পর্ব: এক
মস্তিষ্কের কোনো এক কোষে কেউ যেন শত-শত হাতুড়ি পিটাচ্ছে। সেই পিটুনি ঢেউ খেয়ে-খেয়ে ছড়িয়ে পড়ছে অন্য কোষগুলোতেও। প্রথমে মাথাটা খালি-খালি লাগল। তারপর বদ্ধ-বদ্ধ। তারপর বাম কানের ঠিক পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি কোণে একটু-একটু ব্যথা শুরু হলো। এখনো ব্লিপ-ব্লিপ করছে সেখানে। সেই ব্যথাময় ব্লিপ-ব্লিপ কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে গেলো মাথার ডান দিকে। ডানদিকে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর ছড়িয়ে পড়ল সারামাথায়। যেন একটা ছোট্ট নখযুক্ত কাঁকড়া তার অনেকগুলো পা ব্যবহার করে হেঁটে-হেঁটে যাচ্ছে মস্তিষ্কের এ-মাথা ও-মাথা। আমি কার্তিক-অগ্রাহায়ণের কুয়াশা ভেদ করে আসা জোসনার দিকে তাকিয়ে একটা ‘উহ’ শব্দ করি। কারণ কুয়াশা ক্রমশ ঘন হয়ে আসছিল আমার দিকে। মনে হচ্ছিল কুয়াশা আর কুয়াশা নেই। ধোঁয়ার কুণ্ডুলী হয়ে গেছে। কুয়াশার ভেতর দিয়ে হাঁটা যায়। কুয়াশার ভেতর দিয়ে দেখাও যায় একটু-একটু। শাদা অন্ধকার ভেদ করে দেখাও যায় খানিকটা দূর। ধোঁয়ার ধূসর বিস্তারের সঙ্গে তা করা যায় না। ধোঁয়া প্রথমেই চোখকে আক্রমণ করবে। তারপর নিঃশ্বাসকে এমনভাবে আক্রান্ত করবে যে, প্রয়োজনীয় অক্সিজেন গ্রহণ অসম্ভব হয়ে যাবে। কুয়াশা তা কখনোই করবে না।
ধোঁয়ায় রূপান্তরকামী সেই কুয়াশা কেটে গেল বুঝি ‘উহ’ শব্দটি শুনে! চাঁদ কিছু বলে দিলো কি কুয়াশাকে? কি জানি! তবুও হঠাৎ কুয়াশার ঘন আস্তরণ পাতলা হতে থাকল। আমার নিরীহ ‘উহ’ শব্দটি কাকে উদ্দেশে করে বলা, তা আমি নিজেও জানি না। যেহেতু জানি না, সেহেতু তা আমার উদ্দেশেই বলা হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। আসলে ‘উহ’ জাতীয় শব্দ বেশি দূর যায়ও না। যাওয়ার কথাও নয়। নিকটতমজন হিসেবেও এখানে আমারই অগ্রাধিকার। আমাকেই যেন বলা এই শব্দটি। কিন্তু চাঁদ যে কুয়াশাকে কী বলে দিল, আমার সামনে থেকে ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে ওঠা কুয়াশার ঘনত্ব কমতে শুরু করল!
