উনিশ শতকের শুরু থেকেই বাংলা সাহিত্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। এ পরিবর্তন ছিল কয়েক ধরনের। যেমন: ১. ভাষার প্রকাশ রীতি বা গদ্যের বিকাশ ২. সাহিত্যের প্রকরণ বা কথা-প্রবন্ধ-নিবন্ধ-বিচার-প্রস্তাব এবং ৩. বিষয়বস্তুগত বা ধর্ম-সাহিত্য-সমাজ-রাজনীতি ইত্যাদি।
এর আগেই বাংলায় আধুনিক প্রকাশনার প্রধান উপকরণ ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শ্রীরামপুর মিশনের প্রচারমূলক পুস্তক এবং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের কাজগুলো বাংলা সাহিত্যের এই পরিবর্তনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এর আগে আরও তিনটি বিষয় বাংলা সাহিত্যের বিকাশের কাজে অগ্রিম সহায়তা করে। এগুলো হলো, বাংলা ব্যাকরণ রচনা এবং বাংলা শব্দকোষ বা অভিধান প্রণয়ন। নাথানিয়াল ব্রাসি হ্যালহেড ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ব্যাকরণ গ্রন্থ রচনা করেন। মানোএল দ্য আসসুম্পসাঁও নামক এক পর্তুগিজ প্রচারক বাংলা-পর্তুগিজ অভিধান রচনা করেন। এর পরে উইলিয়াম কেরি কর্তৃক বাংলা গদ্যের প্রবর্তন। আসলে প্রবর্তন না বলে ব্যবহার করেন বললে ভালো হয়। এ তিনটি কাজই হয় খ্রিস্টান মিশনারিদের হাতে।
এ ছাড়া দোম আন্তোনিও নামে অপর একজন পর্তুগিজ প্রচারক পর্তুগিজ বর্ণমালায় বাংলা গদ্যগ্রন্থ রচনা করেন, ব্রাহ্মণ-ক্যাথলিক সংবাদ।
বাংলা গদ্যের বিকাশ ঘটেছিল অনেক আগেই। তখন শুধু শাসনসংক্রান্ত কাজে বাংলা ব্যবহৃত হয়েছে। এবার সাহিত্য সৃষ্টিতে ব্যবহৃত হলো।
শ্রীরামপুর মিশনের প্রচারক এবং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সম্মানিত শিক্ষক উইলিয়াম কেরি ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে ‘কথোপকথন’ নামে প্রথম বাংলা গদ্যগ্রন্থ রচনা করেন। এক যুগ পরে ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে রচনা করেন ‘ইতিহাস মালা’। এ কাজগুলোর পেছনে বাংলায় আগত ইংরেজ ও পর্তুগিজ খ্রিস্টানরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। শ্রীরামপুর মিশনারিতে কেরি এই উদ্দেশ্যেই আসেন। তিনি ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় এসে যিশুর বাণী প্রচারের কাজকেই মুখ্যকর্ম হিসাবে গ্রহণ করেন। বিলাতে থাকতেই তিনি এ কাজে উৎসাহী ছিলেন। আরও কয়েকজন খ্রিস্টান প্রচারকের সহায়তায় তিনি ধর্মীয় কাজ শুরু করেন। তারা তাদের স্বার্থেই এসব কাজ করেছেন। এদেশের মানুষের ধর্ম নষ্ট করে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করায় প্ররোচনা দান করাই ছিল তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। কালের বিচারে তাদের এই সব কর্মকাণ্ড তাদের অনুকূলে ছিল না। শেষ পর্যন্ত তা বাঙালির এবং ভারতবাসীর পক্ষেই চলে আসে।
আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকায় ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের ফলে স্থানীয় জাতিগুলোর যেমন স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, দেশ, সম্পদ ইত্যাদি লুট হয়েছে। ভারতবর্ষের বিশেষ করে বাঙালিরও তাই হয়েছে। কিন্তু বাংলার মানুষের ধর্ম এবং ভাষা তারা কেড়ে নিতে পারেনি। যেমনটি পেরেছিল আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকায়।
এসব প্রচারকের প্ররোচনায় এদেশের কিছু মানুষ খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন; অন্যরা নিজ নিজ ধর্মই ধারণ করেছেন। আর ভাষার ব্যাপারে এখানে ঔপনিবেশিক প্রভুরা তাদের ভাষা সর্বজনীন করে তুলতে পারেননি। বরং শাসনব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য স্থানীয় ভাষা শেখার ব্যাপারে তাদেরই বেশি আগ্রহ ছিল। এর বড় প্রমাণ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। এই কলেজে বাংলা, সংস্কৃত, ফারসি, হিন্দি ও উর্দুর মতো স্থানীয় ভাষাগুলো ইংরেজরাই শিখতেন। তবে তাদের ষড়যন্ত্র কম ছিল না। নিজেরা এদেশি ভাষা শেখার পরেও রাজভাষা পরিবর্তন করে এদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাস পাল্টে দিয়েছিল।
দুই.
