশির ভাগ ছবি প্যারিসে বসে আঁকা। এসব ছবি মূলত স্পেনিশ চিত্রকলার ধারায় এঁকেছেন পিকাসো। এল গ্রেকোর ফিগারের মতো শীর্ণ হাত-পাওয়ালা এসব বেদনানীল ছবি তেমন বিক্রিও হতো না। কয়েক বছর কষ্ট করতে হয়েছে পিকাসোকে। থাকা, খাওয়াসহ সব রকম আর্থিক সঙ্কট ছিল নিত্যসঙ্গী।
পিংক পিরিয়ড
প্যারিসের স্থায়ীজীবন থেকে পিকাসোর ক্যানভাসে আবার এক ধরনের বাঁক দেখা দিল। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে পরিচয় হয় ফার্নান্দো অলিভিয়েরের সঙ্গে। শিল্পীর জীবনে প্রেম ও আনন্দের ঢেউ জাগে। এ সময় বিশ্বখ্যাত কবি গিয়োম এপোলোনিয়ের সঙ্গেও পরিচয় হয়। শিল্পীর জীবন থেকে বিষণœতার নীল যন্ত্রণা কেটে যেতে থাকে। এবার তার ক্যানভাসে রঙের জায়গায় সেই বেদনানীল বিষণœতা পাল্টে গিয়ে ধীরে ধীরে স্থান পেতে থাকল গোলাপি। পিকাসোর এই পর্বেরও একটা বিশ্বখ্যাত নাম আছে—‘পিংক পিরিয়ড’ বা গোলাপি পর্ব। এ ধারায় তিনি ছবি আঁকেন ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। গোলাপি পর্বের চিত্রগুলোতে দেখা যায় কমলা ও গোলাপি উষ্ণ রঙের আধিক্য। এর মধ্যে আছে আনন্দ। এ সব ছবিতে দেখা যায় মানব জীবনে অনেক শূন্যতা আছে কিন্তু সামাজিক বা আর্থিক দৈন্য নেই। তিনি ফার্নান্দো অলিভিয়েরকে মডেল করে অনেক ছবি আঁকলেন। এর মধ্যে শিল্পীর সঙ্গে পরিচয় হয় বিশ্বের বিভিন্ন মহাদেশের লোকজনের সঙ্গে। সংকীর্ণ জাতীয়তার ঊর্ধ্বে নিজেকে দেখতে পেলেন। পরিচিত হলেন মার্কিন লেখক ভাই-বোন লিও স্টেইন ও গারট্রুড স্টেইনের সঙ্গে। তারা প্যারিসের গ্যালারিগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। একটি গ্যালারিতে পিকাসোর একটা ছবি দেখে ভালো লেগে যায়; তা কিনে নেন তারা। পিকাসোর ছবিটি তারা কিনে নেন সে সময় আটশ ফ্রাংক দিয়ে। এর আগে এত বেশি দামে পিকাসোর কোনো চিত্রকর্ম বিক্রি হয়নি। এখন থেকে চিত্রকর্ম বিক্রি হতে থাকলে পিকাসোর হাতে টাকা-পয়সা আসতে থাকে। অভাব-অনটন দূর হয়।
এর আগে ১৯০৩-এর দিকে প্যারিসের শীতের কামড়ে তিনি নিজের ছবি পুড়ে আগুন জ্বেলে রাত কাটিয়েছিলেন। সেদিন ইচ্ছা ছিল সারা রাত ছবি আঁকবেন কিন্তু দিনের নানা ব্যস্ততার ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু রাতে তীব্র শীতের প্রকোপে সারা শরীর জমে গিয়ে মরে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত দেশলাই জ্বেলে অনেকগুলো ছবি, স্কেচ ও ফ্রেম পুড়িয়ে সারা রাত তাপ নিয়ে প্রাণে বেঁচেছেন।
মার্কিন লেখক ভাই-বোন লিও স্টেইন ও গারট্রুড স্টেইনের প্যারিসের বাসভবন ইউরোপীয় ও আমেরিকান বুদ্ধিজীবীদের যেন প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে। এখানেই ফরাসি চিত্রশিল্পী অঁরি মাতিস (১৮৮৯—১৯৫৪)-এর সঙ্গে পিকাসোর পরিচয় হয়। মাতিসের সঙ্গে পিকাসোর সুসম্পর্ক স্থায়ী ছিল ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে মাতিসের মৃত্যু পর্যন্ত।
গোলাপি পর্বের ছবিগুলোতে পিকাসো কৌণিক রেখার পরিবর্তে ঢেউ খেলানো রেখা ব্যবহার করেন। এই রেখায় ও রঙে কোমলতা ফিরে আসে। এ সময় তিনি যে সব ছবি আঁকেন এর মধ্যে কয়েকটি বিখ্যাত হয়ে আছে। যেমন, ‘শেমিজপরা মেয়ে’, ‘নগ্ন তরুণী’, ‘প্রসন্ন রাখাল বালক’ ইত্যাদি। এ সব ছবিতে দেখা যায় আনন্দের বিষয়গুলো উষ্ণ রঙে প্রকাশিত হচ্ছে। এ পর্বে তিনি ভাস্কর্যও সৃষ্টি করেন। ব্রোঞ্জে তৈরি দুটি ভাস্কর্যের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য— ‘কার্নিভালের সঙ’ ও ‘এক রমণীর মাথা’।
নিগ্রো বা ব্ল্যাক পিরিয়ড
১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে পাবলো আবার স্বদেশে চলে আসেন। গ্রীষ্মকাল কাটান পিরেনিজ পর্বতের উরগুল উপত্যকার একটি আদিম গ্রাম গোসোল-এ। সেখানে তার সহযাত্রী ছিলেন জীবনসঙ্গিনী ফার্নান্দো অলিভিয়ের। সেখানে তিনি অনেক কাজ করেন। ধ্রুপদী রীতির প্রভাব দেখা দেয় তার মধ্যে। চিরায়ত ভাস্কর্যের ফিগারের আদলে তার ক্যানভাসে ফিগার আঁকতে শুরু করলেন। এ বছর তিনি এই রীতিতে গারট্রুড স্টেইনের ছবি আঁকেন। আঁকেন ‘টু ন্যুড’ প্রভৃতি কালজয়ী চিত্রকর্ম।
