ফ্রান্সিস বেকন (Franchis Bacon) বলেছেন, Men fear death, as children fear to go in the dark—আঁধারের প্রতি, অজানার প্রতি মানুষের এই শঙ্কা ও ভয় চিরন্তন। আসন্ন মৃত্যুর ভয়াবহ রূপ ও মৃত্যু-পরবর্তী অদেখা জগতের ভাবনা কমবেশি সবাইকে ভাবিত করে। ইংরেজি সাহিত্যের চিন্তাশীল অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন এবং অনুভূতিপ্রবণ কবিমনে আধ্যাত্মিকতার দ্যুতি ও মৃত্যুভাবনার দোলা আমাদের চিন্তা ও বিশ্বাসে সমৃদ্ধি এনে দেবে।
জন ডান (John Donne,১৫৭২-১৬৩১)-এর কবিতা রুচি ও ভাবনার দিক থেকে ইংরেজি কবিতায় ক্রমপরিবর্তনে প্রতিনিধিত্ব করে। যে সূর্যকে মানুষ তেজস্বিতা ও অকৃত্রিম ঔজ্জ্বল্যের কারণে সমীহ ও প্রণতি জানিয়ে এসেছে কালে কালে, ডান সেই সূর্যকে বলেছেন, ব্যস্ত নির্বোধ বৃদ্ধ (busy old fool), অবাধ্য সূর্য (unruly sun)| ভর্ৎসনা করেছেন ধৃষ্ট পণ্ডিতমূর্খ ও হতভাগা (saucy pedantic wretch) বলে| এই ব্যতিক্রমী ও ঋজু স্বভাবের প্রেমিক কবিভাবনার মধ্যেও মৃত্যুচিন্তা নাড়া দিয়েছিল। এবং তা ব্যতিক্রমের বাতাসে দোলায়িত।
ডানের Death be not Proud কবিতাটি ভয়ানক মৃত্যুর সম্মুখে অসহায় মানুষের একটি বলিষ্ঠ উচ্চারণ। মৃত্যুকে পুনঃপুনঃ তাচ্ছিল্যের মধ্য দিয়ে আমাদের জীবনে তাকে একটি গৌণ বিষয়ে পরিণত করা হয়েছে। পরিশেষে মৃত্যুই মৃত্যুকে প্রমাণ করে। কবির মতে, মৃত্যুর গর্বিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ, সে ততটা শক্তিমান বা ভয়ানক নয়, যতটা কিছু লোক ভেবে থাকে। মৃত্যু হলো, এক ধরনের বিশ্রামের ঘুম—Die not, poor death, not yet canst thou kill me;/ From rest and sleep, which but thy pictures be.
মৃত্যু কেবল অল্প সময়ের জন্য কবরে আমাদের ঘুম পাড়িয়ে রাখতে পারে। কিন্তু তারপর আমরা স্বর্গে চিরজীবন লাভ করব। তখন আমাদের ওপর মৃত্যুর কোনো ক্ষমতা কাজ করবে না। এর মধ্য দিয়ে মৃত্যুরই মৃত্যু সংঘটিত হবে—One short sleep past, we wake eternally,/ And death shall be no more, Death thou shall die.
At the Round Earth’s Imagined Corners কবিতায় ডান্ স্রষ্টার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন তার আদিপাপের জন্য। ক্ষমা চেয়েছেন অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের পাপের জন্য। কবির অনুশোচনার অন্ত নেই, কারণ তিনি অন্যকেও পাপকর্মে প্ররোচিত করেছেন। তার নিজের পাপের তোরণ দিয়ে অন্যরাও পাপজগতে প্রবেশ করেছে। কবি তার ত্রাণকর্তা ও স্বর্গীয় আর্শীবাদের প্রতি যথেষ্ট বিশ্বাসের অভাবকেই বড় পাপ বলে ধরে নিয়েছেন। শঙ্কিত হয়েছেন এই ভেবে যে, মৃত্যুর পর তার আত্মা চিরন্তনতার বেলাভূমিতে লয়প্রাপ্ত হবে, হয়ত পাড়ি দিতে পারবে না অনন্তের সুদীর্ঘ পথ—I have sin of fear, that when I have spun/ My last thread, I shall perish on the shore.