বিদেশি মিশনারিদের গদ্য রচনার পরে বাঙালি লেখকদের গদ্য রচনা শুরু হয়। প্রথমেই করা যায় রাজা রামমোহন রায়ের কথা। রামমোহন রায় (১৯৭২—১৮৩৩) প্রথমে গদ্যে রচনা করেন ‘বেদান্ত গ্রন্থ’ ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে রচনা করেন ‘বেদান্ত সার’। উপনিষদের অনুবাদ করেন ১৮১৫ থেকে ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। ‘উৎসবানন্দ বিদ্যাবাগীশের সহিত বিচার’ ও ‘গোস্বামীর সহিত বিচার’ নামে দুটি বিচারমূলক গ্রন্থ রচনা করেন ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে। পরের বছর রচনা করেন ‘সহমরণবিষয়ক প্রবর্তক-নিবর্তক সম্বাদ’, ‘কবিতাকারের সহিত বিচার’ (১৮২০), ‘ব্রাহ্মণ সেবধি’- (১৮২১), ‘সহমরণ বিষয়ক’ (১৮২৩) ইত্যাদি।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯৪) প্রথম দিকে শুধু সংস্কৃত, ইংরেজি ও হিন্দি ভাষা থেকে অনুবাদ করেছেন। তার এসব অনুবাদ গ্রন্থ জনপ্রিয়তা লাভ করে। পরে তিনি মৌলিক রচনায় হাত দেন। তার প্রথম মৌলিক চিন্তাশীল রচনা ‘সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য শাস্ত্রবিষয়ক প্রস্তাব’ (১৮৫৩)। এর পরে রচনা করেন ‘বিধবা বিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ গ্রন্থটি। এর দুটি খণ্ডই প্রকাশিত হয় ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে। তিনি পাঠ্যপুস্তক, শিশুসাহিত্য এবং রম্যসাহিত্যও রচনা করেন। তবে তার চিন্তাশীলতার রচনাগুলোর জন্যই তাকে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি প্রদান করা হয়।
ভূদেব মুখোপাধ্যায় (১৮২৭—১৮৯৪) উনিশ শতকের একজন বিস্ময়কর প্রতিভা। তিনি সাহিত্যের নানা শাখায় লেখালেখি করেন। চিন্তাপ্রধান রচনার মধ্যে ‘শিক্ষাবিষয়ক প্রস্তাব’ (১৮৫৬), ও ‘প্রাকৃতিক বিজ্ঞান’ উল্লেখযোগ্য। ‘প্রাকৃতিক বিজ্ঞান’-এর প্রথম খণ্ড ১৮৫৮ ও দ্বিতীয় খণ্ড-১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও বাঙালি চিন্তাশীল সাহিত্যের প্রথম দিকের একজন গণ্যমান্য লেখক। তিনি রচনা করেন ‘ব্রাহ্মধর্ম গ্রন্থ’ (১৮৫০), ‘আত্মতত্ত্ববিদ্যা’ (১৮৫২), ‘ব্রহ্মধর্মের মত ও বিশ্বাস’ (১৮৬০), ‘কলিকাতা ব্রাহ্মধর্মের বক্তৃতা’ (১৮৬২), ‘ব্রাহ্মধর্মের ব্যাখ্যান’ প্রথমখণ্ড (১৮৬১) ও দ্বিতীয়খণ্ড (১৮৬৬)। তার বেশির ভাগ রচনাই ব্রাহ্মধর্মের বিষয়ে।