কিউবিজম (১৯০৯—১৯১৫): পরের বছর তিনি আঁকেন বিশ্বের প্রথম কিউবিক ধারার চিত্র ‘দাভিনঁর রমণীরা’। এ ধারার চিত্রে ফিগারের রেখা ভেঙে উদ্ভট এক ধরনের জ্যামিতিক রেখায় চেহারা আঁকেন। এখানে তিনি চেহারার বাস্তব রূপ আঁকার চেয়ে চেহারার উল্টোদিকের দৃশ্য সম্পর্কে ধারণা দিতে চেষ্টা করেন। মাতিসের মাধ্যমে পরিচয় হয় জর্জ ব্রাক ও আঁদ্রে দেরাঁর সঙ্গে। দুজনেই ছিলেন ফবিস্ট ধারার শিল্পী। পরে ব্রাক কিউবিস্ট ধারায় পিকাসোর সহযাত্রী হন।
কিউবিস্ট ধারায় পুরোপুরি নিমজ্জিত হওয়ার আগে পিকাসো দুটি আত্মপ্রতিকৃতি আঁকেন। ছবিগুলোতে দেখা যায় ক্যানভাস জুড়ে শাদা রঙের আধিক্য। সামান্য গাঢ় রঙ ব্যবহার করেন। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে আঁকেন ‘পাখা হাতে রমণী’র মতো ছবি।
কিউবিজম নিয়ে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে পিকাসোকে। প্রথম দিকে এই নতুন ধারাকে অন্য শিল্পী ও শিল্পসমালোচকরা সহ্য করতে পারেননি। ‘দাভিনঁর রমণীরা’ আঁকার পরে তীব্র বিরোধিতা দেখা যায়। সবার প্রশ্ন এ কেমন ধরনের নারীর ছবি? যেখানে নারীদেহের কোমলতা নেই, আকর্ষণ নেই! আছে ভাঙ্গাচোরা চেহারার উদ্ভট ধরনের অচেনা মুখ।
পিকাসোর এই ব্যস্ত সময়ের ভেতর দিয়েই বয়ে যেতে থাকে বেদনাদায়ক নানা ঘটনার কালস্রোতে। অন্য দিক থেকে বলতে গেলে বলতে হয়, নানা রকম যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে জীবন চলার পথে সান্ত¦নার জন্য পিকাসো ব্যস্ততার মধ্যে ডুবে থাকেন। ১৯১২ সালে তার জীবনসঙ্গিনী ফার্ন্দান্দো অলিভিয়ের চিত্রশিল্পী উবালদো ওপ্পির সঙ্গে চলে যান। এতে পিকাসো দারুণভাবে হতাশায় পড়ে যান। এ হতাশা কাটানোর জন্য তিনি ব্যস্ত থাকেন। তবে তার জীবনে এ সময় নতুন এক সঙ্গিনী জুটে যায়। তিনি হলেন— মার্সেল হামবোর্ট ওরফে ইভা। ১৯১৩ সালে পিতা রুইজ ব্লাসকো মারা যান।
কিছুদিন পরেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এই যুদ্ধের প্রসঙ্গটা শিল্পকলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। বন্ধুদের মধ্যে এপোলেনিয়ার, শিল্পী ব্রাক এবং আরো কয়েকজন বন্ধু যুদ্ধে চলে যান। সরকার তাদের জোর করে যুদ্ধে পাঠায়। পিকাসো ভিনদেশি বলে যুদ্ধে পাঠানো হল না। এ সময় প্যারিসের জীবন কিছুটা কঠিন হয়ে ওঠে। তার স্বদেশি বন্ধুরা মাতৃভূমিকে ফিরে গেল। তিনি রয়ে গেলেন প্যারিসে। কিন্তু ছবি আঁকার মতো মনের জোর বা আগ্রহ রইল না। তার চিত্রবিক্রেতা কানভিলারের দেশের বাড়ি জার্মানিতে। ফরাসিদের শত্রু জার্মানরা। তার দোকান ও সব মালামাল সরকার ক্রোক করে নিয়ে গেল। পিকাসোর প্রতিবেশী এবং দেশি শিল্পী জঁ গ্রি ফ্রান্সের বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করলেন। কারণ তার কাছে ফ্রান্সে এসে থাকার বৈধ কাগজপত্র ছিল না।
পিকাসো তখন পূর্ব ইউরোপের শিল্প-সাহিত্য সমৃদ্ধ দেশ রাশিয়া সম্পর্কে জানার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এর মধ্যে শিল্পীর নতুন সঙ্গিনী ইভা যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারাত্মক অবস্থায় চলে গেছেন। পিকাসো তার চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন। স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে পিকাসো তাকে হাসপাতাল নিয়ে ভর্তি করান। নিজে সময় দিয়ে সেবা করেন। কিন্তু সব চেষ্টা বিফল হয়। ইভা মারা যান ১৯১৫ সালে।
এই শোক ভুলে থাকার জন্য পিকাসো আবার ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। এ সময় পরিচয় হয় কবি, ঔপন্যাসিক, চিত্রশিল্পী জাঁ ককতোর সঙ্গে। ককতো পিকাসোকে নতুন কাজে জড়িয়ে নেন। তিনি ব্যালে নৃত্যের পরিচালক ছিলেন। ককতো ব্যালের মালিক সের্গেই দিয়েগিলেভের এক নৃত্য অনুষ্ঠানের ব্যালে দৃশ্য ও মঞ্চ সজ্জা, পরিচালনা ও কস্টিউম ডিজাইনের কাজ দেন। পিকাসো রুশ ব্যালেরিনাদের জন্য কাজ করে দেন। তবে সেই কাজ বুর্জোয়া দর্শকদের কাছে ভালো লাগেনি। তারা আশা করেছিলেন এসব দৃশ্যে ও সাজসজ্জায় আভিজাত্য তুলে ধরা হবে। কিন্তু পিকাসো সমাজের বৈষম্য, যুদ্ধের ভয়াবহতা ইত্যাদি তুলে ধরেছেন।
