পায়ে-পায়ে এগিয়ে এসেছি কতটা দূরে, তা জানি না। পেন্ডুলামটি ধরার জন্য এগিয়েছি যত দূর, তত দূর পিছিয়ে গেছে ওটা। প্রথম প্রথম বুঝতে পারিনি। একটু পরেই বুঝতে পারলাম আমি যতই এগিয়ে যাই পেন্ডুলামটি ততই সরে যায়। আমাদের মধ্যকার দূরত্ব তাতে একটুও কমে না। এই সমান ব্যবধান নিয়ে তো কারও কাছে পৌঁছানো যায় না। মজার বিষয় হলো, আমি সেটা বুঝতেও পারিনি। যদি তারকা খসে না পড়ত আকাশ থেকে, আমি হয়তোবা বোকার মতো পেন্ডুলামটির পেছনে পেছনে ছুটতেই থাকতাম। পড়ন্ত তারকা আমাকে প্রথমে একটু থামিয়ে দিল। এরপর অবাক করে দিয়ে পতিত হলো ঠিক সেই জায়গায়, যেখানে ভূমি-বাতাস-ধূলিকণা-কুয়াশার আবরণের ভেতরে একাকী মিশে যাচ্ছিল আমার শরীরের আনন্দ রেনু।
আমার বিস্ময়ের মাত্রা সকল অভিজ্ঞতাকে ছাড়িয়ে উচ্চতম শিখরে পতিত হলো তখন, যখন আমি নবজাতকের কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। এবং যেহেতু সেই কান্নার উৎসমুখ সম্বন্ধে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না, সেহেতু আমি স্বভাবতই তার দিকে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলাম। এবং প্রথম পদক্ষেপেই হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। বিষয়টা বুঝতে মিনিট খানেকের মতো সময় লাগল বুঝি! কারণ পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেন্স কাজ করছিল না। কী হলো কী হলো জাতীয় বিহ্বলতায় আচ্ছন্ন ছিলাম। তারপর বুঝতে পারলাম পড়ে গেছি। এবং পড়ে গেছি একটা গর্তের ভেতরে। গর্ত মানে ধানক্ষেতের কোণায় গর্ত করে যে ডোবাগুলো বানানো হয়, তার ভেতরে। বর্ষাকালের ক্ষেতের সময় এই দোপা জায়গায় মাছ এসে জড়ো হয়। সেটা ছেঁচে মাছ ধরা হয়। এরকম একটি গর্তে পড়ে যাওয়ার পর চোখে-মুখে গুঁড়ো মাটি লেগে গেল। পড়ে গেছি বাম দিকে। স্বাভাবিক ভাবেই সে-দিকে ব্যথা পাওয়ার কথা। কিন্তু কোনো ব্যথা অনুভূত হচ্ছে না। আমি ততক্ষণে উঠে পড়েছি। উঠে দাঁড়ানোর পরই আমি অনুভব করলাম আমার বাম হাত মোটামুটি অবশ। চোখে মুখে লেগে থাকা মাটি সরাতে গিয়ে আমি এবার অনুভব করলাম আমি তেমন দেখতেও পাচ্ছি না। কী এক ধরনের অনুভূতি আমার মনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকল। আমার শরীরও সায় দিচ্ছে না আর দাঁড়িয়ে থাকতে। ফলে আমি বসে পড়লাম। বসে পড়লাম মানে বসে পড়তে বাধ্য হলাম।
কিছুক্ষণ এভাবে থেকে নিজেকে আশ্বস্ত করতে থাকলাম। একটু ধাতস্থ হয়ে ওঠার পর আবার আমার শরীরের দুটো অঙ্গ নিয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পড়লাম। প্রথমত আমি বাম হাতে কোনো শক্তি পাচ্ছি না। দ্বিতীয়ত আমি চোখে তেমন দেখতে পাচ্ছি না। একটা হাত ঠিক মতো কাজ না করলেও চলে। কিন্তু চোখ! আমি প্রথমে চোখের পরীক্ষা করতে গিয়ে ডান হাতটা চোখের সামনে ধরলাম। কিছুই দেখা যায় না। তারপর বাম হাতটা চোখের সামনে ধরতে গিয়ে আবারও আবিষ্কার করলাম বাম হাতটা অবশ। তখন ডান হাত দিয়ে ধরে বাম হাতটি চোখের সামনে মেলে ধরলাম। কী আশ্চর্য। আমি বাম হাতটি দেখতে পাচ্ছি। প্রথমে অস্পষ্টরূপে বাম হাতের মোটা মোটা রেখাগুলো স্পষ্ট হতে থাকল। তারপর