ভোর। সোনালি সূর্য উঠছে আজ। দিন সাতেক হলো ঈশান চলে গেছে। নেভাদা কোস্ট ইউনিভার্সিটির স্পেশাল অটোমোবাইল ওয়ার্কশপে ঈশানের নিবিড় তত্ত্বাবধানে তৈরি হচ্ছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির টাইমমেশিন। প্রায় ১৫/২০ জন তুখোড় মেকানিক্যাল আর মেটালিক ইঞ্জিনিয়ার ঈশানের সঙ্গে দিনরাত কাজ করে যাচ্ছে। তারা সবাই খুব পরিশ্রম করছে আন্তরিকতার সঙ্গে। পৃথিবীর প্রথম টাইমমেশিন বানানোর সঙ্গে তারা যুক্ত থাকতে চায়। এটা তাদের জন্য ভীষণ গর্বের। যদি নামকরা সাইন্টিস্ট রূপকথা রাজকন্যার থিওরি অ্যাপ্লাই করে সত্যি কোনোদিন টাইমমেশিনে ভ্রমণ করা সম্ভব হয়, তবে তাদের নামও ইতিহাসে লেখা হয়ে যাবে সোনার অক্ষরে। কে না চায় এমন এক সৃষ্টির সঙ্গে যুক্ত হতে। এদিকে, নিজের দেশের ল্যাবরেটরিতে ঘুম-খাওয়া বাদ দিয়ে রূপকথা রাজকন্যা নিবিষ্ট মনে থিওরির প্র্যাকটিক্যাল কার্যকারিতা নিরীক্ষা করে চলছে। সেদিনের পর থেকে চন্দ্রকথা রাজকন্যারও খানিকটা ভাবান্তর দেখা যাচ্ছে। সে দিদির সব কিছুতেই বেশ আগ্রহ নিয়ে সাহায্য করছে। ফাঁকে ফোঁকরে অবশ্য ঈশান তাকে ফোন করে। কেমন আছে। কী করছে এসব কথাবার্তা হয়। মাঝে মাঝে দু’জনের বেশ জমানো আড্ডা হয় রূপকথা এটা বুঝতে পারে। মা’ও খুব একটা আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন। কিছুদিন ধরে অবশ্য তার মন ভালো নেই। কোথাও এক গভীর শূন্যতা মা’র চিরদিনের সঙ্গী। গতরাত থেকে তা আরও ঘনিষ্ট হয়ে জড়িয়ে ধরেছে তাকে বোঝা যায়। তবু কেনযেন মা খুশি। রূপকথার জন্য ঝুমুর চা নিয়ে আসছিল।
মা সরো তো। চা পরে আনো। স্যার এসেছেন। তাকে নিয়ে আসি। একসাথে চা খাব।
হন্তদন্ত হয়ে বের হয় রূপকথা বাড়ির সদর দরজায়। স্যারের গাড়ি ঢুকেছে মাত্র। ৮৪/৮৫ বছরের যেন এক রূপকথার রাজপুত্র নেমে আসেন গাড়ি থেকে। মাথার সব চুল সাদা। লম্বা দাড়ি ঝুলে পড়েছে বুকের নিচ পর্যন্ত। হাতে একটা সিগরেটের ইয়া মোটা স্টিক ধরা। তাতে জ্বলছে নিভছে মৃদু আগুন। ভারী ফ্রেমের চশমা চোখে। বেশ সোজা হয়ে হাঁটছেন তিনি। বয়সের ছাপ বোঝা যায় তার কাছে গেলে। কপালের বলিরেখা কিংবা চশমায় লুকানো চোখের নিচে চামড়ার শিথিলতাই কেবল জানান দেয় তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন। ঝুমুরের সঙ্গে বেশ কয়েকবার টেলিফোনে কথা হয়েছে তার। আর চন্দ্রকথাও জানে তার দিদির গুরুর কথা। কিন্তু আজ নিজের চোখে প্রথম দেখল। দিদি পায়ে ধরে গুরুকে সালাম করল। ঝুমুরও এগিয়ে গেল।
ভালো আছেন তো?
হুম। আপনি ভালো তো?
হেসে ফেললেন গুরু, পৃথিবীবিখ্যাত সাইন্টিস্ট এ জেড আকবর খান।
ওয়াও। মুগ্ধ হয়ে গেলাম রে দিদি। কি সুন্দর হাসি। কি ম্যানলি রে বাবা এই বয়সে। অসাধারণ দিদি তোর গুরু। আহা কেন যে তার ইয়াং বয়সে আমার সাথে দেখা হলো না রে দিদি।
এসব কথা চন্দ্রকথা দিদির কানের কাছে আস্তে আস্তে বলছিল। দিদিটা যে কি ফাজিল। গুরুর হাত ধরে ভেতরে নিয়ে আসতে আসতে ওর কথাগুলো ফাঁস করে দিয়ে বলে উঠল,
কেন এই বয়সে সমস্যা কি? স্যার তো এখনো যথেষ্ট ইয়াং।
আকবর খান হাসছেন। অবাক হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। যেন এ ধরনের কথা তিনি প্রায়ই শোনেন। আর নিজের ওপর যেন অগাধ আস্থা। তার অবস্থা দেখে চন্দ্রও লজ্জা টজ্জা ভুলে গেল। তিনি এবার মুখ খুললেন,
আপনি বোধ করি ছোড়দি। আমার রূপকথার ছোটবোন? যদি আমার অনুমান ভুল না হয়।
জ্বি জ্বি আমি চন্দ্রকথা।
কিন্তু ছোড়দি আপনি তো এসব বিশ্বাস করেন না। আমি আমরা, রূপকথার দিকে তাকিয়ে বলছেন, বিশ্বাস করি পৃথিবীতে মানুষের যত যত কল্পনা তা একদিন না একদিন আমরাই সত্যি করে ছাড়ব। তবে আপনার সাথে তো ইয়ং বয়সে আরও মিলতো না। আমি থাকতাম আমার গবেষণা নিয়ে আর আপনি আমার সব নস্যাৎ করতে ব্যস্ত থাকতেন। কী বলেন?
সবাই একযোগে হেসে ওঠে।
চলো রূপ তোমার ল্যাবরেটরিতে নিয়ে চলো।
খুব দ্রুতই প্রসঙ্গ পাল্টান গুরু। কাজের কথায় চলে যান।
চলবে…