রাশিয়ান ব্যালের সঙ্গে কাজ করা পিকাসোর জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা। তিনি নৃত্য সম্পর্কেও আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এই ব্যস্ততার মাঝে পিকাসোর জীবনে নতুন প্রেম আসে। রুশ ব্যালেরিনা ওলগা কখলোভার সঙ্গে পরিচয় ও প্রেম গড়ে ওঠে। ওলগা জারের রাশিয়ার একজন কর্নেলের মেয়ে। কয়েক বছর ধরেই পিকাসো রাশিয়া সম্পর্কে আগ্রহী। এ সময় কখলোভার সঙ্গে পরিচয় হওয়াতে রুশ অভিজাততন্ত্রের কাছে চলে যান পিকাসো। তার মাধ্যমে রুশ সমাজ সম্পর্কে জানতে পারেন। সেখানকার উচ্চবিত্তের লোকেরা কেন লেনিনের নামে অপবাদ ছড়ায় তা বোঝা গেল।
নিউ ক্লাসিক্যাল পিরিয়ড (১৯১৮—১৯২৭)
লেনিনের ১৯১৭ সালে নেতৃত্বে অক্টোবর বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার কারণে রাশিয়ান অভিজাত ব্যালে ট্রুপসটি দেশে ফিরে যেতে পারছিল না। পশ্চিম ইউরোপের নানা দেশে ঘুরে বেড়াতে লাগল। পিকাসোও দলে মিশে ঘুরতে লাগলেন। ফ্রান্স থেকে ইতালি চলে যান তিনি ব্যালে ট্রুপসের সঙ্গে। ইতালির রোম, মিলান, পম্পেই, নেপলস, ফ্লোরেন্স প্রভৃতি শহরে ঘুরে পিকাসো গ্রিক, রোমান ও রেনেসাঁ যুগের ক্লাসিক শিল্পকর্ম দেখতে থাকেন। চিরায়ত এসব শিল্প তাকে মুগ্ধ করে। তিনি ভ্রমণের মাঝে ড্রয়িং চালিয়ে যান। মাঝে মাঝে ছবিও আঁকেন। এ সময়ের ছবিতে ক্লাসিকরীতি প্রাধান্য পায়। ফিগারের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো ক্লাসিক ভাস্কর্যরীতিতে গড়ে ওঠে। বিষয়বস্তু নির্বাচনেও ইউরোপের ঐতিহ্য প্রাধান্য পেতে থাকে। ১৯২৩ পর্যন্ত পিকাসো নব্যধ্রুপদী ধারায় ছবি আঁকেন। এর মধ্যে ১৯১৮-তে ওলগা কখলোভাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পরে কখলোভাকে নিয়ে বার্সিলোনা ও বিয়ারিজে ভ্রমণে যান। পরের বছর লন্ডন ভ্রমণ করেন। কবিবন্ধু গিওম এপোলিনিয়ার মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে যুদ্ধে আহত হয়ে ফিরে আসার পরে কিছুদিন ভুগে এ বছর নভেম্বর মাসের ১২ তারিখে মারা যান। তার মৃত্যুর দিনটিই ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক বিরতি ঘোষণা করা হয়।
১৯২১ সালেই পিকাসোর পুত্র পাওলো (পল)-এর জন্ম হয়। সন্তানের পিতা হয়ে পিকাসো মা ও শিশুকে নিয়ে ছবি আঁকেন। সে সব ছবি বিখ্যাত হয়ে আছে।
সুররিয়ালিজম (১৯২৭—১৯৩৭)
এর পরে পিকাসো পরাবাস্তব অর্থাৎ সুররিয়ালিজমের দিকে ঝুঁকে পড়েন। প্যারিসের পিয়ের গ্যালারিতে সুররিয়ালিস্ট ধারার চিত্রপ্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন পিকাসো। এ সময় ঘনিষ্ঠতা হয় কয়েকজন উল্লেখযোগ্য রকমের বিখ্যাত সাহিত্যিক আন্দ্রে ব্রেতোঁ, লুই আরাগঁ, পল এলুয়ার, সালভাদর দালি প্রমুখের সঙ্গে। এদের মধ্যে পল এলুয়ারের সঙ্গে মনের ও মতের মিল বেশি হওয়ায় সম্পর্কও বেশি ঘনিষ্ঠ হয়। ১৯৩১ সালের দিকে কিছু ভাস্কর্যের কাজ করেন। ধাতুর কাজ ছাড়াও প্লাস্টার, ব্রোঞ্জ এবং কাদামাটি দিয়েও নানা কাজের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। পরবর্তী আরো দুতিন বছর পর্যন্ত তিনি ছবি আঁকার পাশাপাশি ভাস্কর্যের কাজ করেন। ১৯৩৩ সালে সৃষ্টি করেন ‘যোদ্ধার উর্ধ্বাঙ্গ’, ১৯৪৩ সালে করেন ‘ষাঁড়ের মাথা’।
ওলগা কখলোভা ছিলেন জারের রাশিয়ার অভিজাত পরিবারের সন্তান। পিকাসোর সঙ্গে দাম্পত্যজীবন চালিয়ে যেতে সুবিধা বোধ করলেন না। পিকাসো মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে হতে টাকা-পয়সা হাতে এসেছে। পিকাসো এখন আর্থিকভাবে সচ্ছল। কিন্তু আভিজাত্য নেই তার। বরং পল এলুয়ারের মতো বামপন্থী কবির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। কখলোভার দেশের প্রধান শত্রু লেনিনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
