আমি দাঁড়ালাম। এবং দেখলাম গালে হাত দিয়ে জমির আইলে আশিক বসে আছে।
আমি বললাম, তুই এখানে?
আশিক বলল, আমি তো এখানেই থাকি।
কী বলিস! তুই এখানে থাকিস! তুই এখানে থাকিস কেন?
এই প্রশ্ন যদি আমি তোকে করি? কী বলবি তুই? তুই এখানে কেন থাকিস?
আমি তো এখানে থাকি না।
তুই মিথ্যা বললি! তুই তো মিথ্যা বলিস না কখনো ! তোর এই মিথ্যা না-বলা গুণের জন্য তুই আমাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয়, সবচেয়ে বিশ্বস্ত তুই। তোর এই দেবতুল্য গুণের জন্য সবাই তোকে পছন্দ করত। তুই..!’
আশিক দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগল। কান্না একটু থাকিয়ে বলল, আমাদের এটুকুই ছিল। তোর এই সত্যটুকুই আমাদের ভেতরের শেষতম অবশিষ্ট। তুই সেটাও শেষ করে দিলি?
আমি কী বলব বুঝতে পারছি না। আমার কিছু মনে পড়ছে না। আমি মিথ্যা বলছি কি-না তাও বুঝতে পারছি না। আশিক কোনোদিন কাঁদে না। খুব শক্ত মনের মানুষ ও। আজ এভাবে কাঁদতে দেখে আমিও হতভম্ব হয়ে যাচ্ছি। আমি খুব করে সব কিছু মনে করার চেষ্টা করছি। আমি খুব করে চেষ্টা করছি আমার সকল অতীতকে মনে করতে। আমি খুব করে চেষ্টা করছি কোনো এক সময় আমার তুমুল জনপ্রিয়তার কথা। সত্য বলার জন্য জনপ্রিয়তা! আমার কাছে বিষয়টি হঠাৎ এক কৌতুকপ্রদ বিষয় হিসেবে মনে হতে থাকল। কিন্তু আশিক যেভাবে বলছে, যা বলছে, যে অভিব্যক্তি দেখা যাচ্ছে তার, তাতে একটুও কপটতা নেই। সুতরাং সে যদি সত্য হয়ে থাকে, তার কথাগুলোও সত্য হবে। কিন্তু আমি যে কিছু মনে করতে পারছি না।
তাহলে আশিকের কথাও তো সত্যই
আমি আবারো খুব বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়ে গেলাম। আশিকের কান্না আমাকে খুব বিচলিত করে তুলল। আশিকের কান্না আমাকে খুব অপরাধী করে তুলল। আশিকের কান্না আমাকে এতটাই স্পর্শ করল যে আমি মাথায় হাত দিয়ে কুয়াশামাখা দুর্বা ঘাসের ওপর বসে পড়লাম। আমি খুব বিপন্ন বোধ করতে লাগলাম। আমি খুব বিহ্বল বোধ করতে লাগলাম। আমি খুব বিষণ্ন বোধ করতে লাগলাম।
আমি আবারও আশিকের কথার সত্যতা খুঁজতে লাগলাম স্মৃতি থেকে। কিন্তু কিছুই মনে করতে পারছি না। আশিক বলছিল, আমি না-কি এখানে থাকি। কিন্তু প্রশ্ন হলো আমি এখানে থাকি কেন? প্রশ্ন হলো আমি এখানে এলাম কেন? আমি যদি এখানেই থাকি তাহলে আমি এভাবে থাকি কেন? আমি যদি এখানেই থাকি তাহলে এক একা থাকি কেন? আবার আমি যদি এখানেই না-ই থাকি তাহলে আশিকের সাথে এখানে দেখা হলো কেন? আমি যদি এখানে না-ই থাকি তাহলে আশিকই বা এ কথা বলল কেন? আমি জানি, যে সত্য কথা বলে, তার সাথেও অন্যরা সত্য কথাই বলে। যদি আশিকের কথা সত্য হয়ে থাকে যে, আমি সত্যই বলতাম সবসময়, তাহলে আশিকের কথাও তো সত্যই।
আমার ওভাবে বসে পড়া দেখে এবং এভাবে বিষণ্ন বোধ করা দেখে বোধ হয় আশিকের খুব মায়া হলো। সে কান্না থামিয়ে আস্তে আস্তে করে আমার দিকে আসতে লাগল। আমি মুখটা তুলে আশিকের আসতে থাকা দেখি। দীর্ঘদেহী আশিক খুব কষ্টে পা টেনে টেনে আমার দিকে আসছে। সে আসছে ধীরে ধীরে। আসুক। আস্তে আস্তেই আসুক। এসে শোনাক জীবনের এই আলো আঁধারীর সারসত্য। এসে শোনাক পৃথিবীর সকল জোনাকের জ্বলে যাওয়ার বৃত্তান্ত। এসে শোনাক পৃথিবীর সকল জোনাকের নিভে যাওয়ার বৃত্তান্ত। এসে শোনাক আমাকে, আমার এখানে থাকার বৃত্তান্ত। এসে শোনাক তার এখানে আসার বৃত্তান্ত।
কিন্তু আশিকের হাঁটা শেষ হচ্ছে না কেন? আমার এবং আশিকের দূরত্ব তো খুব বেশি নয়। আশিক যতক্ষণ ধরে হাঁটছে ততক্ষণে অনায়াসে আমার কাছে এসে পৌঁছা যায়। কিন্তু আশিকের হাঁটা তো শেষ হচ্ছে না!