ঘনত্ব কমতে থাকা সেই কুয়াশার চাদরের ভেতর থেকেই দেখতে পেলাম শস্য কাটা মাঠের আইল। ইঁদুরের গর্ত, গর্তের মুখে মাটি। মাটিগুলো আইলের সর্পিল কাঠামো কী রূপ পরিবর্তন করে দেয়! আইলের দুর্বা ঘাসে শিশির। সেই শিশিরের ওপর চাঁদের আলো। কুয়াশার বাধায় তাতে ঝাপসা ঝিকিমিকি।
আশেপাশে শস্য কাটার পর হাহাকার নিয়ে পড়ে থাকা মাঠ ছাড়া কিছুই নেই। মাঠের শেষে গ্রামীণ ঝোপ। তার ওপারে মানুষে বসত। কুয়াশার চাদর ভেদ করে দৃষ্টি যতদূর যায়, তাতে শাদা অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখা যায় না।
_________________________________________________________________________________________________
সব মৃত্যু এখন চিকচিক করছে পরিত্যক্ত খড়ে। ধান কাটা হয়ে গেছে। খড়-নাড়া ঈষৎ সিক্ত। কারণ হালকা কুয়াশা ঝরছে। হাঁটলে পা ভিজে যায় একটু একটু। শিশিরসিক্ত ঘাস চিকচিক করে। দূরের ঝোপঝাড়কে মনে হয় মৃত্যুপুরী।
_________________________________________________________________________________________________
এ রকম সময়ে নাক্ষত্রিক সুষমা ছাড়া আর কী কী দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে একজন মানুষ। স্মৃতি দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে? জীবনের হিসাব-নিকাশে বসতে পারে? জীবনের প্রেম প্রতারণা ইত্যাদি দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে? পারে হয়তো বা। কিন্তু এ সবের হিসাব-নিকাশের জন্য বিশাল মাঠের মাঝে মধ্যরাতে একাকী এক যুবক কেন আসে? এসব হিসাব-নিকাশের জন্য তো অনেক প্লাটফরম রয়েছে। রয়েছে অনেক প্রেক্ষাপটও। সে-সব বাদ দিয়ে যখন একজন যুবক এই নির্জন প্রান্তরে এসে চাঁদ ও কুয়াশার সঙ্গে মিশে যায়, তখন তাকে কে হাতছানি দিয়ে ডাকে? হাতছানি দিয়ে ডাকে চাঁদ থেকে ছুটে আসা ঝাঁক ঝাঁক আলোর ঢেউ! তখন যুবকটির দেখতে ইচ্ছে করে গালে হাত দিয়ে চাঁদের বৃদ্ধি, লয়। হালকা কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে নেমে আসা অপার্থিব চাঁদের আলোর পার্থিব কোনো ব্যাখ্যা দিতেও ইচ্ছে করে। এই স্নিগ্ধ উত্তাপ কত না মায়াময়! যেন আচ্ছন্ন উপমা। অসীম শূন্যতার মাঝে ব্যপ্ত আলোর বিচ্ছুরণ কোথায় গিয়ে হারায়! বিস্তীর্ণ এই প্রান্তরে নিজেকে একা একা লাগে। মাঝে মাঝে মনে হয়, না, আমি একা নই। আসলেই কি তাই! মানুষ কতটা একাকী হলে নির্জন হয়! হয়তোবা এখানে, এই চরাচরে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি নেই। অন্তত চোখের সীমানায় নেই। কেন থাকবে এখানে এই কার্তিক-অগ্রাহায়ণের শূণ্য মাঠে! কেন থাকবে এই কুয়াশামাখা হীম-হীম গভীর রাতে চাঁদের বিভ্রান্তিময় আলোর সঙ্গে! কেউ নেই। অন্তত চোখের সীমানায়। শুধু থাকতে পারে কোনো নিশাচর প্রাণী! আর দীর্ঘশ্বাস! দীর্ঘশ্বাস থাকতে পারে। আমি যখন এই হীম-হীম রাতের আঁধার কণার সঙ্গে একাত্ম হচ্ছিলাম। যখন ঘর থেকে বের হয়ে আঁধার কণার সঙ্গে চোখাচোখি করছিলাম, তখনই শুনতে পেয়েছিলাম অজ্ঞাত দীর্ঘশ্বাসের শব্দ। বাতাসের ভেতরে, আঁধার কণার ভেতরে তা মিলিয়ে গিয়েছিল অকস্মাৎ। তারপর যতই অগ্রসর হয়েছি ততই শুনতে পেয়েছি ওই অকস্মাৎ দীর্ঘশ্বাসের শব্দ। একসময় গন্ধটাও যেন নাকে এসে সুবাসের খবর দিল।