কবি স্রষ্টার কাছে প্রতিশ্রুতি চাইছেন মৃত্যুর পর সূর্যরশ্মির মতো তাঁর করুণা ও আর্শীবাদের স্নাত হতে। পরিশেষে, মুক্তি প্রশান্তি ও ধর্মের প্রতি প্রণতির সুর ধ্বনিত হয়েছে। কবি এখন অনুতপ্ত, অনুশোচনায় ন্যুব্জ। একান্ত বিনম্রতায় বিগলিত। নিবেদিত মহান স্রষ্টার ইচ্ছের কাছে। তাই কবি এতটা নির্ভয় ও নিঃশঙ্ক—I fear nor more.
ডানের ধর্মবিশ্বাস অ্যাধ্যাত্মিকতা ও পরজগতের সুখ-দুঃখময়তায় বিশ্বাসের উৎকণ্ঠিত মনোভাবের পরিপূর্ণ চিত্র আমরা পাই তার মৃত্যুর মাত্র আট দিন আগে রচিত—Hymn to God My God, in My Sickness কবিতায়। অসুস্থতা যেন এমন একটি প্রণালী (strait)| বা জলপ্রবাহ যার মধ্য দিয়ে কবি পরজীবনে যাত্রা করবেন। কবি সুখবোধ করছেন, এ কথা ভেবে যে, মৃত্যু ও পুনর্জ্জীবন অত্যন্ত কাছাকাছি অবস্থান করে—In all flat maps (and I am one) are one,/ So death doth touch the resurrection.
স্বর্গকে তার গন্তব্য ভেবে কবি এর অবস্থান জানতে চেয়েছেন। মূলত আসন্ন মৃত্যুর কথা ভেবে কবি স্রষ্টা ও যীশুর শরণাপন্ন হয়েছেন। প্রত্যাশী হয়েছেন চিরসুখের স্বর্গধামের।
__________________________________________________________________________________
এমন এক সময় ছিল, যখন মানুষ মৃত্যুকে দেখত কদর্য ও ভয়ঙ্কর রূপে। মৃত্যু বলতে তখন শুধু মাংসপিণ্ডকে ধূলায় পরিণত হওয়া ও হাড়গুলোকে সাদা দণ্ডে রূপান্তর বোঝাতো। কবরের বাইরে, আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে, মানুষের দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হতো না
__________________________________________________________________________________
জর্জ হারবার্ট (George Herbert, ১৫৯৩-১৬৩৩)-এর কবি প্রতিভার উন্মেষ ঘটে কৈশোরেই। ষোলো বছর বয়সে ক্যামব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে পড়ার সময় নববর্ষের উপহার হিসেবে তার মা’য়ের জন্য স্বরচিত দুটি সনেট পাঠান। সেখানে লেখেন—শুধু প্রেম নিয়েই কেন কবিতা রচিত হবে, কেন স্রষ্টার প্রশংসাসূচক বাণীতে কবিতার শরীর বর্ধিত হবে না। পবিত্র কবিতার প্রতি হারবার্টের প্রারম্ভিক আকাঙ্ক্ষা তার উত্তরকালীন স্বল্পায়ু জীবনে কখনো ধূসর হয়ে যায়নি। তাই তার কবিতা উৎসর্গের উদ্দীপনায় উদ্বেল, গুণ, ধার্মিকতা ও পবিত্রতার বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল।
হারবার্টের Death কবিতায় মৃত্যুর প্রতি দুটি বিপরীত প্রবণতা বর্ণিত হয়েছে। মানবাত্মার অমরতার অনিবার্য প্রমাণ উপস্থাপিত হয়েছে যীশু খৃস্টের, (খৃস্টীয় বিশ্বাস অনুযায়ী) ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার মাত্র তিনদিন পরই পুনরুজ্জীবন প্রাপ্তির ঘটনার মধ্য দিয়ে। এমন এক সময় ছিল, যখন মানুষ মৃত্যুকে দেখত কদর্য ও ভয়ঙ্কর রূপে। মৃত্যু বলতে তখন শুধু মাংসপিণ্ডকে ধূলায় পরিণত হওয়া ও হাড়গুলোকে সাদা দণ্ডে রূপান্তর বোঝাতো। কবরের বাইরে, আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে, মানুষের দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হতো না—After the loss of life and sense/ Flesh being turn’d to dust and bones to sticks.