এ ছাড়া শিল্পী হিসেবে পিকাসোর রয়েছে বিশাল এক আধিপত্য, বিশাল সাম্রাজ্য। সেই সাম্রাজ্যের বাইরে ওলগা কখলোভা একা; বড়ই নিঃসঙ্গ। সাম্প্রাজ্য চারপাশে শক্ত দেয়াল দিয়ে ঘেরা। সেখানে ওলগা চেষ্টা করেও প্রবেশ করতে পারেন না। চিত্রকলার প্রতি তার আকর্ষণ থাকলেও বিষয়টা তার বোধগম্যতার বাইরে। পিকাসোর রাজ্য ক্ষুদ্র থেকে বড় হতে হতে বিশাল সাম্প্রারাজ্য হয়ে উঠেছে। সেখানে অনেক লোকজন। অতীতের অনেক নারীর মর্যাদাপূর্ণ স্মৃতি। ওলগা সেগুলো মেনে নিতে পারেন না। তার ঈর্ষা হয়। তিনি একাই পিকাসোর সাম্রাজ্য জুড়ে থাকতে চান। কিন্তু পিকাসো তা হতে দেবেন না। আগের প্রেমিকাদের বিষয়ে পিকাসো স্মৃতিকাতর নন। তবে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। এ কারণেই তার স্মৃতিচারণায় তাদের এত মর্যাদা। এসব বিষয়ে ওলগা দেখতে পেলেন তার সঙ্গে পিকাসোর বনিবনা হচ্ছে না। দূরত্ব দিনে দিনে বেড়েই চলছে।
ব্যালে নৃত্যশিল্পী হিসেবে ওলগারও একটা বিশাল পরিচয় আছে মহাদেশ জুড়ে। কিন্তু সেখানে পিকাসো তাকে যেন পাত্তা দিতে চান না। আভিজাত্য, নারী হিসেবে অধিকার চেতনা, স্বাভাবিক ঈর্ষা এবং উপেক্ষার বিষয়ে ওলগার মানসিকতা চরম উচ্চতায় ওঠার পরে ১৯৩৫ সালে তাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়।
ওলগার সঙ্গে সম্পর্ক হালকা হয়ে যাওয়ার সময় পিকাসোর নিঃসঙ্গ জীবনে নতুন করে সম্পর্ক হয় মারি থেরেসা ভোল্টার সঙ্গে। বাজার করতে গিয়ে পরিচয় হয় থেরেসোর সঙ্গে। থেরেসা ছিলেন আঠারো বছরের তরুণী। তিনি পিকাসোকে আগে কোনোদিন দেখেননি; নামও শোনেননি। পিকাসো একের পর এক জনের কাছ থেকে পাওয়া কষ্টের অবসান আশা করে থেরেসাকে ভালোবাসেন। তাকে নিয়ে শিল্প রচনা করতে করতে অতি উচ্চে উঠতে থাকেন।
১৯৩৫ সালে ওলগার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয় তবে ছাড়াছাড়িটা ছিল একটা জটিল ও ঝামেলার বিষয়। কারণ তখনো স্পেনে ডিভোর্স প্রথা চালু হয়নি। আইনগত বৈধতা ছিল না। প্যারিসে গিয়ে ছাড়াছাড়ি হয়। ওলগা কখলোভা তাদের পুত্র পাওলোকে সঙ্গে করে নিয়ে যান। পুত্রহারা শূন্য ঘরে পিকাসোর হৃদয় হাহা করে উঠল। স্ত্রীর সঙ্গে সন্তানকেও হারালেন। কষ্টে তার সময় কাটতে চায় না; শিল্পচর্চা করবেন তো দূরের কথা। তবু পিকাসো কষ্ট ভুলে থাকার জন্য কাজে ডুব দিয়ে থাকেন। আর মাঝে মাঝে নতুন পরিচিত কিশোরী মেরি থেরেসার সঙ্গে সময় কাটান। কিছুদিন পরে থেরেসার গর্ভে পিকাসোর প্রথম কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। নাম রাখলেন আমেরিকা মহাদেশের শক্তিশালী প্রাচীন সভ্যতার নাম অনুসারে— মায়া।
কন্যা সন্তানের পিতা হওয়ার পরে এবার একটু স্বস্তি পেলেন। মনে শান্তি এল। কন্যাকে নিয়ে অবসর কাটে। যদিও অস্থিরচিত্তের পিকাসোর জীবনে অবসর বলে কিছু ছিল না। কিন্তু দৈনন্দিন কাজের ভেতর দিয়ে তিনি কন্যাকে আদর করেন। ছবি আঁকেন। পিকাসা ছবি আঁকার ক্ষেত্রে কোনো তত্ত্বকে অবলম্বন করেননি। শুধু সময়কে ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি বেছে নিয়েছেন মাত্র। এবার তিনি সময়কে একটু ভিন্ন মাত্রায় ধরে রাখার জন্য নতুন করে কবিতা লেখা শুরু করলেন। তার এতগুলো কবিবন্ধু। আজকে থেকেই নয়। সেই প্যারিসে আসার পর ১৯০১ সাল থেকে কবিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। কত কবির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, দেখা, সাক্ষাৎ পরিচয় ইত্যাদি। তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা। আগেও তিনি কবিতা লিখেছেন। এবারও অনেকগুলো কবিতা লিখলেন। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে অনেকে কবি হয়ে ছবি আঁকেন। আন্দ্রে ব্রেতো, জাঁ ককতো, গিওম এপালোনিয়ার, পল এলুয়ার প্রমুখ। পিকাসো শিল্পী হয়ে কবিতা লেখছেন। কিন্তু বন্ধুরা তা গ্রহণ করলেন না। পল এলুয়ার তীব্র সমালোচনা করলেন। এর পেছনে ব্যক্তিগত ক্ষোভ ছিল কি না তা পিকাসো যাচাই করেননি। তবে পল এলুয়ারের চেয়ে বেশি সমালোচনা করেন গারট্রুড স্টেইন। এই বিষয়ে গারট্রুডের সঙ্গে পিকাসোর কথা কাটাকাটিও হয়েছিল। তিনি সমালোচনার মুখে কবিতা লেখা ছেড়ে দিলেন। তবে তার কবিতার প্রশংসা করতেন জাঁ ককতো।
