রূপান্তরিত সাপটি আমার বাম হাতের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার বাম হাতের আয়ু রেখার ওপরে যে ছোট্ট বিন্দু জল আছে, আমি সেখানে চুমু দেব। আমি বললাম, কেন? কেন চুমু দেবে তুমি? সাপ কখনো চুমু দিতে পারে! সাপ ছোবল দিতে জানে। চুমু দিতে জানে না। সে বলল, তুমি ভুল বলছ। তুমি ভুল দেখছ। তোমার শোধরানো দরকার।
আমি কী ভুল বলছি? আমি কী ভুল দেখছি?
প্রথম ভুল করেছ প্রশ্নগুলো করে। আমি চুমু দিতে চেয়েছি। তুমি প্রশ্ন করেছ কেন? কেন চুমু দেয় তুমি জানো না? যেহেতু জানো তাহলে নতুন করে প্রশ্ন করলে কেন? আমাকে সাপদ বলেছ। এটাও ভুল। বলেছ সাপ কখনো চুমু দিতে পারে? বলেছ সাপ ছোবল দিতে জানে, চুমু দিতে জানে না। এটাও ভুল। তোমার ভুলগুলো ব্যাখ্যা করি এখন। আমি সাপ নই। জেনে রেখো, যা দেখা যায় এটাই কারও আসল রূপ নয়। যা দেখা যায় তাও সবসবময় বিশ্বস্ত নয়। তোমাকে যা দেখা যাচ্ছে সেটা যেমন তোমার আসল রূপ নয়, তেমনি আমাকে যা দেখা যাচ্ছে, সেটাও আমার আসল রূপ নয়। আর জেনে রেখো, সাপ শুধু ছোবলই দিতে জানে না। চুমুও দিতে জানে।
কিন্তু যা দেখা যায়, প্রাথমিকভাবে এবং সর্বোতভাবে সেই রূপকেই আমরা প্রথম বিবেচনায় রাখি। এটা সামনে রেখেই আমরা তার সম্বন্ধে ধারণা পোষণ করি। গোপন কাঠামোর দিকে আমরা পরে যাই। কিন্তু এ কথাও তো ঠিক বাহ্যিক কাঠামোর নিরিখে গোপন কাঠামোর বৈশিষ্ট্যগুলো বের হয়ে আসে।
এত রক্ত! এত রক্ত কেন
আমার কথা শুনে সাপটি হেসে উঠল। সেই রিনিঝিনি হাসি। এই হাসি আরও প্রাণবন্ত। এই হাসি আরো মাদকতাপূর্ণ। এই হাসি আরও বিচ্ছূরিত। এই হাসি আরও অনুভূতিময়। এতদিন আমার ধারণা ছিল সাপ হাসলে সেটা বড়জোর হিসহিস শব্দ হবে। ভীতিকর এক পরিবেশ সৃষ্টি হবে। কিন্তু এই শাপের হাসি আমাকে আবারও নিয়ে গেল একটি শান্ত নদীর কিনারে। যে-নদীর স্রোত আছে, গর্জন নেই। খুব সহজ সরল তার গতিপথ। যেখানে একটু বাধা পাচ্ছে সেখানেই জলগুলো গুনগুন করে গাইছে গান। পাড়ভাঙা পলিমাটি থেকে সুবাস ছড়াচ্ছে। নদীর পাড় ক্রমশ উঁচু হয়ে চলে যাচ্ছে লোকালয়ের দিকে। জলের খুব নিকট থেকে নদীটিকে পেছনে রেখে পাড়ের দিকে তাকালে সবুজ ঘাস দেখা যায়। কাশের বন দেখা যায়। আরও দূরে তাকালে খানিকটা রুক্ষ রূপ ধরা পড়ে। তার ওপরে দেখা যায় একটি আঁচল মাটি ছুঁয়ে-ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে কিনারা