রাজনারায়ণ বসু (১৮২৬—১৮৯৯) চিন্তাপ্রধান সাহিত্যের লেখক। মাইকেল মধুসূদন দত্তের বন্ধু বলেও পরিচিত। তার ভাষণ ও অভিভাষণগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলে জনপ্রিয়তা লাভ করে। প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘রাজনারায়ণ বসুর বক্তৃতা’ প্রথম ভাগ ১৮৫৫ এবং দ্বিতীয় ভাগ ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এছাড়া ‘ব্রাহ্মসাধন’ (১৮৬৫), ‘ধর্মতত্ত্বদীপিকা’ প্রথম ভাগ ১৮৬৫ এবং দ্বিতীয় ভাগ ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত। ‘আত্মীয়সভার সদস্যদের বৃত্তান্ত’ (১৮৬৭), হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব’ (১৮৭৩), ‘প্রকৃত সাম্প্রদায়িকতা কাহাকে বলে (১৮৭৩), ‘ব্রাহ্মধর্মের উচ্চ আদর্শ ও আমাদিগের আধ্যাত্মিক অভাব’ (১৮৭৩) ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বক্তৃতা’ (১৮৭৮), ‘সারধর্ম (১৮৮৬), ‘বিবিধ প্রবন্ধ’ (১৮৮২), ‘বৃদ্ধহিন্দুর আশা’ (১৮৮৭) ইত্যাদি। এর বাইরেও তার নানা প্রকার রচনা রয়েছে।
রামতনু লাহিড়ী (১৮১৩—১৮৯৮) ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ ও পত্রিকার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ‘বেঙ্গল স্পেকটেটর’ পত্রিকা প্রকাশনায় অন্যতম উদ্যোক্তা এবং ‘জ্ঞানান্বেষণ সমিতি’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
রামনারায়ণ তর্করত্ন (১৮২২—১৮৮৬) জনপ্রিয় নাট্যকার। তার অনেক নাটক সেকালে জনপ্রিয়তা লাভ করে। তার সমাজভাবনা নিয়ে প্রবন্ধগ্রন্থও রয়েছে। প্রবন্ধগ্রন্থ ‘পতিব্রতোপাখ্যান’ (১৮৫৩)।
রামরাম বসু (১৭৫৭থ১৮১৩) প্রধানত খ্রিস্টধর্মের বিষয় নিয়ে রচনা করেন। ‘খ্রিস্টস্তব’, ‘গসপেল মেসেঞ্জোর’-এর বাংলা অনুবাদ ‘হরকরা জ্ঞানোদয়’ এবং ‘খৃষ্ট বিবরণামৃত’।
এ ছাড়া, চিন্তাপ্রধান সাহিত্য রচনা রয়েছে কাশীনাথ তর্কপঞ্চাননের ‘পাষ-পীড়ন’ (১৮২৩), গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কারে ‘স্ত্রীশিক্ষাবিধায়ক’ (১৮২২) ইত্যাদি।
তিন.