১৯৩৭ সালের এপ্রিল মাসের এক রাতে বাস্ক শহর গুয়ের্নিকা বিমান হামলায় সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দেওয়া হল। রাতের অন্ধকারে হামলা করে ঘুমন্ত নারী ও শিশুদের হত্যা করে ফ্রাঙ্কো জনগণকে ভয় দেখাতে চাইলেন। তারা যেন আর তার সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে সাহসী না হয়। প্যারিসে বসে পিকাসো সব শুনলেন। তিনি কোনো দিন গুয়ের্নিকা যাননি। শহরটি দেখেননি। পিকাসো গুয়ের্নিকা শহর নিয়ে প্রায় বারো ফিট চওড়া ও পঁচিশ ফিট দীর্ঘ বিশাল ক্যানভাসে আঁকলেন কালজয়ী ছবি ‘গুয়ের্নিকা’। গুয়ের্নিকায় বিমান হামলার তিন মাস আগেই পিকাসো স্পেনের রিপাবলিকান সরকারের পক্ষে একটি ছবি আঁকার প্রস্তাব পেয়েছিলেন। নানা কাজে ব্যস্ত থাকায় কাজটিতে হাত দিতে সময় পাননি। এবার এই ভয়াবহ ও হৃদয়বিদারক ঘটনার পরে নিজে থেকেই আগ্রহী হয়ে বিশাল মুর্যালের কাজটি শুরু করলেন। মে মাসের ১ তারিখে তিনি কাজ শুরু করেন। এক সপ্তায় তিনি কাজটির পরিকল্পনা করে উঠলেন। একটানা কাজ করে জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক মেলায় প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করলেন।
ছবিটি প্রদর্শনীতে দর্শকদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। পিকাসো এ কী কাজ করেছেন! যুদ্ধের সব রকম অনুভূতির প্রকাশ এখানে আছে। কী বিশাল কাজ! বিশাল এ ছবিটি কিউবিজম, সুরলিয়ালিজম ও নিউক্লাসিসিজমের সমষ্টি। হতাশা, বেদনা, আর্ত চিৎকার, পঙ্গুত্ব, আতঙ্কসহ যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির সবকিছু তুলে ধরলেন।
ছবিটিতে নিহত সৈনিক, বিপন্ন নারী, আহত শিশু, আতঙ্কগ্রস্ত ঘোড়ার আর্তচিৎকার, ষাঁড়ের অন্ধশক্তি, ওপরে বৈদ্যুতিক আলো, ভাঙ্গা তরোয়াল, জানালা দিয়ে এগিয়ে ধরা মশালসহ হাত ইত্যাদি অনেকগুলো বিষয় বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান করছে। ছবিটিতে গতি আছে; গল্প নেই। সব গল্প এখানে থেমে গেছে। শাদা, কালো আর ধূসর রঙে এই বিশাল কাজটিতে রঙের তীব্রতার অভাববোধও বিস্ময়ের ব্যাপার! যদিও সবকিছু যথাযথ। পরের বছর পিকাসো যুদ্ধে আহত এবং স্বজনহারা শিশুদের জন্য মাদ্রিদে আর বার্সিলোনায় দুটি অনাথআশ্রম খুললেন। প্রত্যেকটিতে তিনি দুইশ হাজার করে ফ্রাঙ্ক দিলেন। পরের বছর ১৯৩৯ সালে তার মা ডোনা মারিয়া পিকাসো বার্সিলোনায় মারা যান। পিকাসো বার্সিলোনা যান। পিকাসো প্যারিস ফিরে এসে আবার হতাশা ও বিষণœতায় আক্রান্ত হলেন। পরে বোর্দোর কাছে রয়্যাঁয় বসবাস করতে থাকেন। অনেক বছর আগে থেকেই পিকাসো রাতে একা থাকতে ভয় পেতেন। নিঃসঙ্গতা ছিল তার শত্রু। এ কারণে তিনি নতুন নতুন বন্ধু খুঁজতেন। তবু বার বার নিঃসঙ্গতা তাকে ঘিরে ঘরে। পুরুষ বন্ধুরা রাতের নিঃসঙ্গতা দূর করতে পারে না। ঘুমের ভেতরকার ভয় দূর করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে নারী বন্ধুরা কিছুটা বিশ্বস্ত।
এর মধ্যে স্পেনের গৃহযুদ্ধ চলতে চলতেই হিটলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করে দিলেন। একের পর এক দেশ দখল করে নিলেন। মায়ের মৃত্যু, হিটলারের হাতে প্রিয় শহর বার্সিলোনার পতন, ভয়াবহ যুদ্ধ, একের পর এক বন্ধুর যুদ্ধে যোগদান অন্যদের পালিয়ে যাওয়া—সবকিছু মিলিয়ে এক ভয়ের রাজ্যে প্রবেশ করেন পিকাসো।
যুদ্ধের মধ্যে ১৯৪১ সালে ‘চেয়ারে বসা রমণী’ সিরিজের ছবি আঁকা শুরু করেন। যুদ্ধের বিষয় নিয়ে ‘ডিজায়ার কট বাই দ্য টেইল’ নামে পরাবাস্তবধর্মী নাটক রচনা করেন। পিকাসো সারা জীবনে ফরাসি এবং স্পেনিশ ভাষায় বারোটি নাটক লিখেছিলেন।
যুদ্ধের দিনগুলোকে জার্মান অধিকৃত প্যারিসে পিকাসো চুপচাপ রইলেন। বিদেশি নাগরিক পিকাসোর তখন ফ্রান্সে থাকাটা কঠিন ছিল। তার ওপর তিনি ফ্রাঙ্কোবিরোধী। হিটলারের কানে সব কথাই যায়। তবু জার্মান সৈন্যদের চোখ এড়িয়ে তিনি প্যারিসেই থাকলেন। যাবেনই বা কোথায়? খোঁজ-খবর নিয়ে জানেন যে স্পেনের অবস্থা আরো খারাপ। প্রিয় শহর বার্সিলোনার পতন হয়েছে নাৎসিদের হাতে। আর প্যারিসে তার স্টুডিও, মূল্যবান সব চিত্রকর্ম। মুখ বুঁজে একদিন দুইদিন নয়, কঠিন পাঁচটি বছর চরম আতঙ্কে আর বিভীষিকার মধ্যে কাটালেন।