চাঁদের এই অপার্থিব আলোকে এখন মনে হচ্ছে মৃত্যুগন্ধময়। সব মৃত্যু এখন চিকচিক করছে পরিত্যক্ত খড়ে। ধান কাটা হয়ে গেছে। খড়-নাড়া ঈষৎ সিক্ত। কারণ হালকা কুয়াশা ঝরছে। হাঁটলে পা ভিজে যায় একটু একটু। শিশিরসিক্ত ঘাস চিকচিক করে। দূরের ঝোপঝাড়কে মনে হয় মৃত্যুপুরী।
বিচ্ছিন্নতাই এখন আমার একমাত্র সঙ্গী। আচ্ছা, যদি কখনো চিরবিচ্ছিন্নতা চলে আসে! চিরবিচ্ছিন্নতা যদি এসে যায় আমার এবং আমার বিপরীতের যাবতীয় সত্তা, পরিপার্শ্ব অথবা ব্যক্তির সঙ্গে! কতটা বিচ্ছিন্ন হলে কেউ অসামাজিক হয়ে যায়! শারীরিক মৃত্যুই কি চরম বিচ্ছিন্নকারী? এই টুকরো জীবনে কতবারই তো মৃত্যুবরণ করতে হয়! টুকরো-টুকরো জীবনে টুকরো-টুকরো মৃত্যু এসে গ্রাস করে আমাদের।
কবে, কখন, কাকে জোসনা এমন করে ডেকেছিল? পৃথিবীর ইতিহাসে এর কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবু যেন অনুভূত হয়, অদ্ভুত সেই আহ্বানে সাড়াদানকারীর অনেকেই আছে আমার সঙ্গে! কেউ যেন আমাকে ডাকে। অথবা কেউ ডাকে না। সে মনে হয় আমার চেনা। আবার মনে হয়ে সে আমার অচেনা। আমি সামনে এগিয়ে যাই। এই কণ্ঠ বা কণ্ঠহীনতার আহ্বান বা আহ্বানহীনতা আমাকে মনে করিয়ে দেয় আবিদের কথা। কেন জানি মনে হয় আমি এখন যে পথের পথিক হয়েছি এই পথের অগ্রজ ছিল সে! সেও ভালোবেসেছিল এই কার্তিক-অঘ্রাণের রাত। কুয়াশা। চাঁদ। চাঁদের আলো। সেও বুঝি ব্যপ্ত চরাচরে একাকী এসে হারিয়ে গিয়েছিল!
প্রথমে সে সিঁধিয়ে গিয়েছিল নিজের মধ্যে, তারপর অন্য কোনো সত্তায় অথবা অজ্ঞাত কোনোকিছুতে! কিংবা কী হয়েছিল তার, পৃথিবী সে কথা জানে না। পৃথিবীর খাতায় সে-কথা লিপিবদ্ধ হয়েছিল কি-না—তাও আমরা উদ্ধার করতে পারিনি। তবে চেষ্টা করেছিলাম। আমরা নেমে পড়েছিলাম আমাদের মৃত্যুর ময়নাতদন্ত উদ্ধারে। পারিনি। পারা যায় না। কারণ আবিদ বাস্তবতার কষাঘাতে জর্জরিত হতে হতে এক সময় চলে গিয়েছিল পরাবাস্তবতার মায়াবী জগতে। ওই জগতের বস্তুময়তা কেমন হয় আমাদের কারোরই জানা ছিল না। পৃথিবীর জানা আছে কি-না জানি না। এই বস্তুগত পৃথিবীর ময়াবী সত্তারই কত কিছু অধরা! আর আবিদের নির্মিত ওই জগতের বাস্তবিক কোনো ভিত্তিই তো নেই! হায় আমরা এখন কী করি!
________________________________________________________________________________________________
হয়তো বা খেতে বসেছি আমরা কয়েকজন। বুয়া রান্না করে বাটিতে খাবার রেখে যায়। যে যার মতো খেয়ে নেওয়া হয়। এর ভেতরেও কোনো কোনো দিন কাকতালীয়ভাবে আমাদের সময় একই জায়গায় এসে কেন্দ্রীভূত হয়। আমরা কথা বলি না। আমরা খেতে বসি। আমাদের হয়ে যেন কথা বলে আমাদের হাতের আঙুল। আমাদের হয়ে যেন কথা বলে আমাদের চোখ।
_________________________________________________________________________________________________
সে প্রায়ই বলত, জীবন এক বিশাল ক্ষেত্র। এখানে আকাঙ্ক্ষা না থাকলে প্রাপ্তি আসে না, প্রাপ্তি এলেও তার কোনো সীমারেখা নেই। স্বপ্ন না দেখলে বড় হওয়া যায় না। কিন্তু বড় হতে গেলেও তো লাগে নানাবিধ রসদ। আবার এও ঠিক যে, ওই স্বপ্নই তাকে তাড়া করে বেড়ায় আজীবন। কেড়ে নেয় সকল সুখ, সুখের আধার, ব্যাপ্তি। সে আরও বলত, ‘দেখিস আমি মানুষ হলে অন্তত তোর সঙ্গে শেয়ার করব যাবতীয় সত্তা।’
আমি বিস্মিত হয়ে বলতাম, ‘আমরা কি মানুষ নই!’