কিন্তু যীশু খৃস্টের ক্রুশবিদ্ধ হওয়া ও পুনরুজ্জীবন প্রাপ্তির পর মানুষের মৃত্যু ভাবনায় আধ্যাত্মিক ও অলৌকিক দৃষ্টিভঙ্গি যোগ হয়। মৃত্যু যেন তাদের কাছে এখন সুন্দর মনোহর ও আশীর্বাদের নির্ঝরে বিধৌত। এখন বরং মানুষেরা মৃত্যুকে অনুরোধ করে তাদের কাছে আসার জন্যে। মৃত্যুর জন্য আকুতি ঝরে পড়ে তাদের অন্তরে। কারণ, তারা পুনরুজ্জীবিত হবে এবং অনন্ত জীবন লাভ করে উপভোগ করবে স্বর্গের চির আনন্দ—Thou art grown fair and full of grace,/ Much in request, much sought for as a good.
এনড্রু মারভেল (Andrew Marvell, ১৬২১-১৬৭৮) মেটাফিজিক্যাল স্কুলের অন্যতম কবি ও প্যামফেট রচয়িতা। বহুভাষাবিদ অনুভূতিপ্রবণ চিরকুমার এই কবির কবিতা সমসাময়িকদের কাছে এক প্রকার অজানাই ছিল বলা যায়। তার অনুশীলনধর্মী পাণ্ডুলিপি সম্ভবত পঠিত হয়েছিল বন্ধুকবি জন মিল্টন ও অন্য বন্ধুদের দ্বারা। অধিকাংশ কবিতা মুদ্রিত আকারে পাঠক মহলের নজরে আসে তার মৃত্যুর তিন বছর পর। প্রায় মাত্র চল্লিশটি ইংরেজি ও কিছু ল্যাটিন ভাষায় লিখিত নিতান্ত স্বল্পপ্রসূ এই কবির কবিতা দীর্ঘদিন অবহেলিত থাকে। কিন্তু উত্তরকালে, বিশেষ করে বিশ শতকে তাঁর কবিখ্যাতি বিশিষ্টতা পায়। টি এস এলিয়ট তাকে অভিহিত করেন একজন বড় মাপের কালোত্তীর্ণ কবি হিসেবে।
On a Drop of Dew কবিতায় মারভেল অসংখ্য কষ্টকল্পনা (conceit ) ও রূপক অলঙ্কার (metaphor)-এর মাধ্যমে মানবাত্মার পৃথিবীতে আগমন এবং স্বল্পকালীন অবস্থানে তার সত্যিকার আবাসে ফিরে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছার অভিনব বর্ণনা দিয়েছেন।
প্রশান্ত সজীব সকাল মুক্তো বিন্দুর মতো শিশির ঝরায় প্রস্ফুটিত গোলাপের রক্তিম পাপড়িতে। কিন্তু গোলাকার শিশিরবিন্দুটি তার নতুন আবাসের (পাপড়ি) প্রতি যেন উদাসীন। অবিরাম উপেক্ষা করে চলে সে লাল ফুলটিকে, যার পাপড়ির ওপর তার ক্ষণিক স্থিতি। শিশিরবিন্দুর যেন ইচ্ছে নেই গোলাপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতায়, নিবিড়তায়,—scare touching where it lies| কারণ, সে এসেছে মহিমান্বিত সুউচ্চ দিগন্ত থেকে, তাই, সেই চিরপ্রশান্তিময় স্বর্গে ফিরে যাওয়ার আকুতি ঝরে পড়ে। ঐকান্তিক ব্যাকুলতায় অবিরাম চেয়ে থাকে সে আকাশের দিকে—gazing back upon the Skies| তার ছোট্ট সুগোল শরীরে সূর্যরশ্মির অবাক বিচ্ছুরণে বিম্বিত হয় তারই শোকার্ত আভা—Shines with a mournful Light| তার দুঃখবিগলিত অশ্রু যেন সে নিজেই—its own Tear| এই দুঃখবোধ ও অশ্রুপাতের কারণ, স্বর্গীয় দিগন্ত থেকে তার বিচ্ছেদ দীর্ঘ সময়ের জন্য—so long divided from the Sphear| গোলাপ পাপড়ির মসৃণ ও পিচ্ছিল উপরিভাগের আজন্ম সুগোল এই চঞ্চলমতি শিশির বিন্দু নিরন্তর কাঁপন অনুভব করে, বোধ করে নিরাপত্তাহীনতা ভীত হয়ে পড়ে সে এই বৈরী পারিপার্শ্বকে যদি শেষে কলুষিত হয়ে পার্থিব পরিবেশের অবিরাম সংশ্লিষ্টতায়—Restless it roules and unsecure,/ Trembling lest it grow impure.