অবরুদ্ধ প্যারিসের পিকাসো তখন দেশ-বিদেশের সংবাদ হয়ে উঠলেন। কেমন করে তিনি জীবিত আছেন, কেমন করে বছরগুলো পার করেছেন এ বিষয়ে গণমাধ্যমগুলোর কৌতূহলের সীমা নেই। দেশ-বিদেশের সংবাদপত্রের পাতায় উঠতে লাগল পিকাসোর কথা, তারই ছবি।
যুদ্ধের শেষে পিকাসো কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করলেন। তার সরাসরি পার্টিতে যোগদান অনেকেই সহজে মেনে নিতে পারেননি। এর মধ্যে বন্ধুতালিকায় যোগ-বিয়োগ হয়েছে। নতুন বান্ধবীও জুটেছে। ডোরা মার নামের যুগোশ্লাভিয়ার এক আলোকচিত্রী তার ঘরে নতুন অতিথি। ১৯৩৬ সালে পিকাসোর সঙ্গে পরিচয় হয় তার। মা ক্রোয়েশিয়ান বাবা ও ফরাসি মায়ের সন্তান ডোরা আর্জেন্টিনা বড় হয়েছেন। স্পেনিশ ভাষা বেশ ভালোই জানেন।
মার্শাল টিটোর দেশের পরাবাস্তববাদী আলোকচিত্রী ডোরা পিকাসোকে বামধারার রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা দেন। তাকেই ‘গুয়ের্নিকা’ সৃষ্টির পেছনে অনুপ্রেরণাদাতা বলে মনে করা হয়। ডোরা মার অবশ্য মায়ের কাছেই থাকতেন তবে পিকাসোর ঘরেও আসতেন। ডোরা মারের ভূমিকা পিকাসোর জীবনে অনেক। যুদ্ধের সময়— বিভীষিকার বছরগুলোতে তিনিই পিকাসোর কাছে ছিলেন (১৯৩৬—১৯৪৩)। তিনি পিকাসোর চিত্রে প্রায় একটি দশক জুড়ে ছিলেন। পিকাসোর অনেক শিল্পকর্মের ছবি তুলে রেখেছেন তিনি। তার সঙ্গে একবার কথা কাটাকাটি হলে ডোরা চিৎকার করে পিকাসোকে বকাঝকা দিতে শুরু করলেন। এ সময় কাছে উপস্থিত থাকা কবি পল এলুয়ার উঠে এসে একটা চেয়ার আছাড় মেরে ভেঙে চিৎকার বললেন, ‘ডোরা সত্যিই বলছে।’ পিকাসো প্রথমে বন্ধুর আচরণে হতবাক হয়ে গেলেন। কিন্তু পরে বুঝলেন এটা প্রতিশোধ। সালভাদর দালিকে সহযোগিতা করার কারণেই এই কবিবন্ধু তার ওপর রুষ্ট।
যুদ্ধের মাঝে ১৯৪৩ সালে প্যারিসে ফ্রাঁসোয়া জিলোর সঙ্গে পরিচয় হয় পিকাসোর। ফ্রাঁসোয়ার জন্ম ১৯২১ সালে। বাবা কৃষিতত্ত্ববিদ ও মা জলরঙ শিল্পী। জিলোরও ইচ্ছা ছিল চিত্রশিল্পী হবেন। কিন্তু বাবা চেয়েছেন উচ্চশিক্ষিত বিজ্ঞানী অথবা আইনজীবী হবেন। বাবার ইচ্ছায় জিলো আইন পড়ছিলেন। কিন্তু মন পড়ে রয়েছিল শিল্পের ভুবনে। তাই তিনি পিকাসোর সঙ্গে অল্প সময়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে যান। এ সময় পিকাসোর ঘরের অধিবাসী হয়ে যান। এর পরে ১৯৪৩ থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত জিলো পিকাসোর জীবনসঙ্গিনী হিসাবে থাকেন। তাদের ঘরে ১৯৪৭ সালে পুত্র ক্লদ এর জন্ম। এ সময় তিনি যে সব ছবি আঁকেন তার মধ্যে স্থান পেতে লাগল বিভিন্ন কনসেনট্রেশন ক্যাম্প নামক মৃত্যুগুহা থেকে ফিরে আসা জীবনহীন, শীর্ণকায়, রুগ্ন ও মৃতপ্রায় মানুষদের ছবি।
১৯৪৮ সালে পিকাসো পোল্যান্ডের কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক শান্তি কংগ্রেসে যোগদান। পরের বছরও তিনি পোল্যান্ডের কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলনে যাওয়ার আমন্ত্রণ পেলেন। তার মতো বড় মাপের শিল্পীকে পেয়ে পার্টি সন্তুষ্ট। সম্মেলনের জন্য একটা প্রতীক এঁকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার জন্য পার্টির পক্ষ থেকে বলা হল। নানা ব্যস্ততায় পিকাসো আঁকতে পারেননি। শেষ মুহূর্তে পার্টির কয়েকজন কর্মী তার স্টুডিওতে প্রবেশ করে লিথোগ্রাফে করা একটি পায়রার ছবি পেয়ে নিয়ে গেল। তারা ছবিটি শহরের উল্লেখযোগ্য স্থানে ঝুলিয়ে দিলেন। পরে শান্তি সম্মেলনে শান্তির প্রতীক হিসেবে তার আঁকা পায়রার ছবিটি গ্রহণ করল। এবং সারাবিশ্বে তা সাদরে গৃহীত হল। এ বছর ফ্রাঁসোয়া জিলোর গর্ভে পিকাসোর একটি কন্যার জন্ম হয়। তার নাম রাখা হয় পালোমা। যার অর্থ পায়রা।