বেয়ে বেয়ে। সেই ধীর ছন্দের দিকে তাকালে নদীর কুলকুল গানটি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আঁচলটি ধীরে-ধীরে চলে যায় দূরে। এক সময় অদৃশ্য হয়ে যায়। তখন নদীর তরঙ্গের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে। তখন নদী ডেকে ওঠে। তখন নদীর স্রোতে ডাক দেয়, এসো তবে এখানে। আমারও আছে পাতাবাহিত সবুজ সংসার। তখন দূরে কোথাও বিকট শব্দ হয়। তখন দূরে কোথাও কান্নার শব্দ হয়। তখন দূরে কোথাও নারীকণ্ঠের আর্ত চিৎকার ভেসে আসে। তখন কোত্থেকে এক ধুলিঝড় এসে ভেঙে দেয় নির্মল পরিবেশটি। এত ধুলো জগৎময়! এত বালিয়াড়ি! চোখের ভেতরে লক্ষকোটি ধুলিকণা ঢুকে পড়ে। এক টুকরো নির্মল কাপড়ের জন্য হাহাকার করে ওঠে চোখ। ধুলিঝড়ও থেমে যায়। নদীতে ঢেউ ওঠে আগের মতোই। কুলুকুলু ধ্বনিও জেগে ওঠে। কিন্তু চোখ খোলা যায় না। চোখের ভেতরে লক্ষকোটি ধুলো ঢুকে পড়েছে। খুব কষ্ট করে একটু একটু করে চোখ খুলে দেখি সামনেই পড়ে আছে ধবধবে পরিষ্কার একটি কাপড়। শাড়ির আঁচল বুঝি! হ্যাঁ। তাই তো। এত ধুলোর ভেতরেও কি নির্মল! ওটা তুলে নিয়ে চোখ পরিষ্কার করতে গিয়েই আবিষ্কার করলাম এটাতে ধুলি নেই, কিন্তু রক্তে ভেজা। চোখ পরিষ্কার করতে গিয়ে মুখটাই রক্তে ভিজে গেল! ধুলি-চোখে দেখা যায়নি তার রক্তাক্ত প্রান্তর। খালি চোখেও কি দেখা যেত!
আমি তখন চিৎকার দিয়ে উঠলাম, এত রক্ত! এত রক্ত কেন?
আমার চিৎকার মিলিয়ে যাওয়ার আগেই নদীর পাড়ের উঁচু ঢাল থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে একটি নারী শরীর এসে থেমে গেল। বিবস্ত্র। রক্তে ভেজা। শরীরে অসংখ্যা দাঁতের দাগ।
আমি আবারও চিৎকার দিয়ে উঠলাম, এত রক্ত! এত রক্ত কেন?
বিবস্ত্র নারীর ঠোঁট নড়ে উঠল ভয়ঙ্কররূপে। বলল, এখানে রক্ত কোথায়। এগুলো তো আনন্দ।
আমি দেখলাম নিস্প্রাণ এই দেহ। নিস্প্রাণ এই মুখ। কিন্তু কি ভয়ঙ্করভাবেই না আমার কানে ভেসে এলো, এখানে রক্ত কোথায়। এগুলো তো আনন্দ।
আমি আবারও চিৎকার দিয়ে বললাম, আমার চোখে জগতের সব ধুলিকণা ঢুকে পড়ুক। আমি কিছু দেখতে চাই না। আমার চোখ অন্ধ হয়ে যাক। ধুলিঝড় আমাকে নিক্ষেপ করুক নদীর গভীরে, স্রোতের গভীরে।
জগতের সব কিছুই বিভাজ্য
আমি চোখ বন্ধ করে বসে পড়লাম। নদীর স্রোতে থেকে বুঝি কথা ভেসে এলো, আমাদের পাতাবাহিত সবুজ সংসার। এখানে বকুলের সুবাস আছে। রক্তের গন্ধ নেই!
