কবিতা কী? কবির কাজ কী?—দুটি প্রশ্ন পাঠকের মাথায় খেলা করে। পলিয়ার ওয়াহিদের ‘সিদ্ধ ধানের ওম’ কাব্যগ্রন্থ হাতে নিয়ে আমিও এ দুটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজি। কবিতায় কী-কী গুণ থাকতে হবে, তা জরুরি নয়—হয়ে ওঠাই জরুরি। আমি কবিতা পেলে চিহ্ন খুঁজি। এই চিহ্ন দর্শনের নয়। এটি কবিতার শনাক্তি চিহ্ন। এবার ‘সিদ্ধ ধানের ওম’ কাব্যগ্রন্থে প্রবেশ করা যাক।
২.
‘সিদ্ধ ধানের ওম’ কাব্যগ্রন্থটি ভিন্ন-ভিন্ন পরিচ্ছেদে বিভক্ত। ‘কাছের মানুষ লেপটানো সিদুঁরে মখমল’ প্রথম পরিচ্ছেদ। এতে আছে ‘মা ও অন্যান্য শীতল পাটি’, ‘নারকেল পাতার চশমা’ শিরোনামে দুটি দীর্ঘকবিতা। কাব্যগ্রন্থটির চারভাগের তিনভাগ জীবনীর জীবনী। কবি তার মাকে নিয়ে লেখা কবিতার শিরোনাম ‘মা ও অন্যান্য শীতল পাটি’। এ কবিতায় লিখেছেন—‘সংসার পাগলা গঙ্গাঋদ্ধি বয়াংসি মুনির মেয়ে—ঘনকালো মেঘের মতো লম্বা দীঘল চুল। পিঠজুড়ে প্রাচীন যুগের পাহাড়ি দেয়াল—যেন ঝর্ণার আঁধার!’
কবি বয়সে তরুণ হলেও বোধে ভাবনায় পরিণত। এ সময়ে কবিতায় যে দার্শনিকতা, নান্দনিকতার উপস্থিতি লক্ষ করা যায়, তা পলিয়ার ওয়াহিদের কবিতায় চিত্রকল্প উপমা সহযোগে চিত্রিত হয়েছে। ‘পিঠজুড়ে প্রাচীন যুগের পাহাড়ি দেয়াল—যেন ঝর্ণার আঁধার!’ মাকে নিয়ে এ রকম উপমাশ্রয়ী চিত্রকল্প অভিনব, অসাধারণ। চুলের বিছানো সৌন্দের্য্যের সঙ্গে ‘পাহাড়ি দেয়াল’ ও ‘ঝর্ণার আঁধার’ পাঠককে ‘একটা কিছু হয়েছে’-ভাবনায় দাঁড় করিয়ে দেয়।
‘একটা বুনো ময়না—মৎস্য প্রজাতির কালবাউশ—মসৃণ কালো শরীর/ কলাম তো—ছন্নছাড়ার একশেষ—তবু আমার শামুক স্বভাব’
কবি নিজেকে নিয়ে এই যে হিউমার ছড়ানো লাইন লিখেছেন, তাতে তার মুন্সিয়ানা ধরা পড়ে। কালবাউশ, শামুক স্বভাব, ছন্নছড়ার একশেষ—এ শব্দগুলোর ব্যবহার স্বতন্ত্র এবং অন্যরকম। এরপর ‘নারকেল পাতার চশমা’ কবিতায় লিখেছেন, ‘মানুষ এক অসাধারণ নিরুপায়—শিকারীর তাড়া /যারা শুধু থেকে যায় চিরকাল শিল্পের কারিগর।’
যেসব পাঠক কবিতায় আবেগের তারল্য এড়িয়ে চলতে চান, দর্শন খুঁজতে চান—বোধে ভাবনায় জীবনের সারাংশের শিল্পরূপ খুঁজতে চান, তারা পলিয়ার ওয়াহিদের কবিতায় কল্পনা ও প্রজ্ঞার যোগসুত্রে মেজর কবিতা খুঁজে পাবেন।
৩.