পঞ্চাশের দশকটা পিকাসোর জন্য আকার কঠিন হয়ে উঠল। যুদ্ধ থেকে ফিরে আসা ব্রাক এখন পিকাসোর শত্রু’ তার নামও শুনতে পারেন না। ব্রাক যুদ্ধে গিয়ে মানবতার ওপর আস্থা হারিয়ে প্রায় অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গেছেন। ১৯৫২ সালে তিনি গির্জার কাজ হাতে নিলেন। দৈনিক একটানা দশ ঘণ্টা করে কাজ করে সম্পন্ন করলেন ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ ছবিটি। ফ্রাঁসোয়ার সঙ্গেও নানা কারণে অনাস্থা চলে এল। ফ্রাঁসোয়া চিরতরে চলে যাওয়ার জন হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন। ফ্রাঁসোয়া চলে গেলে পিকাসো আবার নিঃসঙ্গ হয়ে যাবেন। আর নিঃসঙ্গতার কথা মনে হলেই পিকাসোর অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো শ্বাসরুদ্ধ পরিস্থিতি দেখা দেয়। আবার কি তাকে একা ঘরে ঘুমাতে হবে! অশান্তি এখন শিল্পীর ঘরে। এ বছর শেষ পর্যন্ত ফ্রাঁসোয়া জিলোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়েই যায়। তিনি চলে যাওয়ার সময় সন্তানদেরও নিয়ে যান। এক ছেলে ক্লদ (১৯৪৭) ও এক মেয়ে পালোমা (১৯৪৯)। ১৯৫৫ সালে ওলগা কখলোভার মৃত্যু হয়।
চরম মানসিক চাপে পিকাসো কাজে ডুবে রইলেন। কিন্তু কাজের অবসরে একাকীত্বের যন্ত্রণা চরম আকার ধারণ করে। এই চরম অবস্থা থেকে মুক্তির আশায় পিকাসো জ্যাকুলিন রোক নামের সাতাশ বছরের এক তালাকপ্রাপ্তা তরুণীর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুললেন। জ্যাকুলিনকে পেয়ে সত্তর বছরের পিকাসো যেন সমবয়সী তরুণ হয়ে গেছেন। তিনি জ্যাকুলিনকে সঙ্গে নিয়ে সিনেমা-থিয়েটার-পার্ক-নাইটক্লাবে যান। আদর-সোহাগ-আহ্লাদ করে সময় কাটান। সবার সামনেই ভালোবাসার কথা বলেন। এমন অবস্থা যখন চলছে তখন পিকাসোর কপালেই যেন অশান্তি লেখা ছিল। আগের সেই ফ্রাঁসোয়া ফিরে এসে ঝামেলা শুরু করে দিলেন।
জ্যাকুলিনের সঙ্গেও তখন খিটিমিটি অবস্থা। ঘরে তুমুল বিশৃঙ্খলা। পিকাসোকে রাতে একা ঘুমাতে হবে। পিকাসো তার মেয়ে মায়াকে বললেন সে যেন বাবার শোয়ার ঘরেই ভিন্ন বিছানায় ঘুমায়। মায়া মেরি থেরেসার সন্তান। বাবার ঘরে ঘুমিয়ে বৃদ্ধ বাবাকে নিরাপদে ঘুমাতে দিতে চায়। কিন্তু এ সময় ঝামেলা পাকালেন জ্যাকুলিন। পিকাসো এতে ক্ষুব্ধ হলেন কিন্তু কিছু বলতেও পারলেন না। একটা মমতাও আছে।
জ্যাকুলিনকে পিকাসো তাড়িয়ে দিলেন না। বরং বাড়িতে থাকতে দিলেন। তার অনেকগুলো ছবি আঁকলেন। জ্যাকুলিন পিকাসোর ভালোবাসা পেয়ে মুগ্ধ হয়ে বিশ্বনন্দিত শিল্পীর কাছেই রয়ে গেলেন। পিকাসো তখন বিশ্বখ্যাতির তুঙ্গে। বিশ্বের সব শ্রেষ্ঠ গ্যালারিতে তার ছবি ঝুলছে, প্রদর্শনী হচ্ছে। তাকে নিয়ে পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হচ্ছে। ডকুমেন্টারি সিনেমা হচ্ছে। ব্যাংকে অনেক টাকা-পয়সা সঞ্চিত আছে। পথে-ঘাটে বের হলে সাক্ষাৎপ্রার্থীদের ভিড় হয়। অটোগ্রাফশিকারীরা ঘিরে ধরে। দোকানে যেতে পারেন না, সেখানে ভিড় জমে যায় বলে। খ্যাতির বিড়ম্বনা কাকে বলে তা পিকাসো বুঝতে পারছেন। ঘরে কেউ না থাকরে একাই বন্দি হয়ে থাকতে হয়্ দোকানে খেতে যেতে পারেন না। এ সময় তিনি দোকানে গেলে বিলে সইও করতেন না। যদি তার সেই স্বাক্ষর অটোগ্রাফ হিসাবে নিলামে ওঠে!
এত অর্থ-বিত্ত, সম্পদ-সম্পত্তি, নাম-খ্যাতির আড়ালে আছেন একজন দুঃখী। যেন পিকাসো খ্যাতি ও সম্পদের পাহাড়ে ডুবে থাকা একজন যন্ত্রণায় নিমজ্জমান মানুষ। তাকে সত্যি করে বোঝার মতো কেউ নেই। ১৯৫৮ সালে তিনি একটি আস্ত একটি দুর্গ কিনে নেন। সেখানে গেলে বুঝি মনে শান্তি পাবেন। দুর্গটি কিনে তিনি জগৎসেরা শিল্পীদের ছবি দিয়ে ভরিয়ে তুললেন। প্রিয় ও বন্ধু শিল্পীদের মধ্যে সেজান, ব্রাক, রুশো, দেগা, রেনোয়াঁর ছবিও রাখলেন। নিজের কিছু ছবিও ঝোলালেন।
খ্যাতির চূড়ায় বসে পিকাসো যা করেন তাই জনসাধারণের, ভক্ত-অনুরাগীর মনে আকর্ষণ সৃষ্টি করে। তাকে এক পলক দেখার জন্য হাজার হাজার মানুষ ভিড় করে। পিকাসোর কেনা দুর্গটিতে আগ্রহী দর্শকের ভিড় লেগেই থাকে। শিল্পী তার ব্যক্তিগত সময় নিয়ে ঝামেলায় পড়লেন। একান্ত সময় ও পরিবেশ বলে কিছুই পেলেন না। তিনি নীরবতা ও নিবিড়তা ভালোবাসেন। সত্তরোর্ধ্ব বয়সে যে কেউ তাই চায়। কিন্তু পিকাসো নিঃসঙ্গতা সহ্য করতে পারেন না। সারা জীবনে এমন কাউকে পাননি। যাকে নিয়ে সারা জীবন এক ঘরে সুখে-শান্তিতে-নিবিড়ে কাটিয়ে দেবেন। এই বয়সে একা থাকতে কারোই ভালো লাগে না।