‘না, আমরা মানুষ নই। মানুষ হলে জুতা থাকতো, ভ্রূর মধ্যে দাগ থাকত, চোখের মধ্যে অভিমানের রাত থাকত। মানুষ হলে স্বপ্ন দেখে স্বপ্নের তাড়া খেয়ে বেড়াতে হতো না। সাফল্যের দরোজাগুলো খুলে যেতে জীবনের সামনে। মানুষ হলে বস্তুগত এই জগতের ভেতরে কখনোই নির্মিত হতো না পরাবাস্তব জগত।’
‘তাহলে আমরা কী!’
‘ভুলে গেলি! তুই ভুলে গেলি! তুই ভুলে যেতে পারলি!’
আমার কলার ধরে ফেলত সে। যেন শত্রু। বহুদিন পর নিজের কব্জায় পেয়েছে। আমিও কেমন নির্বিকার হয়ে যেতাম। যে কলার ধরে ঝাঁকাতো কয়েকবার। তারপর থেমে যেত। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলত সে। চোখ মুখ তখন ভরে যেত অপার্থিব কোনো অন্ধকারে। সে হেঁটে চলে যেত অধিকতর উজ্জ্বল আলোর দিকে। তবু তার মুখের ওপর পড়ে থাকা সেই অপার্থিব অন্ধকার সরে যেত না। আমাদের কেবলই মনে হতো সে একটা কিছু বলবে। কিন্তু কিছুই বলত না সে। হন-হন করে ঘর থেকে বেরিয়ে যেত। তারপর আলো-অন্ধকার-বাতাস-ধূলিকণা-চিৎকারের মধ্যে হারিয়ে যেত। আমাদের তখন কেবলই দীর্ঘশ্বাস। আর বিহ্বলতা। এসবে আক্রান্ত হতে হতে একটি প্রশ্ন আরো অন্ধকার ও রহস্যে আবর্তিত হয়ে আমাদের রক্তাক্ত করত। সেই প্রশ্ন কেউ উচ্চারণ করত না। এক ধরনের নীরবতায় আমরা হাবুডুব খেতাম। কিন্তু সবাই অনুভব করতাম ভেতরের মুখরতা। কিন্তু ওই প্রশ্ন দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করবার মতো সাহস আমরা তখনও অর্জন করিনি।
আমরা এরপর থেকে অনেক কিছুই ভুলে যেতাম।
সে আক্রান্ত হয়েছিল এক অন্যরকম মুদ্রাদোষে। জাহাজের হুইসেলের মতো শব্দ করতো একটু পর পর। হয়তো বা খেতে বসেছি আমরা কয়েকজন। বুয়া রান্না করে বাটিতে খাবার রেখে যায়। যে যার মতো খেয়ে নেওয়া হয়। এর ভেতরেও কোনো কোনো দিন কাকতালীয়ভাবে আমাদের সময় একই জায়গায় এসে কেন্দ্রীভূত হয়। আমরা কথা বলি না। আমরা খেতে বসি। আমাদের হয়ে যেন কথা বলে আমাদের হাতের আঙুল। আমাদের হয়ে যেন কথা বলে আমাদের চোখ। আমাদের হয়ে কথা বলে আমাদের নিঃশ্বাস। আমাদের হয়ে কথা বলে আমাদের চরম নৈঃশব্দ্য। সেই চরম নৈঃশব্দ্য ভেদ করে হঠাৎ আবিদ জাহাজের হুইসেলের মতো শব্দ করে বসে।
তখন আমাদের সবার সব কথা বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের আঙুল কথা বলে না আর। আমাদের চোখ কথা বলে না আর। আমাদের নিঃশ্বাসও কথা বলা বন্ধ করে দেয়। আমাদের নৈঃশব্দ্য মন খারাপ করে ছড়িয়ে পড়ে আমাদের পুরো আবাসে।
আমরা তখন কোনো এক অজানা আবেশে আবেশিত হয়ে পড়ি। আমরা তখন মন্ত্র-দগ্ধ পুতুলের মতো ফিরে আসি। ফিরে আসি আমাদের কাছে। আমরা চলে যাই আমাদের যার-যার রুমে। আমরা সিদ্ধান্ত নিই আমরা কোথাও যাব না আর। আমরা সিদ্ধান্ত নিই আমরা আর কোনোদিন কারো সঙ্গে কথা বলব না। আমরা সিদ্ধান্ত নিই এই রাতটা ভোর হলেই চলে যাব এখান থেকে। আমরা সিদ্ধান্ত নিই আমরা কোনোদিন ফিরে আসব না।