মোটা রেখাগুলো থেকে শাখা নদীর মতো বের হওয়া চিকন রেখাগুলোও স্পষ্ট হতে থাকলো। আমি গভীরভাবে মগ্ন হয়ে স্পষ্ট হয়ে যাওয়া হাতের রেখাগুলো দেখতে থাকলাম। এবং এরপর দেখলাম সেই রেখাগুলো সাদা রঙের পিচ্ছিল আঠালো জলীয় জাতীয় পদার্থ দ্বারা আবৃত হয়ে যাচ্ছে। আমার নাকে একটি চেনা গন্ধ এসে ধাক্কা মারল। বুঝতে পারলাম এগুলো একটু আগে আমার শরীর থেকে নির্গত হওয়া চূড়ান্ত আনন্দের রেনু। যেগুলো যে-কোনো পুরুষই ধারণ করে। বুঝতে পারলাম পারলাম কোনো সানিয়া মির্জা কিংবা সানি লিওন কিংবা মল্লিকা শেরওয়াতের শরীর এগুলো নিয়ে যায়নি। বুঝতে পারলাম বিজন মাঠে আমার শরীর থেকে পতিত হওয়া এইসব আনন্দ-রেনু ওইখানেই মিশে নিঃশেষ হয়ে যায়নি। বুঝতে পারলাম আমার বাম হাত ওই মুহূর্তে হয়ে উঠেছিল সানিয়া মির্জার ত্রিভুজ। বুঝতে পারলাম আমার বাম হাত ওই মুহূর্তে হয়ে উটেছিল মল্লিকা শেরওয়াতের মোহনা। বুঝতে পারলাম আমার বাম হাত ওই মুহূর্তে হয়ে উঠেছিল সানি লিওনের গিরিখাত। ত্রিভুজে মোহনায় গিরিখাতে যখন সবকিছু একাকার হয়েছিল তখন সাদা পায়রার বেশ ধরে আনন্দ রেনুগুলো বের হয়ে এসেছিল। কিন্তু সবগুলো পতিত হয়নি ওই ভূমিতে। কিংবা সবগুলো রয়ে যায়নি সানি লিওনের গিরিখাত হয়ে ওঠা আমার বাম হাতে। আমি যখন পেন্ডুলামটিকে ধরার জন্য যাচ্ছিলাম তখন এগুলো বিচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিল। বিচ্ছন্ন হতে হতে এগুলো এতক্ষণে নিছক জল হযে যাওয়ার কথা। হয়নি। বরঞ্চ আরো ঘণীভূত হয়েছে। তাহলে এখন বাম হাতে দৃশ্যমান এইসব সাদা পায়রার স্রোতে কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে!
হাতের ভেতরের সাদা পায়রার স্রোতের দিকে আমি তাকিয়ে থাকি। আর কিছু দেখি না। আর কিছু দেখি না মানে কোনো কিছু দেখতে পারছে না আমার চোখ। সাদা পায়রার ঝাঁক উড়তে থাকে। উড়তে থাকে। উড়তে উড়তে সেগুলো কুয়াশা হয়ে যায়। কুয়াশার ভেতরে ধীরে ধীরে জেগে ওঠে চাঁদ। চাঁদ দেখতে পাওয়ার পর দৃশ্যমান হয়ে ওঠে আকাশ। তারপর দৃশ্যমান হয়ে ওঠে এই মাঠ। তারপর দৃশ্যমান হয়ে ওঠে এই স্থান। তারপর দৃশ্যমান হয়ে ওঠে এই দৃশ্য। অবিকল। আমি অবিকল দেখতে পাচ্ছি এইসব চারপাশ। আমি অবিকল দেখতে পাচ্ছি সব কিছু। সবকিছুই দেখা যাচ্ছে আমার বাম হাতের ভেতরে।
তারপর দুই হাত দিয়ে ঘষতে শুরু করল তাদের গাল। গাল ঘষতে ঘষতে তারা অদৃশ্য হয়ে গেল। তারা যেখানে যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানে দেখা গেল তিনটি সাপ। শাপগুলোর ঠোঁটের নিচটা ঠিক সাপের মতো নয়। একটি সাপের ঠোঁটের নিচটা ঠিক সানিয়া মির্জার ত্রিভুজের মতো। একটি সাপের ঠোঁটের নিচটা ঠিক মল্লিকা শেরওয়াতের মোহনার মতো। একটি শাপের ঠোঁটের নিচটা টিক সানি লিওনের গিরিখাতের মতো
কিন্তু আমি কোথায়? আমি তো এই পুরো পরিবেশের ভেতরে এসে পড়েছি। একটু আগের দেখা পুরো পরিবেশ যেখানে দৃশ্যমান সেখানে আমাকে দেখা যাচ্ছে না কেন? এই কথা ভাবতে না ভাবতেই হাতের ভেতরে স্পষ্ট হয়ে উঠলাম আমি। আমি মানে আমিই। সব ঘটনাই দেখা যেতে লাগলো এখানে। শুধু সন্দেহের একটি জায়গা স্পষ্ট হয়ে গেলো এখানে। সেটা হলো আমি এই চরাচরে সানিয়া মির্জা কিংবা মল্লিকা কিংবা সানি লিওনের উপস্থিতির বিষয়ে সন্দিহান ছিলাম। সন্দিহান ছিলাম বাস্তবতার কারণেই। সন্দিহান ছিলাম মানুষের কল্পনাকে সম্মানদানের জন্য। কিন্তু আমি দেখতে পেলাম এখানে সত্যি সত্যিই এসেছিলেন সানিয়া মির্জা কিংবা মল্লিকা শেরওয়াত কিংবা সানি লিওন।