জ্যাকুলিনকে পিকাসো দুর্গাধিপতি করে দিলেন। শেষ বয়সে একটু সঙ্গলাভের আশায়। কিন্তু ভক্ত-অনুরাগীদের জ্বালায় এখানে থাকাটা কষ্টকর হয়ে উঠল। মানসিক অশান্তি বেড়ে চলল। অবশেষে তিনি প্যারিস শহরের বাইরের এক গ্রামে নোতরদেম নামক এক বাড়িতে গিয়ে উঠলেন। এবার তিনি কিছুটা স্বস্তি পেলেন।
১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ২ মার্চ পিকাসো জ্যাকুলিনকে বিয়ে করেন। তখন পিকাসোর বয়স প্রায় আশি। জ্যাকুলিনের ছিল পঁয়ত্রিশ।
এ বছরগুলোতে পিকাসোকে অনেক ব্যস্ত দেখা যায়। এ বছর জিলো পিকাসোকে নিয়ে একটি বই লেখেন— ‘লাইফ উইথ পিকাসো’। এ গ্রন্থে পিকাসোকে চরমভাবে অপমান করা হয়। শুধু তার নেতিবাচক দিকগুলোই তলে ধরা হয়। বৃদ্ধ বয়সে পিকাসো মারাত্মকভাবে অপমানিত, আশাহত ও বেদনাহত হলেন। রাগে, ক্ষোভে, অপমানে ও লজ্জায় একেবারে গৃহবন্দি হয়ে গেলেন। তিনি ফ্রাঙ্কোয়েসের সঙ্গে এবং তার ঘরের ছেলেমেয়েদের সঙ্গেও সম্পর্ক ছিন্ন করে দিলেন। অন্ধের যষ্ঠী হিসাবে জ্যাকুলিনকে আশ্রয় করে পিকাসোর জীবন আবর্তিত হতে লাগল। জ্যাকুলিনের ছবি আঁকতে লাগলেন একের পর এক। নানা মাধ্যমে নানা স্টাইলে।
জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পিকাসো বিভিন্ন মিউজিয়ামে বিলিয়ে দেন। এ সময় তিনি বোধ হয় মৃত্যুভাবনা ভুলে থাকার জন্য বেশি করে ছবি আঁকতে থাকেন। ১৯৬৯ সালেই একশ চল্লিশটি ক্যানভাসে চিত্রকর্ম অঙ্কন করেন।
১৯৭১ সালে তার নব্বইতম জন্মদিন বিশাল আয়োজনে বিশ্বব্যাপী পালিত হয়। শেষ বয়সেও তিনি ছবি আঁকলেন অনেক। সর্বদাই তিনি ব্যস্ত থাকতে চেয়েছেন। মৃত্যুভীতি তাকে ভেতরে ভেতরে দুর্বর করে দেয় অন্যদের মতো তবে তিনি ভেঙে পড়েননি। এসময় তিনি আত্মপ্রতিকৃতি আঁকেন অনেকগুলো। এর মধ্যে একটি অতি বিখ্যাত ‘পিকাসো ফেস উইথ ডেথ’।
জীবনের শেষ দিকে স্মৃতিবিভ্রমম ঘটতে থাকে। মাঝে মাঝে কৈশোরে চলে যান। চলে যান সেই বার্সিলোনায় বা মাদ্রিদে। পথে ঘুরে বেড়ান ভবঘুরের মতো। ক্ষণে ক্ষণে বাস্তবে ফিরে আসেন। তুলি চালান ক্যানভাসে। সম্পদ-সম্পত্তির কথা পুরো মনে নেই। উইলও ঠিক মতো করেননি। সন্তানরা তার দূরে দূরে। তাদের মায়ের কাছে অথবা অন্য কোথাও। নাতি-নাতনীরা মাঝে মাঝে তাকে দেখতে আসে, তিনি দেখা দেন না। একবার তার নাতি—পাওলোর পুত্র পাবলিতো তার বিখ্যাত দাদুকে দেখতে এসে গেট বন্ধ দেখে দেয়ালের ওপর উঠে উঁকি দেয়, ভেতর থেকে পোষা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে তাড়িয়ে দেয়। কুকুরের চিৎকার শুনে পুলিশ এসে তাকে ধরে ফেলে। পরে পরিচয় জেনে ছেড়ে দেয়। এই জীবন বড় কষ্টের! নিজে সারাটা জীবন শান্তি পাননি সন্তানদেরও দিতে পারেননি। এই বিশাল মাপের জীবনটা বিশাল দুঃখ বয়ে চলেছে। সারা জীবন বিরামহীন পরিশ্রম করে গেছেন পিকাসো—শুধু শিল্পবিকাশ ও উন্নতির জন্য। বেশিরভাগ সময় তিনি দৈনিক দশ-বারোঘণ্টা তিনি স্টুডিওতে কাজ করতেন। মাঝে মাঝে আরো বেশি সময়ও খাটতেন। শেষের দিকে তিনি বার্ধক্যের উপনীত হয়েও একটানা আঠারো ঘণ্টা করেও কাজ করেছন।
বিশ্বখ্যাত শিল্পী পাবলো পিকাসো ছোটবেলা কঞ্চিতার মৃত্যু দেখার পর থেকে মৃত্যুচিন্তায় ভয় পেতেন। কিন্তু জানতেন তার একদিন মৃত্যু হবে। তাই তিনি এঁকে গেছেন শেষ আত্মপ্রতিকৃতিতে।
অবশেষে পিকাসোর বিশাল এই দুঃখভার বওয়া জীবনের অবসান হয় ১৯৭৩ সালের ৮ এপ্রিল। সেদিন ভোর তিনটা পর্যন্ত তিনি ছবি এঁকেছেন। তার পর ঘুমিয়ে পড়েন। সকালে বিছানা থেকে নামতে কষ্ট বোধ হচ্ছিল দেখে জ্যাকুলিনকে নাম ধরে ডাকেন। এর দশ মিনিট পরেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার পাশে ছিলেন একমাত্র জ্যাকুলিন। তিনি পিকাসোর সেই দুর্গ ‘ভভেনার্গস’-এ তাকে সমাধিস্থ করেন জ্যাকুলিন।
পিকাসোর বিশাল জীবনে জ্যাকুলিনের উপস্থিতি ও অবদান সারা বিশ্বের মানুষের কাছে বিশেষভাবে মূল্যায়িত হয়।