এরপর কী মনে করে আমি আবিদের কাছে যাই। গিয়ে দেখি আশিক খুব চিন্তিত মুখ নিয়ে বসে আছে। একটু পর হাবিব আসে। হাবিব এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। আশিক চোখ তুলে আবিদের দিকে তাকায়। তখন হাবিবও চোখ তুলে আবিদের দিকে তাকায়। আমি আবিদের চোখের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। আবিদ স্থির বসে থাকে। তার মুখ বন্ধ। তবু কোত্থেকে জাহাজের হুইসেলের শব্দটি ভেসে আসে। আবিদ আঙুল দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে।
আমরা তখন আবিদকে সন্দেহ করি না। কিন্তু আবিদ তো এক সময় এই শব্দটি করেছিল। এখনো করে। যখন করে তখন আমরা সবাই বুঝতে পারি। তখন আমরা বরাবরই সরে যাই। কিন্তু আরেক অজ্ঞাত কারণে আমরা আবার যখনই আবিদের কাছে আসি তখন আবারও ওই শব্দটি ভেসে আসে। তখন আবিদের মুখ বন্ধই থাকে।
_________________________________________________________________________________________________
তীব্র বাতাস এসে চোখে-মুখে পরশ বুলিয়ে যায়, চুল এলোমেলো করে দেয়। বুঝতে পারি না আদর না কি তাচ্ছিল্য! চলার কোনো শক্তি নেই। আমার সকল শক্তি শূন্যের কোঠায় এসে ঠেকেছে যেন। আমি যেন মানুষ নই! আমি যেন আবিদ! আমি যেন মানুষ নই! আমি যেন আশিক।
_________________________________________________________________________________________________
আবিদের কণ্ঠের কৃত্রিম জাহাজের শব্দ নয়, আমাকে বিস্মিত ও বাকরুদ্ধ করে দেয় হুইসেলের অরিজিনাল শব্দ! এটা কি আবিদের রচিত পরাবাস্তব জগতের কোনো একটি অংশ! নাকি প্রতিক্রিয়া! যেটাই হোক না কেন তা এই বাস্তব জগতে এসে এই জগতকে প্রভাবিত করবে কেন। এই চরাচরে জাহাজ আসবে কেন! আবিদ যতই পরাবাস্তব চেতনা, জগত ও আবহাওয়ার পরিবেশ নির্মাণ করুক না কেন, কথায়-কথায় যত সম্মোহিতই করুক না কেন কখনোই আমি তীব্রভাবে একাত্ম হতে পারিনি তার উদ্ভূত পরিবেশের সঙ্গে। আমি বারবার সন্দেহ করেছি আবিদকে। সন্দেহ করেছি তার শব্দকে। সন্দেহ করেছি ওই পরিবেশকে। যখন আমিসহ সবাই একে এক ওর ঘরে যেতাম, যখন সবাই একত্রিত হওয়ার পর জাহাজের ওই শব্দ শোনা যেত, যখন ওই শব্দ শোনার পর আবিদ প্রমাণ করবার চেষ্টা করত যে, সে শব্দ করেনি, তখনও আমি কাউকে সন্দেহের বাহিরে রাখিনি। বাহিরে রাখিনি কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাকে। বাহিরে রাখিনি কোনো বৈজ্ঞানিক সূত্রকে। বাহিরে রাখিনি কোনো যুক্তিবাদী মনের যুক্তিকে। বাহিরে রাখিনি মনোজগতের নানা ব্যাখ্যাকে। তাতে কেউ কোনোটা মেনে নিয়েছে। কেউ নেয়নি। কেউ সন্দেহ করেছে আমাকে। কিন্তু আজ কী হলো, আবিদের কথা মনে পড়াতে মনে পড়লো জাহাজের শব্দ, জাহাজের শব্দের কথার জের ধরে এলো ওই সময়ের আবহ। এখানে তো আবিদ নেই। এটা তো ম্যাচ নয়। এখানে তো নৈঃশব্দ্যকে ঘিরে আমরা চার যুবক কেন্দ্রীভূত হইনি। তারপরও হুইসেলের শব্দ ভেসে এলো কানে!
