ঈশান এসে উঠে গেল রূপকথাদের বাসায়। ঝুমুর খুব খুশি ঈশানকে পেয়ে। অদ্ভুত এক মা চন্দ্রের। সবকিছুতেই অগাধ আস্থা আর উৎসাহ তার। অন্য মায়েদের মতো কোনোকাজে পিছুটান নেই। বিশেষ করে দিদির টাইমমেশিন বানানো নিয়ে তো তার নিশ্চিত বিশ্বাস। মা-ই দিদিকে এমন আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে। মা তো সবসময় বলে, এটা নাকি সম্ভব। বিকেলে চায়ের টেবিলে বসে সেকি আনন্দ ঈশান দিদি আর মায়ের। মা ই শুরু করল,
তাহলে ঈশান, মেটাল সিলেক্ট হয়ে গেল?
জি আন্টি। ম্যামের পছন্দ হয়েছে। এখন শুধু একটু ম্যামের গুরু জেড এ আকবর খানকে একবার দেখিয়ে নিতে চান তিনি। আমারও মনে হচ্ছে এই ধাতব উপাদানগুলোই টাইমমেশিনের জন্য সবচেয়ে উপযোগী হবে।
কিছু মেটালের নমুনা বের করে দেখায় ঈশান। দিদির মুখে কোনো কথা নেই কিন্তু এমনভাবে মেটালগুলো স্পর্শ করে দেখছে যেন হীরে পান্না দেখছে গয়না বানানোর জন্য। মাও।
দেখি দেখি আমাকে একটু দাওতো।
ঈশান হাত বাড়িয়ে মেটালগুলো মায়ের হাতে দেয়। মা-ও এগুলো খুব যত্ন করে দেখে।
বাহ। দারুণ হবে।
মা যে কি বুঝলো তা চন্দ্র বুঝতে পারে না। চায়ের কেটলিতে চা ঢালতে ঢালতে প্রশ্ন করে চন্দ্রকথা,
আচ্ছা এই মেটালগুলো কী মিন করে রে দিদি?
চন্দ্রকথার কণ্ঠে একটু তাচ্ছিল্যের সুর।
একবার রূপকথার দিকে তাকিয়ে ঈশান বুঝতে পারে ছোটবোনের এই প্রশ্নের উত্তর দেবেন না রূপকথা ম্যাম। তাই সেই বলতে শুরু করে,
আমি বলছি। বর্তমান কিংবা ভবিষ্যতে ভ্রমণের জন্য সুদিং অর্থাৎ আরামদায়ক মেটাল নির্বাচনটা খুব জরুরি।
সবাই মিলে যেন চন্দ্রকথার অবিশ্বাস আর সন্দেহকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে। মা সঙ্গে যোগ করে,
চন্দ্র মনে রেখো টাইমমেশিন তৈরি হবেই।
চন্দ্রও চটজলদি উত্তর দেয়,
হ্যাঁ মা। তুমিতো দেখছি দিদির চেয়েও কম যাও না। আমিও নিশ্চিত টাইমমেশিন তৈরি হবেই। কিন্তু তাতে ভ্রমণ করা যাবে তো?
রূপকথা অনেক্ষণ পর মুখ খোলে,
চন্দ্র মনে রাখিস, তোকে কিন্তু নেব না তখন। মনে পড়ে ছোটবেলায় আমার সঙ্গে টাইমমেশিনে যাওয়ার জন্য…
রূপকথার কথা শেষ হওয়ার আগেই চন্দ্রকথা উত্তর দেয়,
হুম। না বুঝে মানুষ কত কি করে।
ঈশান একটু নড়েচড়ে বসে। প্রসঙ্গ বদলায়,
আন্টি আসুন। টাইমমেশিন ছাড়াই আমরা একটু অতীতের সঙ্গে যোগাযোগ করি। বলা যায় না সেটা ভবিষ্যৎ হয়েও ধরা দিতে পারে। আমাদের সবার ভবিষ্যৎ।
ঝুমুর বাচ্চাদের মতো উৎসুক হয়ে পড়ে,
কী করে? কিভাবে?
মানে, এই পৃথিবীতে যতদিন জীবিত আছি আমরা ততদিন পর্যন্ত আমাদের সর্বশেষ ভবিষ্যত হলো মৃত্যু। যারা আত্মা আছেন, তারা আমাদের থেকে ভবিষ্যতে এগিয়ে আছেন। তাদের কাছ থেকে কোনো বিশেষ কিছু আদেশ কিংবা নির্দেশ কিংবা ইঙ্গিত তো আমরা পেতে পারি। কী বলেন আন্টি?
হুম।
রূপকথা হাসে। চন্দ্রর রাগ হয়। মা টা যে কী। চিরকাল একই রয়ে গেল। কোনো চেইঞ্জ নেই। ৬২ বছর বয়সে জীবনের এত এত চড়াই উৎড়াই পার হয়েও এত কষ্ট এত হতাশার মধ্যে বাস করেও সদা হাস্যমুখ। সদা প্রফুল্ল। মায়ের বয়স যেন বাড়েই না। চন্দ্রর চোখে মা এক স্থগিত যৌবনা। কিভাবে যে রূপকথা আর চন্দ্রকথাকে প্রত্যাশার আলোকদীপে উজ্জ্বল করে রেখেছেন। এ এক রহস্য। মা খুব একা ছিলেন। সত্যিকার অর্থে মনের সেই গহন জায়গাটিতে কেউ বসতে পারেনি আর কোনোদিন। শুধু এক রহস্যময় প্রেরণা মাকে কখনো কখনো খুব আনন্দিত করত। কাজে গতি দিত। মা তখন খুব লিখত। খুব উজ্জ্বল দেখাত মায়ের মুখ। আবার কোনো কোনোদিন এমন ভীষণ অন্ধকার তার মুখ জুড়ে থাকত, চন্দ্র মায়ের সে মুখের দিকে তাকাতে পারত না। খানিকটা নষ্টালজিক হয়ে পড়ে চন্দ্র। চিন্তার রেখাটা ছিঁড়ে দিয়ে ঈশান কথা বলে ওঠে,
আন্টি আমার একটা প্রমাণ সাইজের আয়না, এক বোতল ডেটল কিছু সুগন্ধি, সেটা ধুপ কিংবা কর্পূর হলে ভালো হয় আর একটা নির্জন ঘর দরকার।
মা অনুমতি দিয়ে দেয়।
আমার স্টাডিরুম?
ওকে। রাত ১২টা।
দিদির যেন আজ খোলস ভেঙেছে। অন্যরূপ তার। সারাক্ষণ ভাবনায় ডুবে থাকা, অতি উচ্ছ্বলতা পরিহার করা সাদা শতর্ক প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন দিদি আজ খানিকটা প্রফুল্ল। এ কি তার প্রত্যাশিত টাইমমেশিন প্রকল্প সফল হওয়ার দ্বারপ্রান্তে, সে জন্য!
চলবে…