‘সিদ্ধ ধানের ওম’ কাব্যগন্থে ‘টইটই করা অবাধ্য মোরগের ঝুঁটি’ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। এতে ‘মনোহরনগর’, ‘পিতার শোকে’ দুটি কবিতা গ্রন্থিত হয়েছে। রুমিচা বেগম কবির দাদী। ‘মনোহরনগর’ কবিতায় লিখেছেন—
ও রুমিচা বেগম
অই আকাশের কছম
এই শহর ফিরে যাবে
ঐ মধুনগর।
কবি আশা করেন, নগরে কুটিল রাজনীতি শেষে গাঁয়ে ফেরার। তার ভেতরে জেগে থাকে জাইলেদের বটতলা, ভাটিপূজা, নাভি-গন্ধী মাছের নিশ্বাস, শীত কুয়াশা, বাঁশবন হুতুম পেঁচা, বুজফলের কাঁটা। পলিয়ার ওয়াহিদ মনোহরনগর কবিতায় যে গ্রামের বর্ণনা দিয়েছেন, তা প্রকরণে আধুনিক। তার কবিতা পড়ে জীবনানন্দীয় গন্ধ পাওয়া যায় এবং বাংলার ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রকৃতির সৌন্দর্য উজ্জ্বলভাবে উঠে আসে। বুজফলের কাঁটা যশোরের আঞ্চলিক শব্দ। কবি কবিতায় তা সফলভাবে ব্যবহার করেছেন। তবে আঞ্চলিক শব্দের নোট দিলে পাঠকের বুঝতে সুবিধা হতো।
‘পিতার শোকে’ কবিতাটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা- কবিতাটি অন্যরকম। যারা জাতির জনককে নিয়ে পুঁজিবাদের দোকান খুলে বসেছে, কবি তাদের ধীক্কার জানান। কবি বক্রোক্তিতে প্রশ্ন করেন, পিতা বা স্বামী তোমরা কি শুনতে পাও /এইসব বিকল মাইকের গান?’
তবে কবিতাটির কিছু-কিছু পংক্তিতে কবি খেই হারিয়ে ফেলেছেন। বলার ভঙ্গি, উপস্থাপনের কৌশল নবিসি দুর্বলতাকে ছাড়িয়ে পারেনি।
৪.
‘সিদ্ধ ধানের ওম’ কাব্যগ্রন্থে ‘জীবন এক অলিখিত সুরের সঙ্গীত’ তৃতীয় পরিচ্ছেদ। এতে আছে ‘সিন্ধুক হারানো চাবি’ ও ‘পরাবাস্তব প্রেমের নকশা’ নামে দুটি কবিতা।
আকতা কোথায় নিশি পাখি ডেকে ওঠে
শরীরের লোমকুপে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে
…
কিন্ত যেন তুর পাহাড় পেরিয়ে এলাম
তুমি আল্লাহওয়ালী আমি মাংসের লাঠিতে বীর্যময় মুছা!
(সিন্ধুক হারানো চাবি)
তুর পাহাড় একটি ইসলামি মিথ। কবিতায় পুরাণের ব্যবহার সতর্কতার সঙ্গে করতে হয়। এতে কবি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। ‘তুমি আল্লাহওয়ালী আমি মাংসের লাঠিতে বীর্যময় মুছা!’—লাইনটি জোর করেই বানানো। শরীরী সম্পর্কের বিষয়ে এই উক্তি যর্থাথ হয়নি। লিঙ্গ কখনো বীর্যময় মুছা হতে পারে না। তবে কবি যদি লেখার স্বাধীনতার প্রশ্ন তোলেন, তাতেও উক্তিটি নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্টভাবে উপস্থাপনে ব্যর্থ হয়েছেন কবি। ‘পরাবাস্তব প্রেমের নকশা’ কবিতায় কবি লিখেছেন—
ভাবছি অগ্রহণযোগ্যতার আঁচল ধরে
জীবন ক্ষেপণ না করে—
নিষ্ঠার সঙ্গে মরে যাওয়া শুরু করব!
কবিতাটি একটু ভিন্ন রকম। কবিতার বিষয়বস্তু বাস্তবতা থেকে অতি বাস্তবতার দিকে অথবা যাদুবাস্তবতার দিকে বাঁক নিয়েছে। তবে, এই কবিতাটি পাঠকের মনে ভিন্নমাত্রায় দোলা দেবে।
৫.