চিন্তাচর্চায় বাংলা পত্র-পত্রিকা: বাংলা ভাষায় পত্র-পত্রিকার প্রকাশ শুরু উনিশ শতকের গোড়ার দিক থেকেই। এর আগে ইংরেজরা নিজেদের মধ্যে চালু করেছিল কিছু ইংরেজি পত্রিকা বা সাময়িকপত্র। এর মধ্যে জেমস অগাস্টাস হিকির ‘বেঙ্গল গেজেট’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ পত্রিকায় কোম্পানির ইংরেজদের নানা কীর্তিকলাপও প্রকাশিত হতো। হিকি সাহেবের মধ্যে ব্রিটিশ জাতীয়তাবোধের চেয়ে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার চেতনা বেশি প্রবল ছিল। একজন ব্রিটিশ নাগরিক হয়েও তিনি মনে করতেন দেশপ্রেমের নামে সত্য লুকানোর চেয়ে গণমাধ্যমকর্মী হিসাবে সংবাদ প্রকাশ করাটা পবিত্র কর্তব্য। কারণ জনগণের তথ্য জানার অধিকার বেশি। এ জন্য অবশ্য তাকে চড়ামূল্যও দিতে হয়েছে। জেল খাটতে হয়েছে, শেষ জীবনে অশেষ দুঃখ ভোগ করতে হয়েছে। তবে তিনি একজন ইংরেজ হয়ে স্বদেশি দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধেও কলম ধরার সূচনা করে গেছেন এটাই বড় কথা। হিকির পরে আরও কিছু ইংরেজি পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলা সংবাদ ও সাময়িক পত্র প্রকাশের সূচনা হয় উনিশ শতকে। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে একাধিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। কোনটা আগে কোনটা পরে এ নিয়ে বিতর্ক আছে। কারো মতে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের ‘বাঙ্গাল গেজেটি’ নামের পত্রিকাটি প্রথম। কারও মতে শ্রীরামপুর মিশনারীর ‘মাসিক দিগদর্শন’ই প্রথম। একই বছর জন ক্লার্ক মার্শম্যান ও কয়েকজন বাঙালি পণ্ডিতের সহায়তায় বের হয় ‘সাপ্তাহিক সমাচার দর্পণ’। খ্রিস্টান মিশনারির পত্রিকা সমাচার দর্পণের কাজ ছিল এদেশীয় ধর্মগুলোর তীব্র সমালোচনা করে জনমনে সন্দেহ জাগিয়ে সেখানে খ্রিস্টীয় ধর্মের বীজ বপন করা। এই পত্রিকার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়েই বাঙালিরা প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশের কাজে নামেন। ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে রামমোহন রায় ও ভবানী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ‘সম্বাদ কৌমুদী’। বছর খানেক পরে রামমোহন রায়ের সঙ্গে মতবিরোধ দেখা দিলে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘সমাচারচন্দ্রিকা’ নামে পত্রিকা প্রকাশ করেন। এভাবেই বাংলা ভাষায় সংবাদপত্রের মাঝে চিন্তাচর্চার সূত্রপাত ঘটে। রামমোহন রায়ের ‘সম্বাদ কৌমুদী’ই প্রথম বাংলা চিন্তাশীলদের পত্রিকা। এ কাগজে তিনি প্রগতি ও যুক্তিশীলতার পক্ষে লেখতেন এবং লেখা ছাপাতেন।
১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে ইয়ংবেঙ্গলের তরুণরা প্রকাশ করেন ‘জ্ঞানান্বেষণ’ নামে একটি চিন্তাচর্চার পত্রিকা। এটি কলকাতার তরুণদের মনোজগতে বিরাট পরিবর্তন আনে। পরের বছর কবি ঈশ্বরচন্দ্রগুপ্ত প্রকাশ করেন প্রথম বাংলা দৈনিক পত্রিকা ‘সংবাদ প্রভাকর’। এটি সংবাদপ্রধান পত্রিকা হলেও চিন্তাচর্চার ধারাবাহিকতায় এ কাগজেরও ভূমিকা ছিল। এরই পথ ধরে বাংলায় চিন্তাচর্চার পথ বেগবান হয়। নানা পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে।
১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ চালু করেন কেশবচন্দ্র সেন, অক্ষয়কুমার দত্ত প্রমুখের সহায়তায়। দুই বছর পরে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ প্রকাশ করেন।
এসব কাগজে ধর্ম বিশেষ করে হিন্দু ধর্মের ঔৎকর্ষের নানা দিক, ব্রাহ্মধর্মের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব, খ্রিস্টান ধর্মের সমালোচনা ইত্যাদি ধর্মতাত্ত্বিক রচনা প্রকাশিত হতো। এ ছাড়া সমাজের নানা বিষয়ও স্থান পেত।
পুরাতত্ত্ববিদ, ইতিহাসবিদ এবং প্রাবন্ধিক রাজেন্দ্রলাল মিত্র তিনি কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। যেমন, ‘বিধিার্থ সংগ্রহ’, ‘রহস্য-সন্দর্ভ’ ‘হিন্দু-প্যাট্রিয়ট’ ইত্যাদি।
চার.