আমি উঠে দাঁড়ালাম। দেখি, আশিক হাঁটছে ঠিকই কিন্তু এগুতে পারছে না। একই যায়গাতেই তার সকল পদক্ষেপ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আশিকের অভিব্যক্তি বলে দিচ্ছে এটাই তো স্বাভাবিক। তার মানে সে ভাবছে সে তো হাঁটছেই। কিন্তু আমি দেখছি সে হাঁটছে ঠিকই, কিন্তু তার সকল হাঁটা একই জায়গায় স্থির।
আমি উঠে দাঁড়ালাম সোজা হয়ে। আমার ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা ঢুকে পড়ল। কী হচ্ছে এসব! আশিক হাঁটছে কিন্তু আমার কাছে আসতে পারছে না কেন?
আমি লক্ষ করলাম আশিকের চোখে-মুখে এক উদ্বিগ্নতার ছাপ। তাকে খানিকটা উদ্ভ্রান্ত মনে হচ্ছে। আমার মনে পড়ল হঠাৎ, আমরা তো কথা বললাম একটু আগেই। প্রায় কাছাকাছি বসে। কখন আমাদের ভেতরে এত দূরত্ব তৈরি হয়ে গেল! এতই দূরত্ব তৈরি হলো যে, কথা বলার জন্য আশিককে হেঁটে এগিয়ে আসার জন্য উদ্যত হতে হলো?
আশিককে এখন ক্লান্ত মনে হচ্ছে। তাকে হাঁসফাঁস করতে দেখা যাচ্ছে। আমি ভাবলাম এখন আমারই এগিয়ে যাওয়া উচিত আশিকের দিকে। বেচারা বোধহয় কোনো এক রহস্যময় রোগে আক্রান্ত। এমন কোনো রোগ যা শুধু পা দুটি হাঁটার ভঙ্গি করে। কিন্তু এগুতে পারে না।
আমিও হাঁটতে উদ্যত হলাম। কিন্তু একি! আমিও তো হাঁটতে পারছি না। আশিককে তো হাঁটতে দেখা যাচ্ছে। যদিও সে হাঁটা আমাদের মধ্যকার দূরত্ব কমাতে পারছে না। কিন্তু আমি তো হাঁটতেই পারছি না।
এভাবে কিছুক্ষণ চেষ্টা ও নানা ধরনের কসরতের পর আমি হাঁটতে সক্ষম হলাম। আমি হাঁটতে শুরু করলাম। আশিকও হাঁটছে। কিছুক্ষণের ভেতরেই আমরা কাছাকাছি হতে পারব। এই আশা বুকের ভেতরে সুখের অনুভূতি জাগিয়ে তুলছে। কিন্তু এ কি! আমার অবস্থাও তো দেখি আশিকের মতোই। আমিও হাঁটছি কিন্তু এগোতে পারছি না। আমি আরও দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করলাম। তাতে যদি সুফল পাওয়া যায়। প্রথমে তো নড়াচড়াই করতে পারছিলাম না। একটু চেষ্টা করার পর নড়াচড়া করতে পারলাম। তারপর আরেকটু চেষ্টা করে হাঁটা শুরু করতে পারলাম। যদিও তাতে এগুতে পারছি না। সাফল্য অনুযায়ী আরেকটু চেষ্টা করলে তো প্রকৃত হাঁটতে শুরু করতে পারার কথা। আমি আরও শক্তি ও কসরত প্রয়োগ করে প্রকৃত হাঁটার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তাতেও কাজ হলো না।
একটুও সমস্যা হলো না আমার
কিছুক্ষণের ভেতরেই আমার ভেতরে অবসন্নতা ভর করতে লাগল। কিছুক্ষণের ভেতরেই আমার ভেতরে অবসাদ ভর করতে লাগলো। কিছুক্ষণের ভেতরেই আমার ভেতরেও বিষণ্নতা ভর করতে লাগল। কিছুক্ষণের ভেতরেই আমার ভেতরে মন খারাপ ভর করতে লাগল। আমি লক্ষ করলাম, এত কিছু ভর করার পরও আমার ভেতরে কোনো ক্লান্তি ভর করতে পারেনি।