একটা জাহাজ কুয়াশা ভেদ করে, চাঁদের অপার্থিব আলো ভেদ করে শূন্যে-শূন্যে এগিয়ে আসতে থাকে আমার দিকে! নদী নেই, জল নেই। কিন্তু জাহাজ আছে। জাহাজ ভেসে আসে হাওয়ায়-হাওয়ায়। বাতাসের জোয়ার বয়ে যায় যেন হঠাৎ! তীব্র বাতাস এসে চোখে-মুখে পরশ বুলিয়ে যায়, চুল এলোমেলো করে দেয়। বুঝতে পারি না আদর না কি তাচ্ছিল্য! চলার কোনো শক্তি নেই। আমার সকল শক্তি শূন্যের কোঠায় এসে ঠেকেছে যেন। আমি যেন মানুষ নই! আমি যেন আবিদ! আমি যেন মানুষ নই! আমি যেন আশিক। আমি যেন মানুষ নই। আমি যেন হাবিব। আমি যেন মানুষ নই। আমি যেন অন্যকিছু। আমি কি মানুষ নই! হয়তোবা আমি কোনো মানুষ নই! আমার হাত নেই, পা নেই, মাথা নেই, হৃদপিণ্ড নেই, চোখ নেই, আমার কোনো জামাকাপড়ও নেই! আমি কি পিরামিড! বহন করে চলেছি প্রাচীন সভ্যতার দাগ! আমি কি কোনো মূর্তি! দক্ষ কোনো কারিগরের হাতে গড়ে উঠেছি দিনে-দিনে! আমার চোখে-মুখে শিল্পীর হাতের ছোঁয়া! আমি কি ভাস্কর্য! কিন্তু আমার তো রক্তপ্রবাহ আছে। কেউ কি আমার রক্তপ্রবাহ দেখে না! কেউ কি বোঝে না শিল্পীর হাতে গড়ে উঠতে-উঠতে আমিও ধারণ করতে শিখেছি রক্তমাংস! আমি যেন কি! মনে পড়ে না! মনে হয় আমি কোনো সরিষা ক্ষেতের মাঝখানে স্থির দাঁড়িয়ে আছি! আমার কোনো রক্তমাংসের পা নেই! আমার হাত শুকনো বাঁশের তৈরি! আমার হাত দু’টি রক্তমাংসের নয়! বিগত দিনের খড়কে কুণ্ডুলি পাকিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে আমার হাত, আমার দেহ! কোমর থেকে ঝুলছে কালো ছেঁড়া প্যান্ট, হাঁটুর নিচ থেকে অসহায়ের মতো ঝুলছে। একটা ছেড়া শার্ট আমার দেহকে আবৃত করে রাখলেও কেউ জানে না আমার কোনো হৃদপিণ্ড নেই! বুকের ভেতরে শত বছরের কুয়াশা! কুয়াশাগুলো কাশি হয়ে গেছে। গলা থেকে ঝুলছে একটি দড়ি। লোকে বলে টাই। অস্বস্তিতে মরে যাই আমি। কারণ এটাই আটকে রেখেছে আমার বুকের ভেতরের সব কুয়াশাকে। সামান্য ঘড়ঘড় শব্দও সে বের হতে দেয় না। আটকে রাখে। বৃত্তীয় মাটির কালো পাতিলে চুনের আঁকিবুঁকি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে আমার মাথা, চোখ, নাক। আমি যেন কী! আমি যেন কাকতাড়ুয়া!
জাহাজ এত নিকটে এসে গেছে বুঝতে পারিনি। খুব নিকটে আসায় বোঝা যাচ্ছে জাহাজ থেকে জল বের হচ্ছে। সেই জল প্রবল ঢেউ হয়ে আমাকে আঘাত করে। আমার ঝুলে থাকা কালো প্যান্ট ভিজে যায়। আমার খড়ের তৈরি দেহ ভিজে ভারী হয়ে যায়। বুকভর্তি কাশি খু-উ-ব ঘড়ঘড় করে। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়। জাহাজ এত নিকটে অথচ আমি আমাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে পারছি না! জাহাজ খুবই বিপজ্জনক নিকটে এসে গেছে! আমি এখন কী করি! এরপর আর কিছু মনে নেই। বোধকরি অনেক পরে নিজেকে বিচ্ছিন্নভাবে আবিষ্কার করি। আমার হাত ভেঙে গেছে। আমার হাত দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ঘাড় থেকে সরে গেছে মাথা। বুকের ভেতরের সব কুয়াশা উধাও। ঘড়-ঘড় কমে এসেছে। স্বস্তি পাচ্ছি খানিকটা। আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার দেহের সব বিচ্ছিন্ন অংশ ধীরে-ধীরে একে-একে যথাস্থানে সংযুক্ত হতে থাকে! মাথায় হাত চালিয়ে দেখি সামান্য ভেজা। কারণ, কুয়াশা।
চলবে…