গোষ্ঠীবদ্ধ চিন্তাচর্চা: উনিশ শতকের প্রথম দিকে কয়েকটি গোষ্ঠী চিন্তাশীলতার চর্চা করেন। পাশ্চাত্য দেশে এগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক নাম হতে পারত ‘স্কুল’। এ গোষ্ঠীগুলো কয়েকজন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। এদের মধ্যে রাজা রামমোহন রায়, হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। ডিরোজিওর বলয়ে ছিলেন দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, রসিকৃষ্ণ মল্লিক, রাজনারায়ণ বসুসহ অনেকে। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে ডিরোজিওর মৃত্যুর পরে মাইকেল মধুসূধন দত্ত এই বলয়ে প্রবেশ করেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০—১৮৯৪)ও একটি বলয় গড়ে তোলেন। তার সতীর্থ ছিলেন কয়েকজন। এদের মধ্যে তারাশঙ্কর তর্করত্ন (চট্টোপাধ্যায়) অকালপ্রয়াত একজন পণ্ডিত। তার চিন্তাশীল রচনা ‘ভারতবর্ষীয় স্ত্রীগণের বিদ্যাশিক্ষা’(১৮৫০) উনিশ শতকে নারীশিক্ষা নিয়ে আলোচনামূলক রচনা।
পাঁচ
বাংলা ছাড়াও উনিশ শতকে ইংরেজি ফারসিসহ অনেক ভাষায় চিন্তাপ্রধান সাহিত্য রচিত হয়। এসব রচনার লেখক বাঙালি অবাঙালি উভয় জাতির লোক রয়েছেন।
ইংরেজি ভাষায়: ১৮১৭ থেকে ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজা রামমোহন রায় ঊনচল্লিশটি ইংরেজি রচনা লেখেন। সেগুলো ছয় খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে।
1.The Governance of India
- Freedom of Press
- Crusade against Suttee
- Hindu Law of Inheritance
- On Religion BZ¨vw`|
বঙ্গিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৭১ সালে Calcutta Review পত্রিকায় Bengali Literature নামে একটি ইংরেজি প্রবন্ধে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের আলোচনা করেন।
রাজনারায়ণ বসু ইংরেজিতে অনেকগুলো গ্রন্থ রচনা করেন। যেমন, A defence of Brahmoism and the Brahmo Samaj (1863)
- Brahmic Advice, Caution, and Help (1869)
- The Adi Brahmo Samaj, its views and principles (1870)
- The Adi Brahmo Samaj as a Church (1873)
রাজেন্দ্রলাল মিত্র (১৮২৪—১৮৯১) মূলত পুরাতত্ত্ববিদ, ইতিহাসবিদ ও প্রাবন্ধিক। তার প্রবন্ধগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো,
- Antiquities of Urissa
- Buddha Gaya
- Lalit Bistar
- Patanjal’s Yogasutra
- Nepalese Buddhist Literature
- Indo Aryans
ফারসি: ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে মুরশিদাবাদ থাকাকালে রামমোহন রায় রচনা করেন ‘তুহফাৎউল মুয়াহিদিন’, তিনি ফারসি পত্রিকা ‘মিরাতুল আখবার’ (১৮২২) ও সম্পাদনা করেন। রামমোহন রায়ের ত্রিশটি বাংলা রচনা এবং ঊনচল্লিশটি ইংরেজি রচনা রয়েছে।