কিন্তু আশিক আমার চোখের সামনে থেকে ক্রমশ অস্পষ্ট হতে থাকল। আমি চিৎকার দিতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু তাতে চোখ কান দিয়ে গরম ভাপ বের হতে থাকল। আমি দেখলাম ক্রমশ অস্পষ্ট হতে থাকা আশিককে সম্পূর্ণ অস্পষ্ট করে দিল কুয়াশা-ঝড়। এক প্রবল ঘূর্ণিসমেত কুয়াশার শাদা আস্তরণ প্রচণ্ড বেগে আছড়ে পড়তে লাগলো এই আশ্বিন কার্তিকের গভীর রাতে। এই কুয়াশার-ঝড় প্রথমে প্রবল রূপে আমার পায়ের পাতায় আঘাত করল। সেই আঘাত ক্রমেই ওপরের দিকে প্রবাহিত হতে থাকল। এবং যতই ওপরের দিকে প্রবাহিত হতে থাকল, ততই আমার পা দুটো লম্বা হতে থাকল। আমি কুয়াশার নিম্নস্তর অতিক্রম করে ওপরে উঠতে থাকলাম। আমার পা দুটো ক্রমেই লম্বা হতে থাকল। এভাবে কতক্ষণ জানি না। লম্বা হতে হতে আমি এত লম্বা হয়ে গেছি যে, এখন আমি ইচ্ছে করলেই মেঘ ছুঁতে পারি। কুয়াশা ঝড় থেমে গেছে। আমি লক্ষ করলাম আমি চলার চেষ্টা করছি না। স্থির দাঁড়িয়ে আছি। আমার ভেতরের সকল বিষণ্নতা কেটে গেছে। আমার ভেতরের সকল বিহ্বলতা কেটে গেছে। আমার ভেতরের সকল যন্ত্রণা এক অজ্ঞাত আক্ষেপে ভরে গেছে। কারণ আমি দেখতে পেলাম আমি এবং আশিক মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি। এখন ইচ্ছে করলেই আশিকের সাথে কথা বলা যায়। এখন ইচ্ছে করলেই আশিকের হাত ধরা যায়।
আশিকও খুব শান্ত হয়ে আছে। সেও কোনো প্রকার হাঁটার চেষ্টা করছে না। আমি হাতটা বাড়িয়ে দিলাম আশিকের দিকে। আশিকও হাতটা বাড়িয়ে দিলো। অমনি শরীরের ভেতরে প্রচণ্ড রকম যন্ত্রণা দিয়ে উঠল। এক বিকট শব্দ হলো। এবং আমি লক্ষ করলাম দুই পা লম্ব হতে থাকা আমরা দুজন মানুষই পড়ে গেছি। পড়ে গেছি অনেক দূরত্বে। আমার বুক ভিজে গেছে শিশিরের কণায়। আমি দেখলাম আশিকও পড়ে গেছে। দূরে বহুদূরে।
আমি আশিকের দিকে শুয়ে থেকে হাত বাড়ালাম। আমি জানি এত দূর থেকে আশিককে ছোঁয়া সম্ভব নয়। কিন্তু সম্ভব হলো। কিভাবে যে হলো, তা জানি না। আমি যখন আশিকের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিলাম তখনই হাতটা লম্বা হতে থাকল। লম্বা হতে হতে হতে এত লম্বা হয়ে গেল যে, বহুদূরে পড়ে থাকা আশিককে ছুঁতে একটুও সমস্যা হলো না আমার। দেখলাম আশিকও আমাকে ছোঁয়ার জন্য হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছে।
আমাদের নখে-নখে ছোঁয়াছুঁয়ি হলো। দেখলাম আমাদে হাত দুটো, হাতের আঙুলগুলো কাঠের হয়ে গেছে। সেই কাঠের ওপর বহু বছর আগের সূক্ষ্ম কারুকাজ।
আশিক বলল, সবগুলো সূক্ষ্ণ কারুকাজের ভেতরে মিহি আঙুলের রক্ত। তুই দেখতে পারছিস?
আমি কিছু বললাম না। চেয়ে থাকলাম শুধু।
মিথ্যামানব: চতুর্থ পর্ব ॥ এমরান কবির
মিথ্যামানব: তৃতীয় পর্ব ॥ এমরান কবির
মিথ্যামানব: দ্বিতীয় পর্ব ॥ এমরান কবির
মিথ্যামানব: প্রথম পর্ব ॥ এমরান কবির
চলবে…