‘বালিকা লাবণ্যে আঁকা বিনীত ক্ষত’—চতুর্থ পরিচ্ছেদ। এতে আছে দুটি কবিতা। ‘অযোদ্ধা’ ও ‘রত্নাদি’। অযোদ্ধা কবিতাটি শুরু হয়েছে এভাবে—‘তুমুল মেতেছে উঠে পরিখা খনন দিন’। শেষ হয়েছে ‘ধর্ম ছাড়তে ছাড়তে আমরা দেখব অরক্ষিত তেতুলের বাগান’। কবিতাটির নায়িকা তাসনুভা অরিণের ভেতর দিয়ে নারী জাতিকে ছোট করেছেন তিনি। অবহেলা, তুচ্ছের বিষয় হিসেবে তুলে ধরেছেন নারীকে। কবি কৌশলে শফি হুজুরের তেতুল তত্ত্বে ফিরে গেছেন। ‘ধর্ম’ বিশ্বাসেরই আরেক নাম। কবিতায় ধর্মের ব্যবহার না করাই বাঞ্ছনীয়। কবি এ কবিতায় কখনো আস্তিক, কখনো নাস্তিক, কখনো সংশয়বাদী, কখনো স্বেচ্চাচারী। ‘রত্নাদি’ কবিতাটি প্রণয় হারানো এক কবির স্মৃতিকাতরতা। যা টি টির কবিতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
ঝিনুকের মতো গুটি গুটি হেঁটে
ফের আমাকে পাবে
একবার হলেও দিঘিচোখে চাও
বুঝবে জানি এ হৃদয়ের ভাষা।
(রত্নাদি)
৬.
‘সিদ্ধ ধানের ওম’ কাব্যগ্রন্থের শেষ পরিচ্ছেদ ‘সংসার কবিতার শহর, যাপনে স্নেহের পিরান’। এতে আছে তিনটি কবিতা। ‘রাঙ্গামরিয়মের সাদা চুলের বয়ান’ কবিতাটি গদ্য হতে পারে, ভালো কবিতা হয়ে ওঠেনি। তবে, বয়সী মরিয়মের বয়ানে দেশভাগ, স্বামীর মৃত্যু, জীবনযুদ্ধ, বেঁচে থাকার যন্ত্রণা ভালোভাবে ফুটে উঠেছে ।
‘হলুদ সবুরন্নেছার বাদামী চুলের বয়ান’ কবিতাটি কবির নানীকে নিয়ে লেখা। কবিতাটিতে একজন বালিকার বধূ হয়ে ওঠা এবং ভালো স্বামীর ভালোবাসা পাওয়ার কাহিনি বর্ণিত হয়েছে।
‘উত্তর প্রদেশীয় বেলি/ হিয়া বিশ্বাস, কলিকাতা, ভালোবাসা কেন এতো কইতরময়?’—টানাগদ্যে রচিত অসাধারণ কবিতা। চিত্রকল্প, উপমা, বাক্যে-শব্দে পরিপূর্ণ।
‘খোলশ ছেড়ে দিলে তোমার মোমের মতো শরীর; এই ভয়ে শামুকের মতো কুঁকড়ে যাই।’ উপমা দুটি নিছক উপমা নয় বোধের জগতও।
‘আমাকে ছিঁড়ে নিও—সেও ভালো কিন্তু ক্রেতার পাল্লায় তুলো না গো আমার প্রেম!’—অন্যরকম অনুভূতি। পুঁজির বাজারে কবি প্রেমকে পণ্যের বাইরে রাখতে চান। যেভাবে তিনি তাঁর কবিতাকে সাধনার জগতে আলাদা করে রাখেন । ‘সিদ্ধ ধানের ওম’ কাব্যগ্রন্থে একজন কবি হয়ে ওঠা তরুণের সন্ধান মেলে। যা প্রচারকাঙাল তরুণ কবিদের চেয়ে জাতে আলাদা। এ কবির কবিতা পাঠে পাঠক ভিন্ন স্বাদ খুঁজে পাবেন—এতে কোনো সন্দেহ নেই।