আমি দেখলাম, আমাকে আসলে একজন তরুণী জড়িয়ে ধরেনি। ধরেছিল তিনজন। বোধহয় তরুণীর স্পর্শে উত্তেজিত হওয়ার জন্য সেটা বুঝতে পারিনি। আমি দেখলাম, আমার বাম হাতটি কল্পনায় একটুও ভাসেনি। আমি ভেবেছিলাম আমার বাম হাতটি হয়ে উঠেছিল সানিয়া মির্জার ত্রিভুজ। আমি ভেবেছিলাম আমার বাম হাতটি হয়ে উঠেছিল মল্লিকা শেরওয়াতের মোহনা। আমি ভেবেছিলাম আমার বাম হাতটি হয়ে উঠেছিল সানি লিওনের গিরিখাত। আমার এই ভাবনাটা একদম ভুল ছিল। কারণ আমি দেখলাম এখানে সত্যি সত্যি সানিয়া মির্জা এসেছিলেন। তার ত্রিভুজের ভেতরে আমি এঁকেছি অসংখ্য বৃত্ত। আমি দেখলাম এখানে সত্যি সত্যি এসেছিলেন মল্লিকা শেরওয়াত। তার মোহনায় আমি লক্ষ কোটি ঝিনুক তুলেছি এবং ফেলেছি। ঝিনুকের ভেতরের মুক্তা দেখে মল্লিকা শেরওয়াত ঠোঁট বাঁকা করে বলেছিল, ‘আহ! এত ঝিনুক! এত মুক্তা!’ আমি দেখলাম এখানে সত্যি সত্যি এসেছিলেন সানি লিওন। তার গিরিখাতে আমি ফেলেছি অসংখ্য পাহাড়ি মুদ্রা। পাহাড়ি মুদ্রা পেয়ে সানি লিওন শিউরে উঠে বলেছিল, ‘এই মুদ্রা সময়-খচিত। এই মুদ্রায় সব দেয়া যায়।’
আমি আরো দেখলাম, তারা আমার আনন্দের রেনু তাদের ত্রিভুজে মোহনায় গিরিখাতে নেয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। তারা সবটুকু নেয়ার জন্য সাঁপের মতো ফোঁসফোঁস করছিল। আমি কোনো কথা বলছিলাম না। শুধু ব্যস্ত ছিলাম বৃত্ত আঁকতে। শুধু ব্যস্ত ছিলাম ঝিনুকের মালা গাঁথতে। শুধু ব্যস্ত ছিলাম পাহাড়ি মুদ্রা ফেলতে। শেষে যখন আমার আনন্দের রেনু সাদা পায়রা হয়ে ঝরে পড়লো, দেখলাম সবাই শান্ত হয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। তাদের ত্রিভুজ উপচে পড়ছে বৃত্তের ব্যাস। তাদের মোহনায় জোয়ারের ফেনা। তাদের গিরিখাতে পাহাড়ী পাপড়ির নির্যাস।
তারা অনেকক্ষণ পর জেগে উঠলো। জেগে উঠে তারা তাদের ত্রিভুজে মোহনায় গিরিখাতে হাত রাখলো। হাতে তুলে আনলো আমার কাছ থেকে নেয়া আনন্দের রেনু। সেই রেনু তারা দুই হাতে মেখে নিলো। তারপর দুই হাত দিয়ে ঘষতে শুরু করল তাদের গাল। গাল ঘষতে ঘষতে তারা অদৃশ্য হয়ে গেল। তারা যেখানে যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানে দেখা গেল তিনটি সাপ। শাপগুলোর ঠোঁটের নিচটা ঠিক সাপের মতো নয়। একটি সাপের ঠোঁটের নিচটা ঠিক সানিয়া মির্জার ত্রিভুজের মতো। একটি সাপের ঠোঁটের নিচটা ঠিক মল্লিকা শেরওয়াতের মোহনার মতো। একটি শাপের ঠোঁটের নিচটা টিক সানি লিওনের গিরিখাতের মতো।
তিনটি শাপ ক্রমশ কাছাকাছি আসতে থাকল। কাছে আসতে আসতে তারা এত কাছে এলো যে একটি সাপে রূপান্তরিত হয়ে গেল।
রূপান্তরিত শাপটি আমার বাম হাতের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার বাম হাতের আয়ু রেখার ওপরে যে ছোট্ট বিন্দু জল আছে, আমি সেখানে ছোবল দেব।