__________________________________________________________________________________
পার্থিব পরিবেশে আত্মাকে মনে হয় ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত কোনো সত্ত্বা কিন্তু ঊর্ধ্বলোকে, তার স্বর্গীয় আবাসে, অকৃত্রিম ঔজ্জ্বল্যে আভাসিত হয় সে। ক্ষণস্থায়ী এই পৃথিবীর বস্তুনিচয়ের প্রতি নিক্ষেপ করে ঘৃণা ও বিদ্বেষের বাণ, কিন্তু চিরসুখী স্বর্গের প্রেমে উদ্ভ্রান্ত প্রতীক্ষায় সে চির উন্মুখ
_________________________________________________________________________________
মানুষের আত্মাও যেন অনুরূপ এক শিশিরবিন্দু, যা নেমে আসে চিরন্তন দিবসের ঝর্ণাধারার অত্যুজ্জ্বল আলোকরশ্মি—Ray of the clear Fountain of Eternal day রূপে এই পৃথিবীতে। মানবাত্মা আসে স্বর্গের সুউচ্চ দিগন্ত হতে শিশিরের মতো। শিশিরবিন্দুর স্থিতি ও অবস্থান গোলাপের পাপড়িতে কিন্তু আত্মা থাকে মানবের নশ্বর মরণশীল দেহের ভেতরে। শিশির দৃশ্যমান, আত্মা দৃশ্যমান নয়। অদৃশ্য আত্মা অহর্নিশি স্মরণ করে চলে তার স্বর্গীয় আদী নিবাস (former height) এবং নিজস্ব মহিমান্বিত দ্যুতি। শিশির যেমন তার পবিত্রতা ও স্বচ্ছতা সংরক্ষণে সচেষ্ট তেমনি স্বর্গীয় আত্মা পৃথিবীর ইন্দ্রিয়-প্রলোভন উপেক্ষা করতে সদা তৎপর—Shuns (avoids) the sweet leaves and blossoms green| তার আদি ঔজ্জ্বল্যের স্মৃতি এখনো সজীব। তাই পৃথিবীর এই পঙ্কিল পথপরিক্রমায় সে প্রকটিত করে মহান স্বর্গরাজ্যেকে, তার আদী নিবাসকে, আত্মারূপী এই অপেক্ষাকৃত হীনস্বর্গের মধ্য দিয়ে।
আত্মা পৃথিবীতে আলতোভাবে আবর্তিত হয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে কিন্তু সে সন্তর্পণে এড়িয়ে চলে এই পঙ্কিল গোলার্ধ; নিজেকে উদ্ভাসিত করে স্বর্গীয় দিবসের (দ্য ডে-হ্যাভেনলী ডে) পবিত্র আলোকে। পার্থিব পরিবেশে আত্মাকে মনে হয় ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত কোনো সত্ত্বা কিন্তু ঊর্ধ্বলোকে, তার স্বর্গীয় আবাসে, অকৃত্রিম ঔজ্জ্বল্যে আভাসিত হয় সে। ক্ষণস্থায়ী এই পৃথিবীর বস্তুনিচয়ের প্রতি নিক্ষেপ করে ঘৃণা ও বিদ্বেষের বাণ, কিন্তু চিরসুখী স্বর্গের প্রেমে উদ্ভ্রান্ত প্রতীক্ষায় সে চির উন্মুখ—Dark beneath, but bright above/ Here disdaining, there in Love.
অত্যন্ত সহজ ও সাবলীল ভঙ্গিতে প্রহর গোনে স্বর্গে ফিরে যাওয়ার, বিদায়ের ইচ্ছা ও অনুভবে সে চিরমুক্ত, অবারিত। কিন্তু পৃথিবীর সংকটাপন্ন অবস্থাতেও নিজের ভারসাম্য রক্ষা করে চলে। ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায়, উড়ে যেতে সে সদা প্রস্তুত—How loose and easie hence to go/How girt (prepared) and ready to ascend.
চলবে