সাপের হাসি থামছে না। বেড়েই চলছে। সেই রিনিঝিনি শব্দের ভেতর থেকেই ভেসে এলো নূপুরের শব্দ। প্রথমে ধীর লয়ে। যেন কোনো তরুণী হেঁটে আসছে ধীরে ধীরে। তারপর সে-শব্দ একটু দ্রুত লয়ে বাজতে থাকল। তারপর ছন্দবন্ধ। তারপর শত-সহস্র কাচের চুড়ির শব্দ। শেষ হেমন্তের কুয়াশা বুঝি আরো শাদা-অন্ধকারে আচ্ছন্ন করে দিল চারপাশ! আরও বেশি আবছা হয়ে এলো যে! তারপর আরো অন্ধকার! তারপর হঠাৎ অনেক আলোর ঝলকানি। সে-ঝলকানিতে স্পষ্ট হয়ে এলো তিন নারীর শরীরী মুদ্রা।
তারা অবিরাম নেচে যাচ্ছে। তাদের শরীরভর্তি হাজারও সোনা-দানা-হীরা-জহরত। এগুলোই তাদের শরীরকে আড়াল করে রেখেছে তাদের প্রাকৃতিক অবয়ব। সে-সোনা-দানা-হীরা-জহরত মাঝে মাঝে চলে যাচ্ছে মঞ্চের ওপারে। তখন তাদের শরীরকে আড়াল করার কিছু থাকছে না। তাতে তারা কিছু মনেও করছে না। তারা একটুও বিব্রত হচ্ছে না। তারা নিশ্চিন্ত মনে নেচে যাচ্ছে। এভাবে কতক্ষণ কে জানে। এক সময় তারা তিনজন এক সারিতে দাঁড়ালো। এক সময় দেখা গেল তারা একজন হয়ে গেল। সেই একজন বলল, দেখলে তো, জগতের সব কিছুই বিভাজ্য।
আমি কিছু বলতে যাওয়ার আগেই অদৃশ্য হয়ে গেল সে অথবা তারা। তীব্র আলোর ঝলকানিও নিষ্প্রভ হয়ে শেষ হেমন্তের মধ্যরাতের কুয়াশামাখা চাঁদের আলো ফুটে উঠল। আমি দেখলাম সাপের চোখ থেকে বের হওয়া আলোটিই এত ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়েছিল। সে-আলো ধীরে-ধীরে সাপের চোখে লীন হয়ে গেল।
সাপ বলল, দেখলে তো সব দৃশ্যই থাকে। থাকে না শুধু আলো। আলোর গুনেই সবকিছু দৃশ্যমান।
অন্ধকার কেটে যেতে থাকল
আমি বললাম, আলো যদি কৃত্রিম হয় তাহলে প্রকৃত দৃশ্যের রং তো বদলে যায়। তাহলে আলোর রঙ-ই কি সব? দৃশ্যের কোনো মাহাত্ম্য থাকে না এখানে?
একথা বলাতে সাপ বুঝি খুব রেগে গেল। একটা শোঁ শোঁ শব্দ কানে এলো শুধু। তারপর কালো-কালো অন্ধকারে ছেয়ে গেল চারপাশ। কুয়াশার সাদা অন্ধকার নিমিষেই কালো রূপ ধারণ করল। কুয়াশার কণাগুলো হিম-হিম বরফের মতো ঠাণ্ডা। সেগুলো এসে আমাকে প্রচণ্ডরূপে আঘাত করতে থাকল।
আমি সেই অন্ধকার ভেদ করে বের হয়ে আসতে চাইলাম। দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে সেই হিম অন্ধকারকে সরাতে থাকলাম। আমি দ্রুত বেগে হাঁটতে থাকলাম। আমার সামনে ভয়ঙ্কর এক হিংস্র প্রাণীর অস্তিত্বের কথা ভুলে গেলাম। ভুলে গেলাম কথা বলতে থাকা ওই প্রাণী মুহূর্তেই হিংস্র হয়ে আমাকে ছোবল দিতে পারে।
বেশি দূর যেতে পারলাম না। কারণ অন্ধকার কেটে যেতে থাকল। সেখানে আগের কুয়াশামাখা চাঁদের আলো ফুটে উঠল। এই আলো থেকে আমি বের হতে পারি না। এই আলো থেকে আমি বোধ হয় বের হতে চাইও না।
আমি দাঁড়ালাম । এবং দেখলাম গালে হাত দিয়ে জমির আইলে আশিক বসে আছে।
আমি বললাম, তুই এখানে?
আশিক বলল, আমি তো এখানেই থাকি।